নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষা
পৃথিবীর ভাষাগুলোকে মূলত ৪টি বৃহৎ ভাষা পরিবারে ভাগ করা যায়। অস্ট্রো-এশিয়াটিক, চীনা-তিব্বতি, দ্রাবিড় ও ইন্দো-ইউরোপীয়। বাংলাদেশে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাসমূহ আবার দুটি শাখায় বিভক্ত মোন-খমের ও মুণ্ডারি শাখা। এই শাখার ভাষার মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাসি ভাষা। এটি মৌখিক, এ ভাষার কোনো বর্ণমালা নেই। বর্তমানে এ ভাষা রোমান হরফে লেখা হয়। সাঁওতালি ও মুণ্ডা ভাষা দুটিই মুণ্ডারি শাখার অন্তর্ভুক্ত। উভয় ভাষারই নিজস্ব কোনো হরফ নেই। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসছে এ ভাষা দুটি। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রঘুনাথ মুর্মু ‘অলচিকি’ নামে সাঁওতাল বর্ণমালা তৈরি করেন এবং তা সরকারি স্বীকৃতিও লাভ করেছে। চীনা-তিব্বতি ভাষাসমূহ আবার কয়েকটি শাখায় বিভক্ত। যেমন: বোডো, কুকি-চীন, সাক-লুইশ ও লোলো-বার্মিজ শাখা। মান্দি বা গারো, ককবোরক (ত্রিপুরা), লিঙ্গাম, পাত্র বা লালং, কোচ, রাজবংশী প্রভৃতি ভাষা বোডো শাখার অন্তর্ভুক্ত। মৈতেয় বা মণিপুরী, লুসাই, বম, খেয়াং, খুমি, ম্রো, পাংখো প্রভৃতি ভাষা কুকি-চীন শাখাভুক্ত। আবার রাখাইন, ওরাঁওদের কুড়ুখ, পাহাড়িকা ও মাহালি ভাষা দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। রাখাইন ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। ওরাঁওদের কুড়ুখ ভাষাটি আদি ও কথ্যভাষা। বাংলাদেশে ইন্দো-আর্য পরিবারভুক্ত ভাষার মধ্যে বাংলা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এই পরিবারে মণিপুরীদের বিষ্ণুপ্রিয়া, হাজং, চাকমা ভাষা এবং সাদরি ভাষাও রয়েছে।
বাংলাভাষার নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত দেশি শব্দগুলো প্রধানত সাঁওতালি ও মুণ্ডা ভাষা থেকে আগত। অথচ আজ হারিয়ে যাচ্ছে ওই ভাষাগুলোও। এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে উদ্যোগ নেই ভাষাগুলোকে সংরক্ষণের। এরই মধ্যে কোচ ও রাজবংশীদের ভাষা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। প্রায় পুরো বিলুপ্ত হয়ে গেছে কুড়ুখ ও নাগরি ভাষা। ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রতি দুই সপ্তাহে হারিয়ে যাচ্ছে একটি ভাষা। বিলুপ্তপ্রায় এসব ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করেছে ইউনেসকো। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণের বিষয়টি অতি দ্রুত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।
ভাষা সুরক্ষায় কী করা উচিত?
গবেষকরা বলছেন, অন্তত দুটি কাজ শুরু করতে হবে অবিলম্বে। একটি হলো ওই ভাষাভাষীদের প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম অবশ্যই মাতৃভাষা করা। দ্বিতীয়ত প্রতিটি ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যার কোনোটিই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
শিক্ষার প্রধান মাধ্যম ভাষা। এই ভাষাই যদি শিশুর কাছে দুর্বোধ্য আর ভীতিকর হয় তবে প্রথমেই শিশুর মানসিক ও মানবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। এদেশে অন্য ভাষাভাষী শিশুদের শিক্ষার শুরুতেই বোঝার মতো চেপে বসে বাংলাভাষা। নানা নৃগোষ্ঠীর শিশুদের কোমল মনে বাংলা ভাষার কশাঘাত বাংলা ভাষাটিকে আগ্রাসী ভাষা হিসেবে মনে হওয়াও যুক্তিসংগত হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে ওই শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের কিছু কার্যক্রম সরকার গ্রহণ করলেও তা চলছে ঢিমেতালে।
প্রথম দফায় পাঁচটি মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী শিশুদের পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে। প্রথমে জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিকল্পনা হয় প্রথম দফায় পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি ও গারো এই পাঁচটি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার। দ্বিতীয় পর্যায়ে ম্রো, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বমসহ ছয়টি ভাষায় এবং তৃতীয় পর্যায়ে কোচ, ওরাঁও (কুড়ুক), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষার পর অন্যান্য ভাষায়ও প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সে অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে গারো, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও সাদরি এ পাঁচটি ভাষায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতেই প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই তুলে দেওয়া হয় ২০১৭ সালে। এ বছরও ওই পাঁচটি মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য পাঠ্যবই প্রণয়ন ও বিতরণ করা হয়েছে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু সরকার অর্থ ব্যয় করে ওই ভাষাগুলোর পাঠ্যবই বিতরণ করলেও ওই ভাষার শিক্ষক বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমটি পুরোপুরি কাজে আসছে না। এ সমস্যা গত কয়েক বছর ধরে আলোচিত হলেও সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি অদ্যাবধি। একইভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাকি ভাষাভাষীদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজও চলছে ঢিমেতালে। ফলে সার্বিকভাবে অন্য জাতিগুলোর শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। এতে সরকারের ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কার্যক্রমটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থাকছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বলছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে চার বছর ধরে সমতলের সাদরি ভাষার শিশুদের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড তাদের মাতৃভাষায় পাঠ্যবই প্রণয়ন করলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় নানা নৃগোষ্ঠীর শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ শুরু করতে পারেনি এখনো। পাঠ্যবইগুলো বাংলা হরফে লেখা থাকলেও বাঙালি শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাবেই এটা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন অনেকেই। আবার শিক্ষকরা সঠিক উচ্চারণ করতে না পারা ও একটি শ্রেণিতে একসঙ্গে বাংলা ও সাদরি আলাদাভাবে পড়ানো সম্ভব নয় বলে অজুহাত তুলেছেন। একইসঙ্গে তারা জরুরি ভিত্তিতে সরকারিভাবে বা স্থানীয়ভাবে সাদরি ভাষি শিক্ষক নিয়োগের কথা তুলে ধরেছেন। একই সমস্যা পার্বত্য অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতেও। এছাড়া সেখানে প্রয়োজনের তুলনায় বিদ্যালয়ের সংখ্যাও কম। ফলে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা এখনো মনে করছেন তাদের মাতৃভাষায় শিশুশিক্ষার বিষয়ে সরকার ততটা আন্তরিক নয়। আর এ কারণেই মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমটি নানা সমস্যার মুখে গতিহীন হয়ে পড়ছে।
এদেশে অন্য নৃগোষ্ঠীর মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ শিশু স্কুলে যাচ্ছে। যাদের মধ্যে বড় একটি অংশ ঝরে পড়ে মাতৃভাষার কারণে। বাঙালি সমাজের কোমলমতি শিশুরা যখন শিক্ষার শুরুতেই বিদ্যালয়ে আনন্দ-হাসির মধ্যে নিজের মাতৃভাষায় ছড়া কাটছে, নিজের ভাষায় ভাব জমিয়ে বন্ধুত্ব করছে অন্য শিশুদের সঙ্গে তখন অন্য জাতির শিশুরা নীরবে, নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে কষ্ট নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বিদ্যালয় থেকে। তাই শুধু অন্য জাতির মাতৃভাষায় দায়সারা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করলেই চলবে না। সেটি শ্রেণিকক্ষে পঠন ও শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করার উদ্যোগও নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় পুস্তক প্রণয়নের সঙ্গে সমন্বয় রেখে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট ভাষার শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনাও হাতে নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০
© 2020, https:.