শীতকাল প্রায় শেষের পথে। এ সময় সারা দেশের সাঁওতাল গ্রামগুলোতে ধুমধামের সঙ্গে পালিত হচ্ছে সোহরাই উৎসব। এ উৎসবের আলাপে যাওয়ার আগে সাঁওতাল জাতি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা নেওয়া প্রয়োজন। নৃ-তাত্ত্বিকদের মতে, সাঁওতালরা আদি-অস্টেলীয়গোষ্ঠীর মানুষ। বাংলাদেশে বসবাসরত নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগুলোর মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে এরা দ্বিতীয় বৃহত্তম। এরা নিজেদের ‘সানতাল’ বলতেই অধিক পছন্দ করে। একে অপরকে এরা ডাকে ‘হর’ বলে। ‘হর’ অর্থ ‘মানুষ’। সাঁওতালদের আদি নিবাস ভারতের ছোট নাগপুরের মালভূমি এবং আসামের পাহাড় ও বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বাংলাদেশে সাঁওতালদের বসবাস উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা প্রভৃতি জেলাতেই বেশি। সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্য মতে, বাংলাদেশে সাঁওতালদের সংখ্যা ১ লাখ ৪৭ হাজার। তবে সাঁওতালরা মনে করে তাদের সংখ্যা আরও বেশি।
পৃথিবী সৃষ্টিরও আগের কথা। তখন চারদিকে ছিল শুধু পানি আর পানি। ঠাকুর জিয়ো পৃথিবী সৃষ্টির ইচ্ছা নিয়ে পানির মধ্যে কাঁকড়া, কুমির, বোয়াল, কাছিম, কেঁচোর মতো জীবের আবির্ভাব ঘটালেন। কিন্তু এতেও তার সন্তুষ্টি এলো না। অতঃপর তিনি মাটি থেকে একজোড়া মানব-মানবী সৃষ্টি করলেন। কিন্তু যখনই তিনি তাদের ভেতর জীবন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখনই আকাশ থেকে আজব এক ঘোড়া এসে মানব-মানবীর মূর্তিগুলোকে খেয়ে ফেলে। ঠাকুর জিয়ো এতে কষ্ট পেয়ে নিজের বুকের অংশ থেকে সৃষ্টি করলেন একজোড়া পাতিহাঁস। তাদের ভেতর তিনি আত্মা দিলেন। পাতিহাঁস দুটো মনের আনন্দে ভেসে বেড়াতে থাকল। এক দিন হঠাৎ ওই আজব ঘোড়াটি এসে তাদের গ্রাস করার চেষ্টা করল। এবার ঠাকুর জিয়ো সতর্ক ছিলেন। তিনি ঘোড়াটিকে সমুদ্রের ফেনায় পরিণত করলেন। সেই ফেনার পানিতে পাতিহাঁস দুটি মনের আনন্দে ভেসে বেড়াতে থাকে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? তাদের আশ্রয়ের জন্য মাটি চাই, বাঁচার জন্য চাই খাদ্য। এ ধরনের প্রার্থনায় ঠাকুর জিয়ো কাছিমকে নির্দেশ করলেন পানির নিচ থেকে মাটি তুলে আনতে। কাছিম ব্যর্থ হলো। চিংড়িকে বললে সেও চেষ্টা করে সফল হলো না। এভাবে বোয়াল, কাঁকড়া একে একে সবাই ব্যর্থ। রাগান্বিত হয়ে ঠাকুর জিয়ো হুকুম করলেন কেঁচোকে। কেঁচো পানির অতল থেকে মাটি তুলে আনল। এবার মহা-প্রভু ঠাকুর জিয়ো আনন্দের সঙ্গে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। পৃথিবীতে স্থাপন করলেন পাহাড়, অরণ্য সবকিছু। সেখানে পাতিহাঁস দুটি বাসা বাঁধে এবং প্রকৃতির নিয়মেই ডিম পাড়ে। সেই ডিম ফুটলে ভেতরে দেখা মিলল দুটি মানবসন্তানের। একটি ছেলে, অন্যটি মেয়ে। ছেলেটির নাম পিলচু হড়ম ও মেয়েটির নাম পিলচু বুড়ি। সাঁওতালদের আদি বাবা-মা। পৃথিবী নিজ জাতির উৎস নিয়ে সাঁওতাল সমাজে লোকবিশ্বাস এমন কাহিনী আজও প্রচলিত আছে।
কাজের সূত্রে কয়েক বছর আগে গিয়েছিলাম দিনাজপুরের সাঁওতাল গ্রাম মহেশপুরে। সেখানে খুব কাছ থেকে দেখেছি তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘সোহরাই’। ‘সাহার’ শব্দ থেকে এসেছে ‘সোহরাই’ শব্দটি। যার অর্থ বৃদ্ধি হওয়া। মূলত এ উৎসবে ধনসম্পদ ও গরু-বাছুর বৃদ্ধির জন্য বিশেষ আচারের মাধ্যমে বোঙ্গাদের (দেবতা) কাছে আকুতি জানানো হয়। প্রতি পৌষ বা মাঘে সাঁওতাল গ্রামগুলোতে আয়োজন চলে এ উৎসবের।
সোহরাই উৎসবের নির্দিষ্ট কোনো দিন নেই। গোত্রের সবাই মহতের (গোত্রপ্রধান) উপস্থিতিতে নির্ধারণ করে উৎসবের দিনটি। উৎসবে গোত্রের মহতকে আগের দিন উপোস থাকতে হয়। সাত দিন ধরে চলে এ উৎসবের আচার। প্রথম দিনটিকে সাঁওতালদের ভাষায় বলে ‘উম’। ওইদিন গ্রামের পুরুষরা জমায়েত হয় একটি মাঠের মধ্যে। সেখানে একটি জায়গায় আতপ চাল দিয়ে ঘেরাও বা গোলাকার বৃত্ত তৈরি করা হয়। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে ভেতরে রাখা হয় সিঁদুর ও পাতার ঠোঙায় সামান্য হাঁড়িয়া বা চুয়ানি (সাঁওতালদের প্রিয় পানীয়)। অতঃপর মহত সেখানে মুরগি বলি দেন জাহের এরা, মারাঙ্গ বুরু, মড়ৈকো, তুরুই কো, গোসাই এরা, পারগানা বোঙ্গা ও অন্যান্য বোঙ্গার উদ্দেশে। বলির পরে মাঠ থেকে সবাই নেচেগেয়ে চলে আসে মহতের বাড়িতে। এখানে মুরগি দিয়ে রান্না করা হয় খিচুড়ি। মূলত মহতের বাড়িতে রান্নার মধ্য দিয়েই সাঁওতালদের সোহরাই উৎসবের শুভ সূচনা ঘটে
সোহরাইয়ের দ্বিতীয় দিনকে বলে ‘ডাকা’। ওইদিন প্রত্যেক পরিবার তাদের নিকট আত্মীয় ও মেয়ের জামাইকে দাওয়াত করে। ফলে সবার বাড়িতে রান্না হয় ভালো ভালো খাবার। সোহরাই উৎসবের তৃতীয় দিনটি চলে হাস্যরস আর আনন্দের মধ্যে। এই দিনটিকে বলে ‘খুনটাও’। ওইদিন একটি বাড়ির উঠানে গোল দাগ দিয়ে দাগের ভেতরে খুঁটিতে বেঁধে দেওয়া হয় একটি ষাঁড় গরু। ষাঁড়ের শিং আর গলায় ঝোলানো হয় তেলের পিঠা বা পাকওয়াল। অতঃপর প্রচণ্ড শব্দে মাদল বা ঢোল বাজানো হয়। মাদলের শব্দে ছটফট করতে থাকে ষাঁড়টি। এ ধরনের অবস্থাতেই দাগের বাইরে থেকে সাঁওতাল যুবকরা হুড়োহুড়ি করে ষাঁড়ের শিং ও গলা থেকে তেলের পিঠা নেওয়ার চেষ্টা করে। এভাবে তেলের পিঠা ছিনিয়ে নেওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে পুরো সাঁওতাল গ্রাম।স
চতুর্থ দিনে মাছ বা কাঁকড়া ধরতে সাঁওতালরা দল বেঁধে জাল আর পলো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এরা এটিকে বলে ‘হাকু কাটকোম’। পঞ্চম দিনে আগের চার দিনের ভুলত্রুটি সংশোধন ও পরের দিনগুলোর পরিকল্পনা করা হয়। এটিকে ‘ঝালি’ বলে। সোহরাই উৎসবের ষষ্ঠ দিনটি মূলত শিকারকেন্দ্রিক। এদের ভাষায় এটি ‘সেন্দ্ররা’। ওইদিন সকালে একদল সাঁওতাল তীর ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিকারে। আর গোত্রের অন্যরা মহতসহ গ্রাম পরিষদের পাঁচ সদস্যের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ-গান ও বিভিন্ন খেলা দেখিয়ে চাল সংগ্রহ করে তা জমা রাখে মহতের বাড়িতে। দিন শেষে শিকার থেকে ফেরা শিকারিদের নিয়ে চলে নানা প্রতিযোগিতা। একটি মাঠে একটি কলাগাছ দাঁড় করিয়ে তার ওপর রাখা হয় মহতের স্ত্রীর হাতের তৈরি তিনটি তেলের পিঠা। দূর থেকে ধনুক দিয়ে যে কলাগাছ লাগাতে পারে সেই হয় বিজয়ী। বিজয়ীকে আবার পালন করতে হয় বেশ কিছু নিয়ম। কী সেই নিয়ম? পাঁচটি ধনুক মাটিতে লম্বালম্বি সাজিয়ে বিজয়ীকে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে এর চারদিক ঘুরে মাটিতে থাকা ধনুক একটি একটি করে তুলতে হয় এবং একই নিয়মে আবার মাটিতে সাজাতে হয়। অতঃপর কলাগাছটি গোত্র পরিষদের পাঁচ সদস্যের জন্য পাঁচ টুকরো করে বিজয়ী কাঁধে তুলে নেয়। এ অবস্থায় বিজয়ীকেও সবাই কাঁধে তুলে হই-হুল্লোড় করে নিয়ে আসে মহতের বাড়িতে। এ সময় সবাইকে আপ্যায়ন করা হয় মুড়ি আর হাঁড়িয়া দিয়ে। অন্যদিকে শিকারগুলো দিয়ে চলে খিচুড়ি রান্না। খিচুড়ি আর হাঁড়িয়ার আনন্দে ভাসতে থাকে পুরো গ্রাম। সোহরাইয়ের সপ্তম দিনটিতে প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভালোমন্দ খাবার খায়। এভাবে নানা আয়োজন আর ধুমধামের সঙ্গে শেষ হয় সাঁওতালদের সোহরাই উৎসবটি।
এ দেশে বসবাসরত সাঁওতালদের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত নিজস্ব আচার, উৎসব ও সংস্কৃতি। নানা কারণে উৎসবগুলোতে টিকে থাকছে না আদি আচারগুলো। ধর্মান্তরের প্রলোভন আর দারিদ্র্য ও সংখ্যাগরিষ্ঠের আগ্রাসী সংস্কৃতির চাপে সাঁওতাল সংস্কৃতি আজ প্রায় বিপন্ন। তবু এরা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উৎসবগুলোকে। মাদলের বাদ্যি আর সাঁওতাল নৃত্যে নিজেকে খোঁজার আনন্দ সত্যি অনন্য। উৎসবে আনন্দ উল্লাসের জোয়ারে তাই ভেসে যায় সাঁওতালদের চিরচেনা দুঃখগুলো।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল : ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০
© 2020, https:.