খাদ্য কেনা জীবন রক্ষার নিশ্চয়তা দেবে না
আমাদের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) একটি ভয়াবহ তথ্য দিয়েছে। দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সমদ্রবন্দর ও স্থলবন্দর দিয়ে ২১ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত ৫৫ দিনে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছেন ৬ লাখ ২৪ হাজার ৭৪৩ জন। দেশে আসার এ ধারা খানিকটা কমলেও চলছে এখনো। দেশে প্রবেশের সময় এদের কিছু সংখ্যককে থার্মাল স্ক্যানিংয়ের মধ্যে দিয়ে আসতে হলেও, বেশিরভাগেরই স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়নি। এদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, করোনাভাইরাসে কেউ আক্রান্ত কি না সেটি নিশ্চিত হতে হলে অন্তত ১৪ দিন সময় লাগে। সংক্রামিত এলাকা থেকে আসা ব্যক্তিদের এই সময়টুকু আলাদাভাবে রাখতে হবে। যা অনুসরণ করছে বিভিন্ন দেশ। তাহলে আমাদের বিদেশ ফেরতদের সবাইকে কেন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হলো না? এরাই এখন মিশে যাচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে প্রিয়জনদের সঙ্গে। ইতিমধ্যে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলাকে লকডাউন করা হয়েছে। এভাবে পদ্ধতিগত ক্রটির কারণে তৃণমূলে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তরা। পাশাপাশি বিদেশ ফেরত বাংলাদেশিদের জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
চীন ও ইতালির মতো করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে বাংলাদেশিরা তাদের নিজ দেশে প্রিয়জনের কাছে ফিরে আসতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। আগতদের অনেকেই জানে না তারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত কি-না। কিন্তু রাষ্ট্রকেই তো কঠোরভাবে শারীরিক পরীক্ষার পর কোন পদ্ধতিতে তাদের দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানো হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি দৃশ্যমান হতো কোনো ব্যক্তি শরীরে ‘ডিনামাইট’ নিয়ে দেশের ভেতর প্রবেশ করছে। সেটির বিস্ফোরণ ঘটলে বহু মানুষ মারা যাবে। তাহলে কি রাষ্ট্র তাদের ওভাবে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করাত? তাহলে কেন করোনার মতো ‘অদৃশ্য ডিনামাইট’ নিয়ে আসা লাখো প্রবাসীকে কোয়ারেন্টাইনে না রেখে দেশের ভেতর প্রবেশ করানো হলো?
আমাদের চেয়ে গরিব দেশ নেপাল। জানুয়ারিতে সেখানে চীন ফেরত এক যুবকের শরীরে করোনার জীবাণু পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে তারা সর্বোচ্চ সর্তকতা হাতে নেয়। করোনা প্রতিরোধে নামানো হয় সেনাবাহিনীকে। কোয়ারেন্টাইনের জন্য খুব দ্রুত তৈরি করা হয় বিশেষ হাসপাতালও। বিদেশ থেকে আগতদের আবশ্যিকভাবে রাখা হয় সেখানেই। শুরুতেই এমন উদ্যোগের ফলে ওখানে এখন আর করোনা আক্রান্ত নেই। মূলত শুরুতেই সঠিক সিদ্ধান্ত ও ভালো প্রস্তুতি দেশকে বড় বিপদ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু সময় পেলেও সে প্রস্তুতি এখনো আমরা নিতে পারিনি। নেপালের মতো পুরো প্রক্রিয়াতে সেনাবাহিনীকে যুক্ত না করলেও সরকারিভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দুটি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং করার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গকে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হবে। সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এসব যাত্রীকে বিমানবন্দর থেকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে রাখা, ডিজিটাল ডাটা এন্ট্রি কার্যক্রম সম্পন্ন, সেন্টারে থাকাকালীন আহার, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করবে। অনেক দেরিতে হলেও এটি সরকারের ভালো সিদ্ধান্ত। চীনসহ অন্যান্য দেশের মতো বিমানবন্দর শাটডাউন বা আরও আগে সেনাবাহিনীকে নিয়োজিত করা হলে করোনার সংক্রমণ খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত বলে মনে করেন অনেকেই।
গোটা পৃথিবীই আজ ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি। করোনাভাইরাসে আক্রান্তর কাছে যেতে পারে না তার নিকটজনেরা। প্রিয়জনও তাকে ছুঁয়ে দেখতে পারে না, থাকতে হয় নিরাপদ দূরত্বে। নিঃসঙ্গ ও অসহায়ের মতো আক্রান্ত ব্যক্তি এগিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। মৃত্যুর পরও তার পাশে যেতে নেই কাউকে। প্রিয়জনের এমন করুণ ও নিঃসঙ্গ মৃত্যুর কথা ভাবলেও বুকের ভেতরটা খামচে ধরে। বিজ্ঞানের উন্নতির যুগে মানবজাতির এমন অসহায় ক্রান্তিকাল হয়তো আর কখনো আসেনি।
এসব নানা খবরে নিজের জীবন ও পরিবারকে বাঁচাতে একদল ছুটছেন বাজারে। কিনে নিচ্ছেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীও। ফলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে দ্রব্যাদির দাম। এ ক্ষেত্রে জনগণকে সরকারের ভবিষৎ দিকনির্দেশনা যেমন দ্রুত জানানো প্রয়োজন তেমনি উন্নত দেশের মতো জনপ্রতি দ্রব্যাদি কেনার সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। অধিক খাদ্য কিনে রাখা আপনার জীবন রক্ষার নিশ্চয়তা দেবে না। দেশে খাদ্য ঘটতি ঘটলে তখন আপনি হয়তো খেতে পারবেন মাত্র। কিন্তু সবাই যদি ভাইরাসে আক্রান্ত হয় তখন আপনিও করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাবেন না। তাই জীবন বাঁচাতে নিজ পরিবার ও পরিজনদের সচেতন করুন সবার আগে। টাকা থাকলে গরিবদের জন্য মাস্ক ও হ্যান্ডওয়াশ কিনে বিতরণ করুন। খাদ্য কেনা নয়, চারপাশের মানুষকে ভাইরাসমুক্ত রাখতে পারলেই আপনি বা পরিবার করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাবেন। আর সেটিই জীবন সুরক্ষায় সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মীরা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক তৈরি এবং তা বিনামূল্যে বিতরণের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। যা খুবই সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। অন্যান্য ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনেরও উচিত এমন কার্যক্রম হাতে নেওয়া। তবে সেগুলো বিতরণের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতা করা থেকেও বিরত থাকতে হবে।
কোয়ারেন্টাইন মানে একজনের কাছ থেকে আরেকজনের আলাদা থাকা, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তির দেহে এ ভাইরাস সংক্রমিত না হয়। আর ১৪ দিন একটি নির্দিষ্ট ঘরে সবার কাছ থেকে আলাদা থাকার নাম ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’। আবার ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে বা চিকিৎসাধীন আছেন এমন ব্যক্তিকেও সুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখাকে বলে ‘আইসোলেশন’। কিন্তু এ শব্দ দুটি মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করছে। বিশেষ করে বিদেশফেরত ব্যক্তি ও আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন আক্রান্তকারী ও তার পরিবারকে বোঝাতে হবে এটি ভয়ের কোনো বিষয় নয়। সহজ ভাষায় তাদের বুঝিয়ে বলুন এর অর্থ হলো ‘ঘরবন্দি’ থাকা, ছোঁয়াচে এই রোগ যাতে না ছড়ায় সেজন্য সতর্ক থাকা। এ বিষয়ে কাউন্সিলিংয়েরও প্রয়োজন রয়েছে। একজন ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় দেশ ও তার প্রিয়জনের স্বার্থে এমন ‘ঘরবন্দি’ থাকেন বা আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনে যেতে চান সে পরিবেশ তৈরি করাই হবে আমাদের আসল কাজ। এ বিষয়ে গণমাধ্যমসহ সবাইকেই আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হতে হবে।
চিকিৎসকরা বলছেন করোনায় আক্রান্তরা বেশির ভাগই সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে বিশেষ সর্তকতা নিতে হবে বৃদ্ধ ও শিশুদের ক্ষেত্রে। এর মৃত্যু হারও কম। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন রাখতে না পারলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে তৃণমূলে। তাই বিভিন্ন স্থান লকডাউন করাসহ এ বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্তগুলোও সরকারকে নিতে হবে দ্রুততার সঙ্গে। করোনাভাইরাসের এ দুর্যোগ মোকাবিলা শুধু সরকারের একার দায়িত্ব নয়। সংক্রমণ ঠেকাতে সম্মিলিতভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতি নির্বিশেষে সবাইকেই কাজ করতে হবে। আপনার, আমার, সবার সচেতনতাই পারে করোনাভাইরাস থেকে দেশকে মুক্ত করতে।
ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২২ মার্চ ২০২০
© 2020, https:.