গুজব ও অসচেতনতা
বাজারের নকল খাদ্য যেমন আপনার ও পরিবারের শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। তেমনি ফেইসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বানোয়াট ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ালে তা আপনার, পরিবারের, সমাজের ও দেশের জন্যও ক্ষতিকর। তাই না বুঝে, না জেনে, যাচাই না করে ফেইসবুকে ছড়ানো তথ্য বা সংবাদ লাইক, শেয়ার বা অন্যের ইনবক্সে দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সারা দেশে লকডাউন চলছে। ‘সামাজিক দূরত্ব’ নিশ্চিতকরণে নেমেছে সেনাবাহিনীও। যখন লিখছি তখন আক্রান্ত ৪৭জন, সুস্থ হয়েছে ১৫জন এবং মৃত্যুবরণ করেছে ০৫ জন। সারাে দেশে বাড়ছে কোয়ারন্টাইনে থাকা মানুষের সংখ্যাও। করোনাভাইরাসে ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৮৬ হাজার ৪৯৮, চীনে এ সংখ্যা ৮১ হাজার ৩৪০, স্পেনে ৬৪ হাজার ২৮৫। ওয়াশিংটন স্কুল অব মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, করোনার মহামারীতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই আগামী চার মাসে ৮১ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হতে পারে। উন্নত বিশ্ব যখন এই ভাইরাস মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে তখন আমাদের দেশে একটি শ্রেণি ব্যস্ত অন্য কান্ডে।
লকডাউনের কারণে অধিকাংশ মানুষ ঘরে আবদ্ধ। যার একটি বড় অংশ সময় কাটাচ্ছে অনলাইনে। তাদের প্রায় সবাই শিক্ষিত বলে ধরে নেওয়া যায়। সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, আসল-নকলের বিবেচনাবোধ তাদের থাকার কথা। কিন্তু তবুও করোনার ওষুধ আবিষ্কার, প্রতিরোধে অব্যবস্থাপনা, আক্রান্তের সংখ্যা আর মৃত্যুকে ঘিরে নানা কুসংস্কার আর গুজব ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। এ নিয়ে ভিত্তিহীন সংবাদ, অডিও এবং ভিডিও ছড়াচ্ছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, সচেতন বা অসচেতনতায় এ গুজব ছড়াতে যুক্ত হচ্ছেন অনেকেই। এসব গুজব বিভ্রান্তি তৈরি করাসহ ঝুঁকিতে ফেলছে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থেরও।
দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে ২৬ মার্চ দুপুরে এক নবজাতকের জন্ম হয়। জন্মের পরপরই সে কথা বলতে শুরু করে। বলে ‘করোনাভাইরাস পার্বতীপুরেও আক্রমণ করেছে। লং, সাদা এলাচ আর আদা পানিতে সিদ্ধ করে খেলে করোনাভাইরাস হবে না। এছাড়া রং চা চিনি ছাড়া খেতে হবে।’ এটি বলেই নবজাতকটি মারা যায়। এমন বিভ্রান্তিমূলক গল্প ছড়িয়ে পড়ে দিনাজপুর ও রংপুরের কয়েকটি জেলায়।
তিনটি থানকুনিপাতা খেলে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। তবে তা খেতে হবে ফজরের নামাজের আগেই। এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে বরিশালের গৌরনদী, আগৈলঝাড়া ও উজিরপুর উপজেলায়। ফলে রাত দুইটা থেকে ফজর নামাজের আগ পর্যন্ত পাতা খাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। পাতা খেয়ে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হয়। নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার বারৈচা, দেওয়ানেরচর, খামারচর এলাকায় মধ্যরাতে আজান ও করোনাবিরোধী মিছিল করা হয়। এ সময় বাড়ি বাড়ি আজান দিতে মসজিদের মাইকেও আহ্বান জানানো হয়। ফলে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাস্তায় নামে শত শত মানুষ। ‘করোনাভাইরাস নিপাত যাক, আল্লাহু আকবার’ এমন স্লোগান দিতে থাকে তারা। পরে পুলিশ মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এছাড়া করোনা থেকে বাঁচতে রাত ১২টার আগে কালোজিরা, আদা ও লবঙ্গ খেতে হবে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে ফেইসবুকে। ফলে বাড়ি বাড়ি এসব খাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়।
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় শাহিন মিয়া দাবি করেন ‘গত সোমবার তিনি সারা দিন স্বপ্ন দেখেন। দিন শেষে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর ওষুধের ফর্মুলার পুরোটাই স্বপ্নে জানতে পারেন। শুক্রবার খামারগাঁও ব্যাপারীবাড়ির মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের সামনে তার করোনা ঠেকানোর ওষুধ আবিষ্কারের বিষয়ে প্রচার চালান। বলেন, তার আবিষ্কার করা ওষুধ মুসলিম ছাড়া অন্য ধর্মের লোকেরা খেলে মৃত্যু হবে। যদি সে মুসলিম হয়ে ওষুধ খায়, তাহলে তার কিছুই হবে না।’ এ ঘটনায় শাহিন মিয়াকে ছয় মাসের কারাদন্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। ফ্রিজ থেকে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। তাই প্রশাসনের লোকেরা ফ্রিজ ভেঙে ফেলছে। এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে রাজশাহীর দুর্গাপুর, মোহনপুর ও বাগমারা এলাকায়। আতঙ্কে ফ্রিজ লুকিয়েও রাখতে শুরু করে অনেকেই। এছাড়া ওই জেলার গোদাগাড়ী এলাকায় গুজব ছড়ানো হয়েছে এই বলে যে বাড়ির দরজার বাঁ পাশ সামান্য খুঁড়লেই মিলবে সুরমা। সেই সুরমা মাখলে স্পর্শ করবে না করোনাভাইরাস।’ ফলে গোটা এলাকায় শুরু হয় খোঁড়াখুঁড়ি। ‘দোকানপাট বন্ধ থাকায় ফ্লেক্সিলোড বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে গ্রামীণফোনের এই মেসেজটি ৩০ জনকে শেয়ার করলে ১০ জিবি ফ্রি ডাটা দিচ্ছে। এটা আমি বিশ্বাস করিনি প্রথমে। আমার বন্ধু করেছে, সে পেয়েছে। এরপর আমি শেয়ার করেছি, আমিও পেয়েছি।’ এ ধরনের গুজবের মেসেজও পরিচিতজনদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের মেসেঞ্জারে। যা শুধু ভিত্তিহীনই নয়, হাস্যকরও বটে।
সাম্প্রতিক সময়ে উল্লিখিত গুজবের সংবাদগুলোতে এটা স্পষ্ট যে এক শ্রেণির মানুষ ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার এবং ভন্ডামির প্রচার-প্রচারণায় ফেইসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে গুজব ছড়াচ্ছে। নির্বিচারে সেগুলো শেয়ার করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুজবের বিপজ্জনক ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মানুষ গুজব ছড়াতে পছন্দ করে। চেনা মানুষ বা তারকা বা বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে গুজব বা অদ্ভুত ধরনের কথাবার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার সহজাত প্রবণতা মানুষের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু মানুষ কেন গুজব ছড়ানোর মতো প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে সংযত রাখতে পারে না সে বিষয়ে কয়েক বছর আগে একটি অনুসন্ধানী গবেষণা প্রতিবেদন ছাপা হয় একটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘যে কাহিনীর মধ্য দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা বিষয় সম্পর্কে মানুষের ধারণা পাল্টে যেতে পারে, সেটি গুজব হিসেবে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ফলে ওই গুজবটি অন্যকে বলতেও মানুষ বেশি উৎসাহ বোধ করে এবং নিজেকে সংযত রাখতে পারে না।’ যেটি খুব বেশি ঘটছে বাংলাদেশে।
ফেইসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বড় ধরনের তথ্যের একেকটি বাজার। সে বাজারে আসল, নকল, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য থাকবেই। আপনি বাজার থেকে সঠিক তথ্য জানবেন, নাকি নকল তথ্য সত্য ভেবে ছড়িয়ে দিয়ে নিজের ও সামাজের ক্ষতি করবেন সে সিদ্ধান্ত আপনার।
গুজব তৈরি ও ছড়িয়ে দেওয়া ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য যাচাইয়ের দায়িত্বটা ব্যক্তির নিজেরও ওপরই বর্তায়। বাজারের নকল খাদ্য যেমন আপনার ও পরিবারের শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। তেমনি ফেইসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বানোয়াট ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ালে তা আপনার, পরিবারের, সমাজের ও দেশের জন্যও ক্ষতিকর। তাই না বুঝে, না জেনে, যাচাই না করে ফেইসবুকে ছড়ানো তথ্য বা সংবাদ লাইক, শেয়ার বা অন্যের ইনবক্সে দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশের পক্ষে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো সত্যি কঠিন। ঐক্যবদ্ধ সচেতনতাই পারে আমাদের মুক্তি দিতে। তাই বেশি বেশি ছড়িয়ে দিতে হবে পজেটিভ সংবাদগুলোকে। গুজবের সংবাদগুলোও যেন আমাদের মানসিক শক্তি ও সাহসকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে সবাইকেই। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধটি ঘরে থাকার, মানুষকে সচেতন করার। তা না করে আমরা যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়াতেই ব্যস্ত থাকি তবে ইতিহাসও আমাদের ক্ষমা করবে না।
ছবি: সংগৃহীত
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৯ মার্চ ২০২০
© 2020, https:.