আদিবাসী

টিয়ার জন্য কাঁদলো সবাই

আদিবাসী লোককথা

টিয়া পাখিটা নেই। না, উড়ে যায়নি। মাটিতে নিথর পড়ে আছে তার তুলতুলে দেহটি।পাশে বসা উশার সওদাগর। টিয়াটির মুনিব। টিয়ার জন্য বুক চাপড়ে কাঁদছেন তিনি।

কেন?

তার ওপর ভীষণ রেগেছিলেন সওদাগর। তাই হুঁকোর নলচে দিয়ে আঘাত করেছিলেন টিয়ার মাথায়। ওমনি তার মৃত্যু হয়।

সওদাগরের টিয়াটি ছিল অতি উপকারি। তার কারণেই বিত্তশালী হয়েছেন উশার সওদাগর। অথচ সেই টিয়া পাখিটিকেই তিনি হত্যা করেছেন নিজ হাতে।

কেন?

ঘুরে ফিরে সেসব কথাই বারবার মনে আসে সওদাগরের।

উশার সওদাগরের বাড়ি দরিয়ার ওপাড়ে। এ অঞ্চলের একমাত্র মহাজন ছিলেন তিনি। তার ছিল শত শত শুকর। শুকর পালন করা এবং তা দিয়ে চাষবাস করাই ছিল কাজ। সওদাগরের ছিল একটি টিয়া। মোক্তার হিসেবে কাজ করতো ওই পাখিটি। সওদাগর ভালবেসে তার নাম দেয় ‘ভজো গোবিন্দ গোপাল’।

যখন রাত নামতো তখন স্বর্গপুরীতে বসত দেবতাদের আসর। সে আসরে দেবতারা শলাপরামর্শ করত পৃথিবীর নানা বিষয় নিয়ে। সওদাগর সে সময় টিয়ামোক্তারকে পাঠিয়ে দিতেন স্বর্গপুরীতে। দেবতারা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন চাষাবাদ বিষয়ে। পৃথিবীতে কখন কোনদিক থেকে বৃষ্টিপাত করা হবে তাও তখন স্থির করা হতো। টিয়াটি স্বর্গপুরী থেকে সে সিদ্ধান্তগুলো জেনে আসত চুপিচুপি। পৃথিবীতে নেমেই সে তা বলে দিত সওদাগরকে।

সওদাগরও সেদিকেই ছুটতেন শুকরগুলো নিয়ে। বৃষ্টির কারণে সেখানে তখন চাষাবাদ করা খুব সহজ হতো। আর ফসলও ফলত অনেক। কোন কোন বছর দেবতারা বৃষ্টিপাতের সিদ্ধান্ত নিতেন পাহাড় অঞ্চলে। স্বর্গপুরী থেকে টিয়ামোক্তার সেকথা শুনে এসে জানিয়ে দিত সওদাগরকে। শুকরগুলো নিয়ে সওদাগরও তখন ছুটত পাহাড় অঞ্চলের দিকে। চাষবাস করে সেখানে অনেক ফসল ফলাত।

এভাবে কোন বছর কোন দিকে বৃষ্টি হবে টিয়ার মাধ্যমে সাওদাগর তা আগেই জেনে যেতেন। ফলে চাষবাস করতে করতে দিনে দিনে সওদাগর খুব ধনী হয়ে গেলেন।

একবার এক রাতে টিয়ামোক্তার গেল স্বর্গপুরীতে। সওদাগর তখন শুকরগুলো নিয়ে চাষাবাদ করতে গিয়েছেন অনেক দূরে।

রাতে স্বর্গপুরীতে বসে দেবতাদের বিচারসভা। সেখানে দেবতারা অন্যরকম এক সিদ্ধান্ত নেয়।

কি সেই সিদ্ধান্ত?

‘এবছর যে সব চাষি আখের চাষ করছে, তারা যদি সেই আখ কেটে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়, তবে সেই ধোঁয়া খেতে স্বর্গপুরী থেকে নেমে আসবে শত শত শারোখ পাখি। সেই পাখিগুলো যে মলত্যাগ করবে তা ডিরমীতে জমিয়ে ভরে রাখলে এক সময় তা সোনা হয়ে যাবে।’

দেবতাদের এমন সিদ্ধান্ত শুনে টিয়া ফিরে আসে পৃথিবীতে। কিন্তু তখনও দূর দেশ থেকে ফিরে আসেননি উশার সওদাগর। দেরি দেখে টিয়া নিজেই কাজে লেগে যায়।

উশার সওদাগরের বিস্তীর্ণ ক্ষেতে আখের চাষ ছিল। সে বছর ফসলও হয়েছিল খুব বেশি।

টিয়ামোক্তার কিষাণ ও বাগালদের ডেকে এনে বলল,

‘যাও, তোমরা খামার তৈরি করো। কাল থেকে সব আখ কাটতে হবে।’

কিষাণ ও বাগালরা তার কথামতো খামার তৈরি করল।

পরদিন টিয়া কিষাণদের জিজ্ঞেস করল, ‘কি হে, তোমাদের খামার তৈরি হয়ে গেছে তো?

তারা বলল, ‘হ্যাঁ, তোমার কথা মতো সব হয়েছে।’

টিয়ামোক্তার বলল, ‘তাহলে যাও, আখ কাটা শুরু করো। কেটে সব আখ খামারে নিয়ে এসো।’

কাটা আখ সব খামারে আনা হলো।

টিয়া তখন বলল, ‘এবার সব আখে আগুন লাগিয়ে দাও।’

টিয়ার নির্দেশ শুনে কিষাণদের চোখ কপালে ওঠে! কিন্তু তার কথা অমান্য করার সাধ্যি কার। টিয়ার নির্দেশমতো তারা কাটা আখে আগুন লাগিয়ে দিল।

বিশ দিন, বিশ রাত ধরে খামারে সেই আখ পুড়তে লাগল। সে সময় আখের ধোঁয়া খেতে স্বর্গপুরী থেকে নেমে এলো শত শত শারোখ পাখি। মনের আনন্দে তারা খামারে থাকল কয়েকদিন। ফলে পাখিগুলো অনেক মলত্যাগও করল।

টিয়া তখন কিষাণ ও বাগালদের আদেশ করল মলগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করে তা একটি ডিরমীতে ভরে রাখতে। তারা তাই করল।

দুই-তিন দিন পর বাড়ি ফিরল উশার সওদাগর। তিনি কিষাণ ও বাগালদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আখ কি সব কাটা হয়ে গেছে?’

তারা বলল, ‘তোমার টিয়ামোক্তার সব আখ কাটিয়েছে। কাটা আখ সব খামারে আনা হলে টিয়া তাতে আগুন লাগিয়ে দিতে বলে। আমরাও তাই করি। কাটা আখ বিশ দিন, বিশ রাত আগুনে পুড়েছে। পোড়া আখের ধোঁয়া খেতে স্বর্গপুরী থেকে নেমে এসেছিল অনেক শারোখ পাখি। সেই পাখিগুলো যে মল ত্যাগ করেছিল টিয়ামোক্তারের আদেশে আমরা তা জড়ো করে ভরে রেখেছি একটি ডিরমীতে। ওই যে, ওখানে ওই ঘরে রাখা আছে ওই ডিরমীটি।’

হুঁকা টানতে টানতে উশার সওদাগর সব কথা শুনছিলেন। কৃষাণদের কথায় তিনি টিয়ার ওপর ভীষণ রেগে গেলেন। ডাকা হলো টিয়ামোক্তারকে। সে স্বর্গপুরীর সিদ্ধান্তের কথা বলতে চাইল। কিন্তু সওদাগর তার কোনো কথাই শুনলেন না। বরং ক্ষিপ্ত হয়ে হুঁকোর নলচে দিয়ে আঘাত করলেন টিয়ায় মাথায়। আর এভাবেই সওদাগরের হাতে মৃত্যু হলো উপকারি টিয়ামোক্তারের।

টিয়ার মৃত্যুর পরই সওদাগর গেলেন ডিরমীটি দেখতে। সেটি রাখা ছিল একটি ঘরের মধ্যে। তিনি গিয়ে ডিরমীর ঢাকনাটা খুলতেই অবাক হয়ে গেলেন। দেখলেন পাখিগুলোর মল সব সোনা হয়ে জ্বলজ্বল করছে। সোনার আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে গোটা ঘর।

সওদাগর তখন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। উপকারি টিয়ার জন্য তিনি বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকলেন। কৃষাণ ও বাগালরা ছুটে গেল টিয়ার কাছে। পানি খাইয়ে তাকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকল। কিন্তু না, টিয়ামোক্তার আর মুখ তুলল না। টিয়ার শোকে কাঁদতে কাঁদতে দূর দেশে চলে গেল উশার সওদাগর।

ছবি: ‘ডেড প্যারোট’, শিল্পী নেভিল ক্যাইলে স্না (১৮৫৩-১৯০৩), যুক্তরাজ্য

 লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ২৯ মার্চ ২০২০

#salekkhokon #adibashilokokotha #আদিবাসীলোককথা

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button