দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে হলে
কেমন নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু? ইতিহাস তুলে আনার কাজে এমন প্রশ্ন প্রয়াসই করতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। উত্তরে প্রিয় নেতাকে নিয়ে তাদের উত্তরটি এককথায় এমন ‘তিনি হাত বাড়ালেই ধরে ফেলতেন বাঙালির আশা, বাঙালির ভাষা আর বাঙালির কষ্টগুলোকে। বাঙালির দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, স্বপ্ন, সাহস নিজের মধ্যে ধারণ করতেন। কী করে বাঙালির ভাষা ও স্বপ্নকে এক সুতোয় গাঁথা যায় সে শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর মধ্যে।’
যুদ্ধবিধবস্ত দেশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মনোভাব কেমন ছিল? সেটি স্পষ্ট হয় ১৬ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে প্রেসিডেন্ট ভবনে এক ভাষণ থেকে ‘যারা রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা দিয়ে গেল, তারা মরে নাই তাদের আত্মা বেঁচে আছে। তারা দেখবে, তাদের আত্মা দেখবে, যে বাংলার মানুষ সুখে বাস করছে কি-না। বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাচ্ছে কি-না। বাংলার মানুষ শান্তিতে বাস করছে কি-না। ওদের আত্মা সেদিন শান্তি পাবে যেদিন আপনারা পেট ভরে ভাত খাবেন, গায়ে আপনাদের কাপড় হবে, থাকার বন্দোবস্ত হবে, বেকার সমস্যা দূর হবে, সেদিনই আমি সত্যিকারের স্বাধীন বাংলার নাগরিক হিসেবে দাবি করতে পারব, এর আগে আমার দাবি করার অধিকার নেই…।’
এভাবেই দেশ গড়তে বাংলার মানুষকে উদ্দীপ্ত করতেন বঙ্গবন্ধু। ২৬ মার্চ ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানের ভাষণে তিনি বলেন ‘আজ আমি যখন আমার সোনার বাংলার দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই যুদ্ধবিধ্বস্ত ধূসর পা-ুর জমিন। ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, ক্ষুধার্ত শিশু, বিবস্ত্র নারী আর হতাশাগ্রস্ত পুরুষ। আমি শুনতে পাই সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ। নির্যাতিত নারীর ক্রন্দন, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ফরিয়াদ। আমাদের স্বাধীনতা যদি তাদেরকে আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ধার করে এদের মুখে হাসি ফোটাতে না পারে, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে তুলে দিতে না পারে এক মুঠো অন্ন, মুছে দিতে না পারে মায়ের অশ্রু ও বোনের বেদনা, তাহলে সেই স্বাধীনতা বৃথা, সে আত্মত্যাগ বৃথা… আসুন আজ আমরা এই শপথ গ্রহণ করি বিধ্বস্ত মুক্ত বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলব।’
কেমন দেশ চেয়েছিলেন জাতির জনক? সেটি অনুমান করা যায় তার নানা বক্তব্য বিশ্লেষণে। স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতেও তিনি বলেছিলেন এভাবে ‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামীদিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। ক্ষেত-খামার, কলকারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি, যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।’
আবার সোনার বাংলা গড়তে প্রয়োজন সোনার মানুষের। এটিও বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাইতো লেখাপড়া করে মনুষ্যত্ব-নির্ভর সত্যিকারের মানুষ হওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ৮ মার্চ ১৯৭৫। টাঙ্গাইলের কাগমারীতে মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ভাষণে তিনি বলেন ‘…আপনাদের মনে রাখা দরকার যে আমরা মানুষ পয়দা করব, নিজে যদি অমানুষ হই তো মানুষ পয়দা করব কী করে? আর দুঃখ হয় আমার এই জন্য যে বাংলার কৃষক ঘুষখোর বা দুর্নীতিবাজ নয়। বাংলার মজদুর আমার দুর্নীতিবাজ নয়। আর আমরা শতকরা পাঁচজন লোক শিক্ষিত। আমরাই হলাম সব থেকে বেশি দুর্নীতিবাজ।… আজ তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ ভাই আপনারা কাজ যদি না করেন, আমার পক্ষে সম্ভব না ভাই। শেখ মুজিবরকে বাইটা খাওয়ালেও সোনার বাংলা হবে না। সোনার বাংলা করতে পারব না যদি সোনার মানুষ আপনারা আমাকে না পয়দা করে দেন।’
সরকারি চাকরিজীবীরা জনগণের সেবক। তাই তাদেরও জনগণের পাশে থাকা ও তাদের ভালোবাসার নির্দেশ দিয়ে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমির ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘মনে রেখো, জনগণ কারা, তোমার বাপ তোমার ভাই। তোমাদের মায়না আসে কোত্থেকে আসে? সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী যারা এখানে আছেন তাদের সকলের বেতন আসে বাংলার দুঃখী মানুষের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে। তোমরা তাদের মালিক নও। তোমরা তাদের সেবক। তাদের অর্থে তোমাদের সংসার চলবে, তাদের শ্রদ্ধা করতে শিখো, তাদের ভালোবাসতে শিখো…।
দুর্নীতিবাজদের ‘চোরা’ বলে সম্বোধন করে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্বাধীন দেশের উন্নয়নে এরাই হবে দেশের প্রধান অন্তরায়। ১৯ জানুয়ারি ১৯৭৫। চট্টগ্রামে বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ একাধিক বক্তব্য পর্যালোচনা করলেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার মনোভাব স্পষ্ট হয়। ওইদিন তিনি বলেন ‘এখনো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোরি বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে দিয়েছে। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি, চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী; কিন্তু আর না।… পাকিস্তানিরা সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে। কাগজ ছাড়া আমার কাছে কোনো কিছু রেখে যায় নাই। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমাকে আনতে হয়। আর এই চোরের দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে লুটতরাজ করে খায়। আমি শুধু এমারজেন্সি দেই নাই।’
এরও আগে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ তারিখে, ঢাকায় ছাত্রলীগের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ছাত্র ও যুব সমাজকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার কথা বলেছেন এভাবে ‘…দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হয়ে গেছে। এ দুর্নীতি কোনো সরকার বন্ধ করতে পারে না। এই দুর্নীতি বন্ধ করবে জনসাধারণ। এ দুর্নীতি বন্ধ করবে ছাত্র সমাজ, যুব সমাজ-এর পেছনে লাগতে হবে। নাহলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। সুখী হলাম তোমাদের কাছে যে, তোমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চাও এবং সে জন্যই সংগ্রাম চালিয়ে যেও। সঙ্গে সঙ্গে যারা সংগ্রাম করতে চাও তাদের উচিত হবে প্রথম আয়নার দিকে তাদের চেহারা দেখে নেওয়া। না হলে পারবা না ভাইরা আমার, পারবা না। কয়েকদিন পরে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবা…।’
বিভিন্ন জায়গায় দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার মনোভাবের অকাট্য প্রমাণ। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪। দুর্নীতিকে দেশ থেকে উৎখাত করার নির্দেশ দিয়ে তিনি ভাষণ দেন সাভারে, রক্ষীবাহিনীর চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন ‘… আজ দেশবাসীর সকলকে আমি বলব, একতাবদ্ধ হয়ে এই সমস্ত যারা দেশের মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে… সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করে দাও।’
চট্টগ্রামে বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেছিলেন ‘নিশ্চয়ই ইনশাল্লাহ পারব এই বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতিবাজ, এই ঘুষখোর, এই মুনাফাখোরি, এই চোরাচালানিদের নির্মূল করতে। আমি প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমরা প্রতিজ্ঞা নাও বাংলার জনগণ প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করো।… জিনিসের দাম, গুদাম করে মানুষকে না খাইয়ে মারে, উৎখাত করতে হবে বাংলার বুকের থেকে এদের।’
তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন আর ‘মুজিব বর্ষ’ পালনে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের পথে চলার শপথ নিতে হবে আমাদের। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাসহ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে কাজ করে যেতে হবে সবাকেই। তবেই জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী সার্থক হবে।
ছবি : অনলাইন থেকে সংগৃহীত
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৫ মার্চ ২০২০
© 2020, https:.