বিদ্যালয়ে শাসনের নামে শিশু নির্যাতন
বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিশুশিক্ষার্থীদের একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত দিয়ে শুরু করি। ঢাকার নালন্দা বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ের শিশুরা পড়বে অভয়ে। নির্ভয় শব্দটিকে তারা নেতিবাচক মনে করে। বিদ্যালয়ে সব বিষয়ে শিশুরা জানবে ও শিখবে আনন্দ নিয়ে। ফলে তাদের মানসিক বিকাশ ঘটবে সঠিক নিয়মে। শিশুর ভেতরকার সৃজনশীল প্রতিভাগুলোও বিকশিত হবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যালয়টি শিশুদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
সাধারণত খুব ভোরে ভারী ব্যাগ নিয়ে বিদ্যালয়ে ছুটে চলাতে অনেক শিশুই আগ্রহী হয় না। বিদ্যালয়ের প্রতি শিশুরা তেমন টানও অনুভব করে না। বিদ্যালয়ও অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু নালন্দার শিশুদের ক্ষেত্রে এটি প্রায় উল্টো। প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে নিজে থেকেই তারা তৈরি হয়ে নেয়। বিদ্যালয় তার আনন্দের জায়গা। একদিন সেখানে না গেলে শিশুরা বাড়িতে মুখ ভার করে বসে থাকে। কেন? কারণ বিদ্যালয় শিশুর জন্য সে পরিবেশ ও তার আস্থার জায়গাটি তৈরি করতে পেরেছে।
কেমন তাদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যকার সম্পর্ক? নালন্দা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের তুমি বলে সম্বোধন করে। টিচার বা স্যার নয়, শিশুরা শিক্ষকদের আপুমণি বা ভাইয়া বলে ডাকে। শিক্ষকরাই তাদের সত্যিকারের বন্ধু, তাদের আস্থার জায়গা। যে কথা সে বাবা-মাকে বলে না, অনেক ক্ষেত্রে সে কথাই শিশুরা অকপটে শেয়ার করে আপুমণিদের সঙ্গে। এখানে শিশুদের শাসনের নামে নির্যাতন ঘটে না। কিন্তু তবুও শিশুরা শিখছে দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা, মানবিকতা ও অন্যকে মানার বা সম্মান করার বিষয়গুলো।
কিন্তু সারা দেশের বিদ্যালয়গুলোর চিত্র কি নালন্দার মতো? উত্তরটি অবশ্যই ‘না’। শাসনের নামে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চলছে এখনো। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সংবাদগুলোতে চোখ পড়লে আমরা ব্যথিত হই। শিক্ষকদের আচরণে লজ্জিতও হতে হয় কখনো কখনো। কিছুদিন আগের কথা। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের গুপ্টি পূর্ব ইউনিয়নের শ্রীকালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রুটিন অনুযায়ী বাড়ির কাজ জমা না দেওয়ায় শাস্তি স্বরূপ পাচ শিক্ষার্থীকে তার নিজের থুতু খেতে বাধ্য করেছেন। এভাবে অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের শাসনে অপমানিত হয়ে আত্মহনের পথও বেছে নিয়েছে। সে সংবাদগুলো প্রকাশিত হয় সংবাদ মাধ্যমে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে শিক্ষকের মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে সুমাইয়া আক্তার মালিহা নামে এক শিক্ষার্থী। একই বছরের ডিসেম্বরে ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীও আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাব মতে, বাংলাদেশে ২০১৭ সালের প্রথম ১০ মাসে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে দুই হাজারের বেশি শিশু। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ২ হাজার ১৯৭ এবং ২০১৩ সালে ১ হাজার ১১৩ ছিল। আরেকটি বেসরকারি গবেষণার তথ্য বলছে, বিশ্বে ২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রায় ১০০ কোটি শিশু তাদের বাড়িতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। এর ফলে শিশুর স্বাস্থ্যের ক্ষতিসহ মানসিক বিপর্যয় ঘটছে। যা প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত করছে শিশুর বিকাশকে। শিশু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন শিক্ষার ক্ষেত্রে শিশুদের শিক্ষার সুষ্ঠু ও ভয়হীন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিদ্যালয়ে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি শিশুকে হীনমন্য করে তুলে। ফলে সে মনোবল হারায়। তাই এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে বিদ্যালয়গুলোকেই।
বিদ্যালয়ে শিশু নির্যাতন বিষয়ে সরকারের আইন ও পরিষ্কার নীতিমালা রয়েছে। ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি। হাইকোর্ট এক রায়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়ার নামে নির্যাতনকে সংবিধান পরিপন্থী বলে উল্লেখ করে। কেননা সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেসব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। ৩১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না, কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না
তাই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ১১ ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। ২০১৬ সালে এ বিষয়ে আরও একটি পরিপত্র জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে নির্দেশ অমান্যকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১৮৬০, ১৯৭৪ সালের শিশু আইন বিধি মোতাবেক বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে কতজনের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটি আমাদের জানা নেই। এ বিষয়ে সরকারি মনিটরিং ব্যবস্থাও জোরদার করার প্রয়োজন রয়েছে।
আবার শিশু আইন ২০১৩-এর নবম অধ্যায়ে ধারা ৭০ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি তার দায়িত্বে থাকা শিশুর প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা করেন যে, ওই শিশুর শারীরিক, মানসিক ক্ষতি হয় তবে ওই ব্যক্তির সর্বোচ্চ ৫ বছর জেল এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানা হবে। কিন্তু সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও আইন থাকা সত্ত্বেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে শাসনের নামে শিক্ষার্থী নির্যাতন চলছেই। শিক্ষক সমিতির ক্ষমতার দাপট, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব ও বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নমনীয়তা ও উদাসীনতার কারণে তৃণমূলের বিদ্যালয়গুলোতে এ নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। পাশাপাশি এ বিষয়ে অভিভাবকরাও নানা কারণে প্রতিবাদ বা অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকেন। ফলে শিশুরা মুখ বুঝে নির্যাতন সহ্য করে। যা তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করছে।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯-এর অনুচ্ছেদ ১৯ অনুযায়ী ‘সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকে শিশুকে রক্ষা করতে হবে।’ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ১৬.২ লক্ষ্যমাত্রায় শিশুর প্রতি সব ধরনের শারীরিক সহিংসতা বন্ধের কথা বলা হয়েছে। ওই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০-এর মধ্যে সব রাষ্ট্রকে এটি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে এটি নিশ্চিত করতে হলে প্রচলিত আইন সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি এ বিষয়ে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।
উন্নত দেশের স্বপ্ন নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। এ দেশে বিদ্যালয়ে শাসনের নামে নির্যাতন চলবেএটি মেনে নেওয়া যায় না। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলোকে শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সরকারের আইন প্রয়োগ ও মনিটরিং ব্যবস্থাও জোরদার করতে হবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে অভয়েরএমনটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
ছবি: নালন্দা বিদ্যালয়ের অপলা-ভবন। বিদ্যালয়ের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১ মার্চ ২০২০
© 2020, https:.