কলাম

যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু

স্বাধীনতা লাভের পরের বাংলাদেশের কথা বলছি। তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সর্বত্র ছিল ধ্বংসলীলার ক্ষতচিহ্ন। নাগরিকদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অভাব ছিল প্রকট। কলকারখানায় উৎপাদন শূন্যের কোঠায়, যোগাযোগব্যবস্থা পুরোপুরি ভঙ্গুর। এক কোটি শরণার্থীও ফিরে এসেছে ভারত থেকে। ফলে সমস্যা ছিল অগণিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত এমন দেশের পুনর্গঠনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশে কমপক্ষে পঞ্চাশ লাখ মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাবে, দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ- বিশ্বের প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞদের ধারণাটি ছিল এমন। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। অসংখ্য বাধা মোকাবিলা করে সাফল্য পাওয়ার যে সক্ষমতা এ দেশের মানুষের রয়েছে, এ সত্যটি বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তার শক্তির মূল উৎস ছিল জনগণের প্রতি প্রবল বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধু হাত বাড়ালেই তিনি ধরে ফেলতেন বাঙালির আশা, বাঙালির ভাষা আর বাঙালির কষ্টগুলোকে। বাঙালির দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, স্বপ্ন, সাহস নিজের মধ্যে ধারণ করতেন। কী করে বাঙালির ভাষা ও স্বপ্নকে এক সুতায় গাঁথা যায়, এ শক্তিও ছিল বঙ্গবন্ধুর মধ্যে।

বাঙালিকে সত্যিকারভাবে চিনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন (২১৪ পৃষ্ঠা) ঠিক এভাবে- ‘প্রকৃতির সাথে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ওই রকমই নরম, ওই রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালোবাসি।’

দেশ গড়তে বাংলার সেসব মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ২৬ মার্চ ১৯৭২-এ বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানের ভাষণে তিনি বলেন, ‘আজ আমি যখন আমার সোনার বাংলার দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই যুদ্ধবিধ্বস্ত ধূসর পাণ্ডু জমিন। ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, ক্ষুধার্ত শিশু, বিবস্ত্র নারী আর হাতাশাগ্রস্ত পুরুষ। আমি শুনতে পাই সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ, নির্যাতিতা নারীর ক্রন্দন, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ফরিয়াদ। আমাদের স্বাধীনতা যদি তাদের আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ধার করে এদের মুখে হাসি ফোটাতে না পারে, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে তুলে দিতে না পারে একমুঠো অন্ন, মুছে দিতে না পারে মায়ের অশ্রু ও বোনের বেদনা, তাহলে সেই স্বাধীনতা বৃথা, সে আত্মত্যাগ বৃথা… আসুন, আজ আমরা এই শপথগ্রহণ করি-বিধ্বস্তমুক্ত বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলব।’ এরও আগে ১৬ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ভবনে এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন ঠিক এভাবে- ‘যারা রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা দিয়ে গেল, তারা মরে নাই। তাদের আত্মা বেঁচে আছে। তারা দেখবে, তাদের আত্মা দেখবে যে, বাংলার মানুষ সুখে বাস করছে কিনা, বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত খাচ্ছে কিনা, বাংলার মানুষ শান্তিতে বাস করছে কিনা। ওদের আত্মা সেদিন শান্তি পাবে, যেদিন আপনারা পেটভরে ভাত খাবেন, গায়ে আপনাদের কাপড় হবে, থাকার বন্দোবস্ত হবে, বেকার সমস্যা দূর হবে। সেদিনই আমি সত্যিকারের স্বাধীন বাংলার নাগরিক হিসেবে দাবি করতে পারব, এর আগে আমার দাবি করার অধিকার নেই…।’

দেশের প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রজাতন্ত্রের যে সংবিধান প্রস্তুত করা হয়, সেখানেও বঙ্গবন্ধুর অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির দর্শনের প্রতিফলন মেলে। সমৃদ্ধির পথে দেশকে এগিয়ে নিতে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। ফলে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার অনেকটাই বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলেন।

কেমন দেশ চেয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব? সেটি অনুমান করা যায় তার নানা বক্তব্য বিশ্লেষণে। ৫ এপ্রিল ১৯৭২-এ ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস মাঠে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘…আমি চাই আমার বাংলার মানুষ বাঁচুক। আমার বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত খাক। আমার বাংলার মানুষ শান্তি পাক। আমার বাংলার মানুষেরা মিথ্যাবাদী না হোক। আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমার বাংলার মানুষ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করুক…।’ আাবার স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতেও তিনি বলেন, ‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই- যে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। ক্ষেত-খামার, কল-কারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন, সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি- যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।’ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সোনার বাংলা গড়াই ছিল বঙ্গবন্ধুর দর্শন। দুর্নীতিবাজদের বঙ্গবন্ধু ‘চোরা’ বলে সম্বধোন করে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় দেওয়া তার ভাষণই এর অকাট্য প্রমাণ। ১৯ জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পর্যালোচনা করলেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার মনোভাব স্পষ্ট হয়। ওইদিন বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেন, ‘এখনো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোরি বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে দিয়েছে। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি। চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি। কিন্তু আর না… নিশ্চয়ই ইনশাআল্লাহ পারব এই বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতিবাজ, এই ঘুষখোর, এই মুনাফাখোরি, এই চোরাচালানদের নির্মূল করতে। আমি প্রতিজ্ঞা নিয়েছি। তোমরা প্রতিজ্ঞা নাও। বাংলার জনগণ প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করো।… জিনিসের দাম গুদামজাত করে মানুষকে না খাইয়ে মারে- উৎখাত করতে হবে বাংলার বুকের থেকে এদের।’

বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। সরকারি চাকরিজীবীদের জনগণের সেবক উল্লেখ করে জনগণকে ভালোবাসার নির্দেশ দিয়ে ওইদিন তিনি বলেছিলেন, ‘মনে রেখো, জনগণ কারা- তোমার বাপ, তোমার ভাই। তোমাদের মায়না আসে কোত্থেকে আসে? সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী যারা এখানে আছেন, তাদের সবার বেতন আসে বাংলার দুঃখী মানুষের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে। তোমরা তাদের মালিক নও। তোমরা তাদের সেবক। তাদের অর্থে তোমাদের সংসার চলবে। তাদের শ্রদ্ধা করতে শিখো। তাদের ভালোবাসতে শিখো…।’

সোনার বাংলা গড়তে প্রয়োজন সোনার মানুষের। তখন এটিও বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তো লেখাপড়া করে মনুষ্যত্ব নির্ভর সত্যিকারের মানুষ হওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ৮ মার্চ ১৯৭৫ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ভাষণে তিনি বলেন- ‘…আপনাদের মনে রাখা দরকার যে, আমরা মানুষ পয়দা করব। নিজে যদি অমানুষ হই তো মানুষ পয়দা করব কী করে? আর দুঃখ হয় আমার এই জন্য যে, বাংলার কৃষক ঘুষখোর বা দুর্নীতিবাজ নয়। বাংলার মজদুর আমার দুর্নীতিবাজ নয়। আর আমরা শতকরা পাঁচজন লোক শিক্ষিত। আমরাই হলাম সব থেকে বেশি দুর্নীতিবাজ। … আজ তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ, ভাই, আপনারা কাজ যদি না করেন, আমার পক্ষে সম্ভব না ভাই। শেখ মুজিবুরকে বাইটা খাওয়ালেও সোনার বাংলা হবে না। সোনার বাংলা করতে পারব না- যদি সোনার মানুষ আপনারা আমাকে না পয়দা করে দেন।’

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের বহু সংখ্যক সদস্যসহ হত্যা করা হয়। ফলে থেমে যায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের সম্ভাবনাময় অভিযাত্রা। তার অবর্তমানে দেশ চলতে শুরু করে ঠিক উল্টোপথে। এখন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আবার সঠিক পথে চলছে। পিতার মতো তিনিও পুরো পৃথিবীর সামনে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে হাজির করতে সক্ষম হয়েছেন। আজও বঙ্গবন্ধু আমাদের চেতনার জায়গা থেকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছেন। জন্মশতবার্ষিকীর দিনে তারই দর্শনের পথে চলার শপথ নিতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণাসহ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে কাজ করে যেতে হবে সবাইকে। তবেই সার্থক হবে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আমাদের সময়ের বিশেষ সংখ্যায় , প্রকাশকাল: ১৭ মার্চ ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button