মুক্তিযোদ্ধা আলিউজ্জামান। ইয়াকুব আলী শেখ ও সাহেরা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান। বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার (সাবেক ফরিপুর জেলা) কোটালিপাড়া উপজেলার ধরাল গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ধরাল প্রাইমারি স্কুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন একুশ বা বাইশ বছরের যুবক। যুদ্ধ করেছেন আট নম্বর সেক্টরে, হেমায়েত বাহিনীতে। অপারেশন করেন ঘাগোর, কালকিনি, কালিন্দি, কোটালিপাড়া ও বাঁশবাইরা প্রভৃতি এলাকায়। ঘাগোরে এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া গুলিতে তিনি রক্তাক্ত হন। গুলিটি তাঁর ঘাড় দিয়ে ঢুকে ডান চোখের রগ ছিড়ে দুটি দাঁত ও চোয়াল ভেঙে বেরিয়ে যায়। ফলে ডান চোখটি সারাজীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারায়।
আলিউজ্জামানের বাবা কৃষি কাজ করতেন। জমি-জমা ছিল খুব কম। তাদের বিলের জমি। সে জমিতে ফসল হতো না। বন্যার পানিতে তলিযে যেত জমির ধান। ফলে জীবন চালানো কষ্টকর ছিল। দুপুরে খেলে বিকেলে খাবার মিলত না। মা মারা যাওয়ার পর আলিউজ্জামানের বাবা আবার বিয়ে করেন। তখন তার লেখাপড়ায় মন বসে না। স্কুল কামাই দিয়ে ‘ডেংবাড়ি’ (ডাংগুলি) খেলতেন। বাবা রাগ করতেন। ফলে ফাইভের পরই বন্ধ হয় তার স্কুলে যাওয়া। বাবার সঙ্গেই কাজে যেতেন তিনি। কাজ ছিল জমিতে ধান নিড়ানী, বন বাছা, ঝরা বাছা প্রভৃতি। এভাবে কষ্ট করেই কেটে যাচ্ছিল আলিউজ্জামানের জীবন।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে পাল্টে যেতে থাকে তার জীবনপ্রবাহ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখার প্রথম ঘটনাটি আলিউজ্জামান বলেন ঠিক এভাবে-
“আমাদের ওখানে এক লোক ছিল খালেক জাইরা নাম। তাগো খুব ক্ষমতা। তারা মুসলিম লীগ করত। গ্রামে আমগো পছন্দের মানুষ ছিল শেখ আব্দুল আজিজ। উনি একদিন বললেন- এক নেতা আসতে লাগছে। শেখ মুজিবুর রহমান কইত তহন। কত মাইনসে কয় মুজিবর। আওয়ামী লীগের। তোরা আওয়ামী লীগ করবি।
আমরা বললাম- করমু।
উনি তহন বলেন- এতো সুন্দর ভাষণ দেয় তা বলার মতো না।
আমি কই- তায় আমগো কোটালিপাড়া আইসবে।
– হ্যাঁ আইসবে।
শেখ মুজিব একবার খবর পাঠায় আসবে। উনি স্পিডবোটে আসছে। ঘাগোর বাজারের ঘাটলায় আমরা অপেক্ষায়। ছিলেন শেখ আব্দুল আজিজ, গফুর, মুজিবুল হকসহ মেলা নেতারা।
কোটালিপাড়ার কাছে কুরপাড়া, পুনাতি, গোপালপুর এলাকা। ওইদিককার মানুষ ছিল মুসলিম লীগের পক্ষে। তারা বলতেছে- না, আমাগো ওতো বড় নেতা লাগবো না। মুসলিম লীগই ভাল।
শেখ মুজিব ওইদিকে গেলেন না।
আমি খুব শয়তানি করতাম। দূর থিকাই চেচাইয়া বলি- আপনি আইসেন। আপনি আমাগো বাবা, আইসেন। আমরা থাকতে কেউ বগলে আইতে পারবো না।
স্পিড বোট থাইকাই আমারে দেখছেন। উনি আইসা ফার্স্টেই আমার মাথায় হাতটা দিছে। এরপর থিকাই শেখ মুজিবরে বাবা ডাকতাম।
ঘাগোর ডাকবাংলাতে উনি বসলেন। ওইখানেই মিটিং করা হইল। উনি এরপর মাঝেমধ্যে আসতেন। মিটিং করতেন। উনি আসলেই আজিজ সাহেব, মুজিবুল ও গফুরদের বলতো মানুষকে মিস্টি খাওয়াইতে।
একজনের নাম ছিল সেকেন্দার। বাবার খুব ভক্ত। বাবায় (শেখ মুজিব) মরার পরে উনি শোকে পাগল হইয়া যায়। পাগল অবস্থায় দুই তিন বছর ছিল। এরপরই মারা গেছে। বাবার জন্য পাগল এরকম কিছু লোক নিয়া ঘাগোর থেকে কোটালিপড়ায় যাইতাম মিটিং করতে। বাবায় যতডা মিটিং করছে একটা মিটিংয়েও আমি বাদ নাই। প্রত্যেকটা মিটিংয়ে থাকতাম। আব্বা কিছু কইত না। উনিও মুজিবের পক্ষে। মাইনসের কাছে কইত- শেখ মুজিব যদি আইসে তয় আমার আলিউজ্জামান সেখানে আছেই। ও কেমবায় জানে আল্লাহই জানে।
আমার কোন চাওয়া-পাওয়া আছিল না। ওটাই ছিল আমার রাজনীতি।”
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একদিনের ঘটনা তুলে ধরেন আলিউজ্জামান। তাঁর ভাষায়- “বাবায় (শেখ মুজিব) একটা পাইপে সিগারেট খাইতো। খুব ঘ্রাণ হইত। উনি ডাকবাংলায় একটা খাটে শুইত। ‘আইসো’ বলে আমারে ডাকত। আমি খাটের কান্দায় গিয়া বসতাম। একদিন উনি পরসাব খানায় গেছে। উনার পাইক থাইকা খুব ঘ্রাণ আইছে। আমি ওইটা হাতে নিয়া ঘ্রাণ শুকি। উনি বাইরে এসেই তাকান। আমি বলি- জন্মের মতো ঘ্রাণ আইছে বাবা।
শুনে বাবায় খুব হাসেন। আমাদের উনি অন্যরকম ভালবাসতেন।”
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আনসার ট্রেনিং নেন আলিউজ্জামান। উনি একদিন ডেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন- “বাবারে তোমরা আমার যে যে আছো আনসার ট্রেনিংয়ে যাও। এই দেশে বাঁচতে হলে আনসার ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন আছে।”
১৯৭০ সালের শেষ দিকের কথা। গোপালপুরের নায়েক, পশ্চিমপাড়া থেকে ট্রেনিংয়ে যায় আরও কয়জন। তখন গোপালগঞ্জ স্টেডিয়ামে হতো ট্রেনিং। বিয়াল্লিশ দিন ট্রেনিং চলে। একবার ফায়ারে ফাস্ট হন আলিউজ্জামান। ওই ট্রেনিংই পরে কাজে লাগে মুক্তিযুদ্ধে।
আনসার ট্রেনিং তখনও শেষ হয়নি। নির্দেশ আসে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পোড়াতে যেতে হবে আনসারদের। আলিউজ্জামান তখন কৌশলে লুকিয়ে থাকে। ওইদিনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “ট্রেনিংয়ের ভেতরেই ঘটনা। পাকিস্তানিগো নির্দেশ, আনসার গো যাইতে হবে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পোড়াইতে, গোপালগঞ্জ। এ কথা শুনাই বুকটা কামড়ায়া ধরে। আমরা দুইজন লোক যাই নাই। লাকড়ির পেছনে লুকায়া থাকি। ছোটো সাহেব তখন অ্যাডজুটেন্ট। নাম আনোয়ার কাজী। বরিশাল বাড়ি। উনি বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়। আমরা তো আর চিনি না। উনি বুঝতে পারলেন। ডেকে বলেন- ওই তোরা বঙ্গবন্ধুর লোক পরে উনিই আমগো লুকায়া রাখেন। এরপরই তো যুদ্ধ শুরু হইয়া যায়।
স্বাধীনতা লাভের পর ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলিউজ্জামান এসেছিলেন ঢাকায়, বঙ্গবন্ধুর কাছে। তখনও তার মুখ ফোলা। এক চোখ নষ্ট। চেনার উপায় নেই। সহযোদ্ধারা তাকে সামনে রেখে বলে- নেতা দেখেন, গুলি কোথা দিয়ে ঢুকে কোথা দিয়ে বের হইছে।
বঙ্গবন্ধু তাকিয়ে তার সামনে যান। চিনে ফেলেন তাকে। চোখের জলে জড়িয়ে ধরে বলেন- ধরালের আলিউজ্জামান না তুই।
একটা ভিজিটিং কার্ড হাতে দিয়ে বলেছিলেন- “মনা, এই কার্ড কেউ পায় নাই। তুই কোটালিপাড়ায় আগে পাইছস। পরে দেখা করিস।”
নানা কষ্টে পরিবার চললেও বাবার (শেখ মুজিব) কাছে আর যাওয়া হয় না আলিউজ্জামান। কেটে যায় কয়েক বছর। একবার নায়েক আর আজিজুলের সঙ্গে দিনক্ষণ ঠিক করেন। ওই কার্ড নিয়া দেখা করবেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। কিন্তু আগেরদিন বিকেল বেলায় রাজাকার মকবুল আসে বাড়িতে। তামাশা করে বলে- তোমাগো মুজিব, ফুট্টুস। কুখ্যাত মুজিব।
শুনে আলিমুজ্জামান মুষড়ে পরেন। প্রতিবাদ করে বলেন- আমার বাবা কুখ্যাত না। তুমি অন্য শেখ মুজিবের কথা শুনছো। আমার বাবায় মরে নাই।
উনি দৌড়ে যান আজিজের বাড়িতে। গিয়ে দেখেন সেও কাঁদছে। পরে নায়েকের বাড়িতে গিয়েই আলিউজ্জামান ‘বাবা’র জন্য বেহুঁশ হয়ে পড়েন।
মুক্তিযোদ্ধা আলিউজ্জামানের বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। নানা রোগে ভুগছেন তিনি। তবুও বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তার কাছে আজও জীবন্ত হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, পেয়েছেন তার সান্নিধ্যও। বঙ্গবন্ধুর আলিঙ্গন, তার দেওয়া ভাষণ, তার নির্দেশনা ও স্বপ্নগুলোই আলিউজ্জামানের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আজও অনিবার্য প্রেরণা হয়ে আছে।
লাখো মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমেই আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। সে দেশে আলিউজ্জামানের মতো যোদ্ধারা হয়তো খুব বেশিদিন বেঁচে থাকবেন না। কিন্তু স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা পাবে, সেখানে অনিবার্য হয়ে উঠবে মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলা- এমনটাই চান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৩ মার্চ ২০২০
© 2020, https:.