বঙ্গবন্ধু, রেসকোর্স এবং বাঙালি
বাঙালি জাতির জীবনে রেসকোর্সের ময়দান অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চে রেসকোর্সের ময়দানেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন ‘…এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…’। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের এই ঘোষণাই সেদিন সাত কোটি বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভাব ঘটে বাংলাদেশের। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাঙালি জাতির স্বাধীনতা লাভ তখনো পূর্ণতা পায়নি। তার অপেক্ষায় থাকে সবাই। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের নেতা লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পা রাখেন তার জন্মভূমিতে। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে আসা লাখো মানুষ দেখে তিনি আবেগাপুত হন। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রেসকোর্স ময়দানে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ওই ময়দানে দাঁড়িয়েই আবার জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন অশ্রুসিক্ত নয়নে। এর দুদিন পরই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে নেন। অতঃপর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন দেশ ও বাঙালি জাতির জন্য।
বাঙালিদের কীভাবে দেখেছেন তিনি? তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এক জায়গায় (২১৪ পৃষ্ঠায়) তিনি লিখেছেন ঠিক এভাবে ‘প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালবাসি।’
বাঙালির চরিত্রের নিখুঁত ব্যাখ্যাও করেছেন আরেক জায়গায় (৪৭ পৃষ্ঠায়) “আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আর একটা হলো আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষাতেই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। …যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যত দিন চিনবে না এবং বুঝবে না, তত দিন এদের মুক্তি আসবে না।” বাঙালিদের নিয়ে এর চেয়ে খাঁটি মূল্যায়ন আর কী হতে পারে!
এই বাঙালিদের জন্যই বঙ্গবন্ধুর বুকে ছিল গভীর ভালোবাসা। নির্বাচনের সময় একবার হেঁটে হেঁটে প্রচারণার কাজ চালাচ্ছেন, তখন এক হতদরিদ্র বৃদ্ধ মহিলার সঙ্গে দেখা। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য কয়েক ঘণ্টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন, তাকে ধরে নিজের কুঁড়েঘরে নিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান আর চার আনা পয়সা দিয়েছেন, বলেছেন, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছু নেই।’
এ ঘটনা তার মনে দাগ কাটে। সেই দিনের অনুভূতি বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছেন (২৫৬ পৃষ্ঠায়) এভাবে ‘নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।’ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তার এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেননি। তিনি বাংলার মানুষকে কত গভীরভাবে ভালোবাসতেন সেটি তার প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। একবার এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘What is your qualification?’। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘I love my people’। ওই সাংবাদিক সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘What is your disqualification?’। বঙ্গবন্ধু শান্তকণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘I love them too much’।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, গাজী গোলাম মোস্তফা ও অন্যান্য নেতাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বাড়ির নিচের লাইব্রেরি রুমে বসেছিলেন। সেদিন সবার চোখে-মুখে ছিল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ছাপ। কিন্তু তিনি সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ এবং নির্দেশ দিয়ে এক এক করে বিদায় দেন। সবাই তাকে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। এ নিয়ে সাংবাদিকদের পরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার জনগণকে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল। আমি যদি সেখানে না থাকতাম, তবে আমার খোঁজে ইয়াহিয়া খান পুরো শহর জ্বালিয়ে দিত।’ ওই রাতে তারা তাকে মেরে ফেলতেও পারত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন, একটি দেশের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা পালিয়ে যেতে পারে না। সে রাতে এত উত্তেজনার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু শান্তভাবে পাইপ টানছিলেন।
‘কায়হান ইন্টারন্যাশনাল’ পত্রিকার সাংবাদিক আমির তাহেরি একাত্তরের জুলাই মাস নাগাদ জেনারেল টিক্কা খানকে প্রশ্ন করেছিলেন ‘তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শেখ মুজিবও যদি ভারতে যেতেন, তবে সে ক্ষেত্রে আপনি কী করতেন স্যার?’ উত্তরে টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘আমি খুব ভালো করে জানি মুজিবের মতো একজন নেতা তার জনগণকে পরিত্যাগ করবে না। আমি পুরো ঢাকা শহরে তাকে খুঁজে বেড়াতাম এবং একটি বাড়িও তল্লাশির বাইরে রাখতাম না। তাজউদ্দীন অথবা তার মতো অন্য নেতাদের গ্রেপ্তারের কোনো অভিপ্রায় আমার ছিল না। সে কারণেই তারা এত সহজে ঢাকা ছেড়ে যেতে পেরেছিলেন। জেনারেল টিক্কার এই উক্তি থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে, বঙ্গবন্ধুই পাকিস্তানিদের চিন্তার প্রধান কারণ ছিলেন। ওই রাতে তারা বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেসব শঙ্কা নিয়ে চিন্তা করেননি। তিনি একা পাকিস্তান নামক রক্তপিপাসু সামরিক জান্তার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন শুধুই দেশের মানুষের কথা। বাঙালির জন্য জাতির জনকের দায়িত্ববোধ, সর্বোচ্চ ত্যাগ এবং ঝুঁকি নেওয়ার অসম সাহস ছিল তার।
কেমন দেশ চেয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব? সেটি অনুমান করা যায় তার নানা বক্তব্য বিশ্লেষণে। স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতে তিনি বলেছিলেন ‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। ক্ষেত-খামার, কলকারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি, যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।’
১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়কালকে দেশব্যাপী ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনের স্বপ্ন ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় এমন কোনো বিষয় নেই, যা তিনি স্পর্শহীন রেখেছেন। তাই বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, এই মহান নেতাকে তুলে ধরতে হবে সর্বজনীনভাবে। জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজন যেন লোকদেখানো উৎসব না হয়। চাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, উদ্যোগ ও দর্শনের নানা কথা ছড়িয়ে দেওয়া হোক প্রজন্মের মধ্যে। প্রজন্মের দিশারি হোক বঙ্গবন্ধু।
ছবি: অনলাইন থেকে সংগৃহীত
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৭ মার্চ ২০২০
© 2020, https:.