মানুষের পাশে থাকতে হবে মানুষকেই
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গোটা বিশ্ব আজ হিমশিম খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে ১ লাখ লাশের ব্যাগ দিচ্ছে পেন্টাগন। সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে দুই লাখ ১৫ হাজার ৮৬ জন। প্রাণ গেছে পাঁচ হাজার ১১০ জনের। যার মধ্যে বাঙালি রয়েছে পঞ্চাশের ওপরে। নিউইয়র্কের বিভিন্ন হাসপাতাল মরদেহ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই হাসপাতাল ও লাশঘরের জন্য দেওয়া হবে ব্যাগগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ ধারণা করছে করোনা আক্রান্ত হয়ে লক্ষাধিক লোক মারা যাবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ খবরটিতে চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা খামচে ধরে।
নিউইয়র্কে বসবাসরত কয়েকজন বন্ধুর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি। ছড়াকার ও উপস্থাপক বন্ধু মৃদুল আহমেদ সপরিবারে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। গম্ভীর মুখে সে শুধু বলল ‘এখনো সুস্থ আছি। পরের খবর জানি না দোস্ত।’ অনিশ্চিত জীবনের কথা উল্লেখ করে আরেক বন্ধু বলেন ‘আমরা এক মৃত্যুপুরীতে আটকে আছি। ঘুম থেকে উঠেই অপেক্ষায় থাকি কার মৃত্যুর সংবাদ শুনব আজ। পরিচিতরা মরছে চারপাশে। পরিবারের কেউ তার কাছে যেতেও পারে না। দূর থেকেই শেষবারের মতো বিদায় দিচ্ছে প্রিয় মানুষটিকে। এমন মৃত্যু কি আমরা চেয়েছিলাম? আমরা কি তাহলে হেরে যাচ্ছি বন্ধু?
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশেও চলছে লকডাউন। ফলে শ্রমজীবী নিম্নআয়ের মানুষগুলো পড়েছে বিপাকে। প্রতিদিন নানা জনের অসংখ্য সংবাদের লিংক ফেইসবুকের ইনবক্সে জমা হচ্ছে। সবগুলোই করোনাকেন্দ্রিক। ভেতরে ভেতরে মানুষ আতঙ্কিত, অসহায়ও।
যখন লিখছি বাংলাদেশে তখন করোনায় আক্রান্ত ৭০ জন আর মৃত্যুবরণ করেছে ৮ জন। উন্নত দেশগুলোতে এত বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের সরকারি হিসাবে কেন আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু এত কম? এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে নেতিবাচক নানা খবর ও গুজবের ছড়াছড়ি। আবার কেউ কেউ অধিক সতর্কতায় চ্যানেলগুলোতে একই খবর শুনছেন প্রায় সারা দিন ধরে। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ঘুরছে সারা বিশ্বের মৃত্যুর খবরগুলো। এতে মানুষ ডিপ্রেসড হচ্ছে। মনে তৈরি হচ্ছে অনিশ্চিত জীবনবোধ। যা তার মানসিক শক্তিকে দুর্বল করে ফেলছে।
বৃহস্পতিবার মক্কা ও মদিনায় ২৪ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়েছে। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া সেখানে বন্ধ। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে শুক্রবারের জুমার নামাজ পড়া ঠেকাতে তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়। দক্ষিণ দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকায় তাবলিগ জামাতের মূল কেন্দ্রের একটি ভবন থেকে দুই হাজার ৩০০ জনকে সরিয়ে রাখা হয়েছে কোয়ারেন্টাইনে। ‘মারকায নিজামুদ্দিন’ নামের তাবলিগ জামাত থেকে ফেরার পর নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণে কাশ্মীরের শ্রীনগরে একজন ও পরে তেলেঙ্গানায় আরও ছয় জনের মৃত্যু হয়। ফলে ওই জমায়েতে যারা যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সবাইকে খুঁজে বের করতে রাজ্যগুলোকে নির্দেশ দেয় ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
অধিকাংশ মুসলিম দেশে জুমার নামাজসহ মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশে তা বেশ শিথিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এখন করোনা সংক্রমিত হবে কমিউনিটি পর্যায়ে। ফলে করোনা আক্রান্তদের মসজিদে যাওয়ার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে এদেশে। ইসলামিক দলগুলোর চাপের মুখে সরকার এ বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেও সংক্রমণ ব্যাপক হারে ঘটলে তার দায় সরকারও এড়াতে পারবে না বলে মনে করেন অনেকেই।
এসব নিয়ে আলাপ হয় এক বন্ধুর সঙ্গে। তার মত ‘সরকার যা-ই বলুক না কেন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আমাদের ঘুরে দাঁড়াবার সক্ষমতা খুব ক্ষীণ!’ তাহলে কি আমরা মেনে নিয়েই মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাব। মরার আগেই কি মরব আমরা?
এমন অনিশ্চয়তা ছিল একাত্তরেও। তবুও মুক্তিযোদ্ধারা ঘর ছেড়েছিলেন দেশের টানে। মরতে গিয়েই তারা ফিরে এসেছিলেন। যুদ্ধ করেছেন জীবন বাজি রেখে। কারণ তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন শুধুই স্বাধীনতার। করোনার বিরুদ্ধে তাই আমাদের যুদ্ধটি ঘরে থাকার। সমাজে সবার মধ্যে ‘শারীরিক দূরত্ব’ বজায় রেখে ভাইরাসকে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মাঝে ছড়াতে না দেওয়ার। তাই শুধু নিরাশা নয়, মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার আশাও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এমন চিন্তা থেকেই কাজ করছেন অনেকেই। তারা কারা?
ফেইসবুক গ্রুপ থেকেই আত্মপ্রকাশ ‘করোনায় তারুণ্য’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের। লকডাউনের সময়ে বাড়িতে বসা মানুষের সমস্যা শুনতে তারা হটলাইন ও ওয়েবসাইট খুলেছেন। কারও জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তাদের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকরা পরামর্শ করে তাকে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় ওষুধ, হাসপাতালসেবা কীভাবে পাবেন, ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতালের ব্যবস্থাও করছেন তারা। সারা দেশেই কাজ করছেন এ সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা।
‘বিদ্যানন্দ’ নামক সংগঠনটি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় ঢাকা মহানগরীর শ্রমজীবী মানুষ ও শিশুদের মাঝে সাধ্যমতো খাবার বিতরণ করছে। ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন টিম’ নামের ব্যানারে নারায়ণগঞ্জে কিছু উদ্যমী যুবক সকাল থেকে রাত অবধি বেশ কয়েকটি মহল্লা, ব্যাংকের বুথ, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, খাবারের দোকানে ‘ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স মার্কিং’ আর জীবাণুনাশক ছিটানোর কাজ করছে। স্বল্প আয়ের মানুষদের মধ্যে হ্যান্ডওয়াশ বিতরণ এবং দুইশ টাকা আয়ে নির্ভরশীল পরিবারকে টানা দুই মাস জরুরি খাদ্য বিনামূল্যে দেওয়ার উদ্যোগও নিয়েছে তারা। ফেইসবুকে ‘কিছু করতে চাই’ নামে একটি পেজের মাধ্যমে রাজশাহীতেও কাজ করছেন বেশ কিছু তরুণ। কিন্তু এ সময়ে দেশের ইসলামিক দল ও সংগঠনগুলোর মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কোনো উদ্যোগের খবর আমরা পাইনি তেমন।
করোনার কারণে কাজ না পেয়ে অসহায় হয়ে পড়া ৫০০ ছিন্নমূল ও দুস্থ মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরা বিভাগ। নিজেদের রেশন এবং বেতনের অর্থের মাধ্যমে এই খাবারের ব্যবস্থা করেছেন তারা। কয়েক জেলায় কিছু শ্রমজীবী মানুষের খাওয়ার দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছেন পুলিশ সুপার ও ডিসিরা। এক মুক্তিযোদ্ধা তার জমানো এক লক্ষ টাকা দান করেছেন খেটেখাওয়া দরিদ্রদের জন্য। হজে যাওয়ার টাকাও দান করছেন কেউ কেউ। সারা দেশেই পাড়া-মহল্লার তরুণ ও যুবকরা উদ্যোগ নিচ্ছে সাধ্যমতো দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। কাজ করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলোও। এমন অসংখ্য উদ্যোগের খবর উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। এসব কার্যক্রম যেন ‘নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব’ নিশ্চিত করে পরিচালিত হয় সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশনাটিও স্পষ্ট করতে হবে।
নানা উদ্যোগের ফলে এখন গ্রামের সাধারণ মানুষের ভেতরও মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। প্রয়োজন শুধু ঘরে থেকে দূরত্বটা নিশ্চিত করা। করোনাপরবর্তী অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় মানুষের পাশে থাকতে হবে মানুষকেই। ভয় নয়, ছড়িয়ে দিতে হবে সাহসের সংবাদগুলোকে। তবেই মানুষ জাগবে। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বোধ যত বাড়বে ততই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৫ এপ্রিল ২০২০
#koronabangladesh #salekkhokonthought #covid19
© 2020, https:.