লকডাউনে আদিবাসী গ্রামগুলোতে খাদ্য সংকট
‘কড়া’ নামে একটি জাতি রয়েছে বাংলাদেশে। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার হালজায় মৌজার ঝিনাইকুড়ি গ্রামে এদের ২৪টি পরিবারের বাস। লোকসংখ্যা ৮৫ জনের মতো। যার মধ্যে শিশুদের সংখ্যা ত্রিশ। দিনাজপুরের বৈরাগীপাড়ায় একটি ও ঘুঘুডাংগার খাড়িপাড়ায়ও রয়েছে এ জাতির আরও দুই পরিবার। এ ছাড়া গোটা দেশে আর কোথাও নেই কড়ারা। এক সময় দিনাজপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এদের একাধিক গ্রাম ছিল। মূলত ভূমিকেন্দ্রিক অত্যাচারে টিকতে না পেরে বিভিন্ন সময়ে এরা চলে যায় সীমান্তের ওপারে, ভারতে। ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের দুমকা, গোড্ডা, পাকুর, শাহীবগঞ্জ, হাজারিবাগ প্রভৃতি অঞ্চলে এখনও কড়া আদিবাসীদের একাধিক গ্রাম রয়েছে।
এদেশে টিকে থাকা কড়াদের একমাত্র গ্রাম ঝিনাইকুড়িতেই। গোত্র প্রধানের (তাদের ভাষায় মাহাতো) নাম জগেন কড়া। জাতির নামকরণ নিয়ে তিনি মনে করেন, ‘কড়া’ মানে মাটি খোঁড়া। কোনো এক সময় এদের পূর্বপুরুষরা দিঘি খোঁড়ার কাজে যুক্ত ছিলেন। সে থেকেই তাদের নামকরণ হয়েছে ‘কড়া’। ইংরেজ আমলে সারা ভারতজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বসেছে রেললাইন। পাহাড় কেটে, মাটি খুঁড়ে সেই রেললাইন বসানোর কাজে ঘাম ঝরিয়েছে এই আদিবাসীরাই। মূলত রেললাইনের কাজের সূত্র ধরেই ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্য থেকে এদের আগমন ঘটে এ অঞ্চলে।
এ আদিবাসী গ্রামে যাওয়া-আসা ও যোগাযোগ এক যুগেরও অধিক সময় ধরে। নিজেদের কর্মভাগ্য সুপ্রসন্নের জন্য কড়ারা প্রতি ভাদ্রে কারমা উৎসব পালন করে ধুমধামের সঙ্গে। তবুও ভাগ্য দেবতার সুদৃষ্টি পড়েনি তাদের ওপর। সময়ের হাওয়ায় দেশ চলে উন্নয়নের পথে। কিন্তু কড়াদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না এতটুকুও। ভূমিকেন্দ্রিক দখল, নানা অবহেলা আর অনটনের মধ্যেই নিজেদের টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আসছে কড়া আদিবাসীরা।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এ সময়টাতে কেমন আছে নিশ্চিহ্ন প্রায় কড়া জাতির মানুষেরা? অন্যান্য আদিবাসীদের অবস্থাইবা কেমন? সেটি জানাতেই এই লেখার অবতারণা।
ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর পাশাপাশি বড় ধরণের অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হচ্ছে গোটা দেশকে। সরকার নানা শ্রেণির জন্য প্রণোদনারও ঘোষণা দিয়েছে। এ সময় শ্রমজীবী মানুষের পাশে থাকতে নানা সহযোগিতার কথাও তুলে ধরেছেন সরকার প্রধান। কিন্তু সেইসব সহযোগিতা থেকে প্রায় বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী গ্রামগুলোর মানুষেরা।
লকডাউন সারাদেশে। ফলে করোনাভাইরাস থেকে নিজেকে সুরক্ষা ও অন্যের মাঝে যেন ছড়িয়ে না পড়ে – সে বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সীমান্তবর্তী গ্রাম হওয়াতে সচেতনতার সে কার্যক্রম খুব ভালভাবে পৌঁছায়নি কড়া গ্রামে। লোকমুখে যতটুকু তারা জেনেছে তাও যথার্থ নয়। হাত ধোয়ার সচেতনতা তৈরি হলেও দূরত্ব বজায় রেখে চলার বিষয়টিতে সর্তক নয় তারা। করোনাভাইরাস নিয়ে তেমন ভয় নেই তাদের। বরং কর্মহীন থাকার ভয়ই এদের দুশ্চিন্তার একমাত্র কারণ এখন।
কাজ না থাকলে দুইবেলা খাবারও জোটে না এই আদিবাসীদের। তাই লকডাউনের এ সময়টাতে তাদের নির্ভরতা বনের জংলি আলুর ওপর। পাশ্ববর্তী কালিয়াগঞ্জ শালবন থেকে দলবেধে এরা সংগ্রহ করে আনে সেই আলু। বিশেষ পদ্ধতিতে তা সেদ্ধ করে খাচ্ছে পরিবার নিয়ে।
কড়াদের সমাজে নারী-পুরুষ উভয়েই কাজ করেন। কৃষি এদের প্রধান পেশা। ফসল লাগানো বা কাটার সময়টাতে এ অঞ্চলে পাইট বা শ্রমিক হিসেবে আদিবাসীদের কদর যায় বেড়ে। কেননা কাজে ফাঁকি না দেওয়া ও অধিক পরিশ্রম করে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করাই এদের ধর্ম। কাজের ক্ষেত্রে এমন সততা মেলে না বাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে। ফলে এখানকার মহাজন ও জমিওয়ালাদের শেষ ভরসা আদিবাসীদের ওপর। তবুও বিপদের দিনে মহাজনেরা নিঃস্বার্থভাবে তাদের পাশে দাঁড়ায় না।
লকডাউনের এ সময়টাতে কাজ নেই কড়াসহ অন্যান্য আদিবাসীদের। ফলে কড়া গ্রামে তৈরি হয়ে খাদ্য সংকট। নেই কোনো সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতাও। তাহলে কীভাবে বাঁচবে কড়াদের পরিবারগুলো?
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকার যখন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা ও ব্যাংকের সব ধরণের ঋণের সুদ ও বিলম্ব ফি মওকুফ করার ঘোষণা দিয়েছে তখন আদিবাসীরা জড়িয়ে পড়ছেন মহাজনদের চড়া সুদের ঋণের জালে। এখানকার মহাজন ও জমিওয়ালাদের কাছে বাধ্য হয়ে আগাম শ্রম বিক্রি করছে কড়াসহ অন্যান্য আদিবাসীরাও। এ যুগে যা চিন্তাও করা যায় না।
যখন লিখছি তখন কড়া গ্রামের কাটমার কড়া, সুনিয়া কড়া, কেদু কড়া, অঞ্জন কড়া, বাবু কড়া, কাইচাল কড়াসহ পনের পরিবার আগাম শ্রম বিক্রি বাবদ পরিবার প্রতি এক বা দুই হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন স্থানীয় মহাজন ও জমিওয়ালাদের কাছ থেকে। খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সেই টাকা দিয়ে চাল ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে এনেছে তারা। দুইবেলা খেয়ে জীবন বাঁচাতে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তাদের। ফলে আদিবাসীদের এমন দুঃসময়ের সুযোগ নিচ্ছে স্থানীয় মহাজন ও জমিওয়ালারা।
কীভাবে পরিশোধ হবে ঋণের টাকা? মাসখানেক পরেই শুরু হবে ভুট্টা ভাঙা ও ধান কাটার কাজ। সে সময়টাতে শ্রমিকের দৈনিক ভাতা থাকবে ৩০০-৫০০টাকা। কিন্তু কড়ারা ওই মজুরি তখন পাবেন না। ওইসময় মহাজন বা জমিওয়ালাদের জমিতে তাদের ১৫০ টাকা রেটে কাজ করে কর্জ পরিশোধ করতে হবে। ফলে প্রকৃত মজুরি থেকে এরা বঞ্চিত হবেন। যা ভয়ানক শ্রমশোষণও। এ সময়টাতে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা মিললে আদিবাসীরা আগাম শ্রম বিক্রির মতো অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারতেন।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ৩৮টি আদিবাসী জাতির প্রায় ১৫ লাখ মানুষের বসবাস। যাদের মধ্যে সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, মাহাতো, মালো, ভুনজার, মাহালি, মুষহর, তুরি, কোচ, লোহার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব জাতিসত্তার ৯০ শতাংশ মানুষই ভূমিহীন। যাদের জীবন চলে দিনমজুরির টাকায়। ফলে চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে তারা হয়ে পড়েছে কর্মহীন। এসব অঞ্চলেও আদিবাসীরা মহাজনদের নিকট থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে খাদ্য সংকট মোকাবেলা করছে। কিন্তু এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে এরা নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে পড়বে।
গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে, গাইবান্ধায় প্রায় ১২০০ সাঁওতাল পরিবার ও রাজশাহীতে দুই হাজার সাঁওতাল, পাহাড়িয়া ও ওঁরাও পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। করোনাভাইরাস আতঙ্কে তারা কর্মহীন এবং প্রশাসনের কাছ থেকেও কোনো ধরনের সাহায্য পাচ্ছেন না। শেরপুরের নালিতাবাড়ী, ময়মনসিংহের ধোবাউড়া, নেত্রকোনার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা ও সুনামগঞ্জের মধ্যনগর ও তাহিরপুর থানার হাজং ও বানাই গ্রামের শতাধিক পরিবারেও দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। একই অবস্থা টাঙ্গাইলের মধুপুর ও রাজশাহী বিভাগে বসবাসরত আদিবাসীদের। এছাড়া সিলেটের আদিবাসী চা শ্রমিকেরা খাদ্য সংকট ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালিঘাট ইউনিয়নের ৩৫টি গারো পরিবারের দুই শতাধিক দরিদ্র মানুষ চরম দুর্ভোগে জীবন কাটাচ্ছেন। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের চাকমা, তনচংগ্যা, রাখাইন এবং চাঁদপুরের ত্রিপুরা ও খুলনা-সাতক্ষীরার আদিবাসী গ্রামগুলোতেও চলছে খাদ্য সংকট।
ব্যতিক্রম নয় পাহাড়েও। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের বেশিরভাগ দুর্গম এলাকায় পৌঁছায়নি কোনো খাদ্য সহযোগিতা। ওইসব এলাকায় জুমচাষের মৌসুমে চরম খাদ্য সংকট থাকে। তার ওপর গত দুই মাস ধরে তারা লড়াই করছেন হামের সঙ্গে। হামে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে সাজেকের ৮ শিশু। বর্তমানে চলছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাবও। এতে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে সাজেকের অসহায় খেটে খাওয়া দুস্থ মানুষেরা। গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অবস্থাও বেশ নাজুক।
সমতল ও পাহাড়সহ গোটা দেশে আদিবাসী মানুষের সংখ্যা ৪০ লাখেরও অধিক। যারা অধিকাংশই দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ। স্বাভাবিক নিয়মে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ সহায়তার তালিকায় আদিবাসীদের নাম থাকে খুবই অল্প সংখ্যক। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশেষ উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক ও দরিদ্র আদিবাসীদের গ্রামগুলোতে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনেরও বিশেষ দৃষ্টি রাখা উচিত।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে আদিবাসীদের সহযোগিতায় একটি প্রকল্প চালু রয়েছে। সরকার চাইলে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের জন্য খাদ্য সহযোগিতার কর্মসূচি চালু করতে পারে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করবেন – এমনটাই আমরা আশা করি।
আবার যে সকল বেসরকারি সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করছেন। তাদেরও উচিত দুর্যোগের এ সময়টাতে আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানো। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোও এগিয়ে আসতে পারে মানবিক সহায়তা নিয়ে।
করোনাভাইরাসের এ দুর্যোগ মোকাবিলা করা শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসতে হবে সকলকেই। অর্থনৈতিক ঝুঁকি লাঘব করতে সম্মিলিতভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতি নির্বিশেষে কাজ করতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বোধ যত বাড়বে ততই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। তাই মানুষের পাশে থাকতে হবে মানুষকেই।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৮ এপ্রিল ২০২০
© 2020, https:.