ক্রেডিট কার্ডের নির্দেশনা ও ব্যাংকারদের সুরক্ষা
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সারা দেশে বেড়েছে লকডাউনের সময়সীমা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশে এখন কমিউনিটির ভেতরে বিভিনড়ব ক্লাস্টার বা পুঞ্জ থেকে ছড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষ ঘরে না থাকলে কিংবা ব্যক্তির নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করতে না পারলে এটি মহামারীতে রূপ নেবে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যুর শঙ্কার মধ্যেই দেশের অর্থনীতি পড়ছে বড় ধরনের ঝুঁকিতে। কয়েকদিন আগে দৈনিক দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোতে সাধারণ অ্যাকাউন্টধারীদের সঞ্চয়ের পরিমাণের একটি হিসাব তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে ৭ কোটি ৫২ লাখ ৯৪ হাজার ৪৫১টি অ্যাকাউন্টে জমা আছে ৫ হাজার টাকারও কম। অন্য কোথাও জমানো টাকা না থাকলে বা আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হলে পরিবারের এক সপ্তাহের চাল- ডালও কিনতে পারবেন না তারা। এমনকি করোনাভাইরাস বা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হলে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে দূরের কোনো হাসপাতালে যাওয়া কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে গিয়ে ডাক্তার দেখানোর খরচ মেটানোও তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। প্রতিটি অ্যাকাউন্টে গড়ে টাকা রয়েছে মাত্র ৬১০। যা দিয়ে চার সদস্যের পরিবারের সাত দিনের চাল, ডাল, তেল, লবণসহ অতি জরুরি খাদ্যপণ্য কেনা সম্ভব নয়।
করোনাভাইরাসের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশজুড়ে শুরু হওয়া ‘লকডাউনে’ কর্ম হারিয়ে আয়হীন হয়ে পড়ছেন অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রায় ৫ কোটি মানুষ। সাধারণ খেটে খাওয়া থেকে শুরু করে নির্মাণ শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ বিভিনড়ব খাতে জড়িত এসব মানুষ কার্যত আয়হীন হয়ে পড়ছে। সরকার ও বেসরকারি পর্যায় থেকে যারা ত্রাণ বা সহায়তা পাচ্ছে, তাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হলেও, যারা কোনো সহায়তা পাচ্ছে না, তাদের তিন বেলা খাবার জোগানোও প্রায় অসম্ভব।
ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারী উল্লিখিত গ্রুপটির কেউ কেউ সরকারি সুবিধার তালিকায় থাকলেও বিরাট একটি অংশ রয়েছে এসব তালিকার বাইরে। আবার অনেকেই নানা কারণে স্বেচ্ছায় সহযোগিতার কথাও বলতে পারবে না। তাহলে তারা কীভাবে এই দুর্যোগে টিকে থাকবে?
আবার ব্যাংকে অ্যাকউন্টধারীদের একটি বড় অংশ ক্রেডিট কার্ডের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমান বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ছিল ১৫ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪৮ জন। বিশেষ করে শহর অঞ্চলে কার্ডধারীর সংখ্যা বেশি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যারা দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করছে কার্ডের মাধ্যমে। যা মূলত ঋণ। এই সব ক্রেডিট কার্ডধারীদের কী সুবিধা প্রদান করা হবে তা স্পষ্ট করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৪ এপ্রিল জারিকৃত সার্কুলারে বলা হয়েছে এম ‘করোনাভাইরাসের ভয়াবহ বিস্তারের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকদের পক্ষে প্রদেয় বিল নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। এমতাবস্থায়, ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের আর্থিক সামর্থ্য ও চলমান অন্যান্য সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে যেসব ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের বকেয়া বিল পরিশোধের শেষ তারিখ ১৫ মার্চ বা তার পরে, সেসব ক্ষেত্রে গ্রাহক প্রদেয় বিল নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করার ক্ষেত্রে কোনো বিলম্ব ফি, চার্জ, দণ্ড-সুদ, অতিরিক্ত মুনাফা, বা অন্য কোনো ফি বা চার্জ (যে নামেই অভিহিত হোক না কেন) আদায় না করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হলো। এছাড়া ১৫ মার্চ থেকে ইতিমধ্যে কোনো ক্রেডিট কার্ড বিল বিলম্বে পরিশোধজনিত কারণে বিলম্ব ফি, চার্জ, দণ্ড সুদ, অতিরিক্ত মুনাফা, বা অন্য কোনো ফি বা চার্জ (যে নামেই অভিহিত হোক না কেন) আদায় করা হয়ে থাকলে তা সংশ্লিষ্ট ক্রেডিট কার্ড গ্রাহককে ফেরত প্রদান অথবা পরবর্তী সময়ে প্রদেয় বিলের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এই নির্দেশনা ১৫ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।’
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ ব্যাংকগুলো তাদের ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের যে ভাষায় মেসেজ পাঠাচ্ছে তাতে শুধুমাত্র বিলম্ব ফি মওকুফের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। কিন্তু বিভিন্ন চার্জ, দণ্ডসুদ, অতিরিক্ত মুনাফা বা অন্য কোনো ফি বা চার্জ (যে নামেই অভিহিত হোক না কেন) মওকুফ হবে কি না ব্যাংকগুলো সেটি এখনো কার্ডধারীদের নিশ্চিত করেনি। গ্রাহকদের ব্যাংকের প্রতি আস্থাশীল রাখতে এটি স্পষ্ট করা জরুরি।
এখন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন, সরকারি নানা সুবিধার ভাতাসহ অন্যান্য প্রয়োজনে সরকারি চারটি ব্যাংকে ভিড় বেশি হচ্ছে। মাসের শুরুতে বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকেও গ্রাহকদের চাপ রয়েছে। ব্যাংকে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আসে। তাদের মধ্যে কেউ ভাইরাস বহন করলে সেটা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে টাকার স্পর্শ মাধ্যমেও ছড়াতে পারে করোনাভাইরাস। তাই করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যাংকের শাখা, উপশাখা ও এজেন্ট পয়েন্টের পাশাপাশি এটিএম বুথগুলো নিয়মিতভাবে জীবাণুমুক্ত করা এবং সেখানে হান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকারদের ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। ইতিমধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ায় ঢাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখা লকডাউন ও ওই শাখার সবাইকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, অফিস-আদালত, যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলেও মানুষকে লেনদেনের প্রয়োজনে ব্যাংকে যেতে হচ্ছে তাদের। সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ব্যাংককর্মীদেরও যাতায়াতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক শাখায় ভিড় করা গ্রাহকরাও সামাজিক দূরত্বের নিয়মগুলোও ঠিকভাবে মানছেন না। ফলে তাতে বাড়ছে অস্বস্তিও। তাই সময়ক্ষেপণ না করে ব্যাংকারদের সুরক্ষার বিষয়টি সরকারকে এখনই গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথের সংখ্যা ১০ হাজার ৯৬১টি। আর সিডিএম ও সিআরএম মেশিন রয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ৪০৮টি ও ২৫৮টি। এছাড়া সারা দেশে পস মেশিনের সংখ্যা ৬০ হাজার ৪৭৪টি। অন্যদিকে, জানুয়ারি পর্যন্ত ডেবিট কার্ডের গ্রাহক ১ কোটি ৮৬ লাখ ১১ হাজার ৬৮১ জন আর প্রি-পেইড কার্ডের গ্রাহক ৪ লাখ ২৮ হাজার ৯১০ জন। এছাড়া নগদ অর্থ উত্তোলনে দেশে এটিএম বুথের ব্যবহার বাড়লেও হাতে গোনা কয়েকটি বাদে বেশিরভাগ ব্যাংকের এটিএম বুথে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। নেই কোনো জীবাণুনাশক উপকরণও। ফলে বুথ ব্যবহারকারী গ্রাহক ও বুথগুলোর নিরাপত্তাকর্মীদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
করোনা যুদ্ধে ব্যস্ত গোটা বিশ্ব। নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও মুখে মাস্ক পরার পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়ে দূরত্ব বজায় রেখে চলাটা এখন বিশেষ প্রয়োজন। প্রয়োজনেই আপনি ব্যাংকে যাবেন। তবে সেটি যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে হয় সেটির দিকে সবাইকেই আন্তরিক হতে হবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৬ এপ্রিল ২০২০
© 2020, https:.