আদিবাসী

পাখির সঙ্গে লড়াই

আদিবাসী লোককথা 

ভাদ্র মাস। তাল পাকানো গরম। চারপাশে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বারকয়েক ঘাম গোসল দিয়ে গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকেই।

গ্রামটি বেশ ছায়াঘেরা। নাম? কালিয়াগঞ্জ। দিনাজপুর জেলায় গ্রামটি। পাশেই গহিন সবুজ শালবন। ব্রিটিশ আমলের। দূর থেকে তা ছবির মতো দেখায়। বহুকাল আগে গোটা গ্রামটিই ছিল গহীন জঙ্গলে। তখন হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হতো এখানকার আদিবাসীদের।

গোত্রভেদে এখানে বাস করছে মুন্ডা, ওঁরাও, ভুনজার, সাঁওতাল, তুরি, মাহালী ও কড়া আদিবাসীরা। আজও এদের সংগ্রাম চলছে। তবে সেটি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। নানা প্রতিকূলতায় এরা টিকিয়ে রেখেছে পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতিটাকে।

আদিবাসী লোককথার খোঁজে পায়ের ছাপ পড়ে এখানকার সাঁওতাল পাড়াটিতে। কথা হয় বাঠু সরেন ও সানজিলা হাজদার সঙ্গে। সানজিলা খুব আগ্রহ নিয়ে শুরু করেন সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত একটি লোককথা। যার ভাবার্থ এমন-

অনেক কাল আগের কথা। এক গাঁয়ে বাস করত সাত ভাই। তারা ছিল খুব শিকারপ্রিয়। একদিন তারা শিকারে রওনা হয় দূরদেশে, জঙ্গল ঘেরা এক পাহাড়ে। সেই পাহাড়ে ছিল বিরাট আকারের একটি হিংস্র পাখির বাস। পাখিটির নাম গরুড় পাখি। তার ভয়ে বনের অন্য প্রাণীরাও ওমুখো হতো না।

দূর থেকে সাত ভাইকে দেখতে পায় ওই পাখিটি। এগিয়ে এলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সে। সাত ভাইও তীর-ধনুক নিয়ে তৈরি। কিন্তু কোন সুযোগ না দিয়েই পাখিটি ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর। প্রাণপণ যুদ্ধ করেও তারা পেরে উঠে না পাখিটির সঙ্গে। একে একে সাত ভাইয়েরই জীবন যায় পাখির হিংস্র থাবায়।

এ খবর পৌঁছায় না সাত ভাইয়ের গ্রামে। সবাই অপেক্ষায় থাকে আশা নিয়ে। বীরের বেশে শিকার থেকে ফিরবে তারা। কিন্তু সে অপেক্ষার সময় যেন শেষই হয় না। দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর, বছর থেকে যুগ কেটে যায়। তবুও সাত ভাই ফিরে আসে না।

ভাইদের মধ্যে সংসারী ছিলেন বড় ভাইটি। তার ছিল এক পুত্রসন্তান। দিনে দিনে সে বড় হয়। ছোটবেলা থেকেই বাবার মতোই সাহসী সে। শিকারে যেমন তার সাহস তেমনি সে দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে।

যুবক বয়সে একদিন সে মায়ের কাছে জানতে চায় বাপ-চাচাদের কথা। মা জানায়, শিকারে গিয়ে তারা আর ফিরে আসেনি। জঙ্গল ঘেরা ওই পাহাড়ে থাকে বিরাট গরুড় পাখি। সেই পাখিটি শিকার করতে গিয়েছিল তারা। তার আক্রমণে তারা বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে আজও কেউ জানে না!

এ কথা শুনেই ছেলেটি মনে মনে শপথ নেয়। যেভাবেই হোক হিংস্র পাখিটিকে শিকার করে আনতেই হবে। জানতে হবে তার বাবা-চাচাদের সন্ধান। একদিন সে তীর-ধনুক নিয়ে রওনা হয় দূরদেশের জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ের দিকে।

গহীন জঙ্গল আর দুর্গম পথ পেরিয়ে কয়েক দিন চলতে থাকে সে। এভাবে চলে আসে পাহাড়ের সেই স্থানে, যেখানে তার বাবা-চাচাদের হত্যা করা হয়েছিল। দূর থেকে তাকে দেখেও হিংস্র গরুড় পাখিটি রাগে টগবগ করতে থাকে। ছেলেটি হঠাৎ দেখল, তার দিকে ধেয়ে আসছে ওই পাখিটি। সে তখনই তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুত হয়ে নেয়। কাছে আসতেই পাখিটির বুকে ধনুক বিদ্ধ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বিরাট পাখিটি হুমড়ি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। খানিক ছটফট করেই সে মারা যায়।

হিংস্র পাখিটি তো মারা গেল। কিন্তু ছেলেটির বাবা-চাচারা কোথায়? সে খুঁজতে থাকলো তাদের। দেখতে পেলো মাটিতে পড়ে আছে সাতটি নরকঙ্কাল। সেগুলো দেখেই সে বুঝে গেল, এগুলো তার বাবা ও চাচাদের কঙ্কাল। তা দেখে আবেগে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

তার কান্নার শব্দ শুনে সন্ন্যাসীর বেশে আসমান থেকে নেমে আসেন দেবতা মারাংবুরু। ছেলেটিকে তিনি শান্ত করলেন। এরপর শুনলেন তার সব কথা। সব শুনে তার মায়া হলো। তিনি ছেলেটির হাতে একটি জলভর্তি ঘটি আর কিছু মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েই আবার আসমানে মিলিয়ে গেলেন।

ছেলেটি তখন কঙ্কালগুলো কাপড়ে ঢেকে, মন্ত্র পড়ে তাতে ঘটির পানি ছিটিয়ে দিলো। আর অমনি কঙ্কালগুলো জীবিত হয়ে মানুষে রূপ নিল। সবাই আড়মোড়া দিয়ে উঠে বলল, অনেকক্ষণ খুব ভালো ঘুমালাম। যুবক ছেলেটিকে দেখে তারা তো অবাক! তার পরিচয় পেয়ে আর সব ঘটনা শুনে সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়।

হারিয়ে যাওয়া বাবা-চাচাদের নিয়ে বীরের বেশে বাড়ি ফিরে যুবক ছেলেটি। ভালোবাসার টানেই তাদের ফিরে পেয়েছিল সে। আর তাকে পথ দেখিয়েছিলো তারই মনোবল ও সাহস।

অলঙ্করণ: সমর মজুমদার

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ২৮ এপ্রিল ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button