কলাম

লকডাউনে নারী ও শিশু নির্যাতন

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ক্রমেই বাড়ছে ‘লকডাউন’-এর মেয়াদ। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেকে সুরক্ষার আহ্বান জানানো হচ্ছে বারবার। ফলে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মানুষই এখন ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে কাটছে মানুষের সময়? ঘরে থাকা মানুষের প্রাত্যহিক রুটিন পাল্টে যাচ্ছে। নারী-পুরুষ নানা পদ রান্নার কৌশলটা রপ্ত করার চেষ্টা করছে, ঘরের কাজে নারীর সহায়ক হয়ে পাশে থাকছে অনেক পুরুষ। কেউ কেউ আবার ডুবে থাকছে সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজ ফিড ও ইউটিউব চ্যানেলগুলোতে। ফলে রাতের ঘুম ভোরে, আবার অনেকের ভোর হচ্ছে দুপুরে। কোনো কাজে নেই কোনো তাড়া, নেই কোনো ব্যস্ততাও। সময় পার করাটাই যেন বড় দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুরা আটকে আছে ঘরে। স্কুলে যাওয়া বন্ধ। বন্ধুদের সঙ্গে ছোটাছুটি আর খেলাধুলা সবই প্রায় বন্ধ। বাইরে বেরুতে মানা। তাই শিশুর মনোজগতে ঘটছে নীরব যুদ্ধ। লকডাউনের কারণে ক্রমেই বাড়ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের ভবিষ্যৎ শঙ্কাটি। তৈরি হচ্ছে অনিশ্চিত জীবনবোধের।

তবে এটি গোটা দেশের পুরো চিত্র নয়। এর উল্টো চিত্রও রয়েছে। সবার দৃষ্টি যখন করোনার দিকে তখন প্রায় নীরবেই বেড়ে যাচ্ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের সংখ্যা। যেসব পরিবারে স্বামীরা যে কোনো অজুহাতে বৌকে মারধর করেন, সবাই ঘরে থাকায় সেসব পরিবারে নির্যাতনকারী স্বামী এখন নির্যাতনের আরও নতুন নতুন ছুঁতো খুঁজে পাচ্ছেন। বর্তমান এই কঠিন সময়ে এ ধরনের পুরুষদের কাছে স্ত্রীরা হয়ে উঠছেন তাদের রাগ দেখানোর সহজ জায়গা। লকডাউনে ওই পরিবারগুলোতে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে শিশুদের সামনেই। যা শিশুর মনোজগতে বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে, বাধাগ্রস্ত করছে তার মানসিক বিকাশকেও।  লকডাউনের এ সময়ে ঘরে আবদ্ধ অনেক পুরুষই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে হতাশাগ্রস্ত ও চিন্তিত হয়ে পড়ছেন। ফলে বাড়ছে তাদের মানসিক চাপও। নিজেকে হালকা করার কৌশল হিসেবে কারও কারও সব চাপ ও ক্ষোভ গিয়ে পড়ছে ঘরে থাকা নারী ও শিশুটির ওপর। এভাবেই বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের পরিমাণ।

সম্প্রতি মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে শুধু এপ্রিল মাসেই দেশে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪ হাজার ২৪৯ নারী। যার মধ্যে প্রথমবারের মতো নির্যাতিত ১ হাজার ৬৭২জন। তাদের মধ্যে ৮৪৮ জন শারীরিক নির্যাতন, প্রায় ২ হাজার নারী মানসিক নির্যাতন ও ১ হাজার ৩০৮ জন অর্থনৈতিক নির্যাতন (খাদ্য ও অর্থাভাব) এবং ৮৫ জন যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এছাড়া পরিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪২৪ শিশুও। এ জরিপের ফল আমাদের সমাজের এক দুর্বিষহ চিত্রকে সামনে নিয়ে এলো। করোনার দুর্যোগের মধ্যে এ ধরনের সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউন দিয়েছে বিশ্বের বহু দেশ। ফলে পরিবারের মধ্যে একই রকম নির্যাতন বেড়েছে অন্যান্য দেশেও। এ সময় ঘরের ভেতর যারা যৌন নির্যাতনের মুখে পড়ছেন তারা এই মহামারীর নীরব শিকার বলে উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। কেননা সাধারণ সময়ে এসব নির্যাতন থেকে বাঁচতে যারা বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা পেতেন বা সাহায্য নিতেন সেরকম নারীদের জন্য এখন কঠিন সময়। কারণ লকডাউনে থাকায় তারা না যেতে পারছেন বাইরে বা বাইরে থেকে তাদের সাহায্য করতে আসতেও পারছে না সংস্থাগুলো। ব্রিটেনে নির্যাতনের ঘটনা রিপোর্ট করার জন্য যে হটলাইনের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে ৬৫ শতাংশ বেশি টেলিফোন কল এসেছে বলে জানিয়েছে সরকার। প্রতিবেশী দেশ ভারতে লকডাউন শুরুর প্রথম ১১ দিনের মধ্যে ফোনে অন্তত ৩ লাখ ৭ হাজার নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। যার মধ্যে ৯২ হাজার ১০৫টি ঘটনাই শিশু নির্যাতনের। আবার ইউএনএফপিএ পরিচালিত বৈশ্বিক সমীক্ষা বলছে, কভিড-১৯ মহামারীতে বিশ্বব্যাপী গৃহ নির্যাতন বেড়েছে ২০ শতাংশ।

এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছে জাতিসংঘও। তারা বলছে দরিদ্র দেশগুলোতে ছোট ঘরের মধ্যে যারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তাদের পক্ষে এসব অত্যাচার নির্যাতনের কথা বাইরে জানানোর সুযোগ এখন ক্রমেই সীমিত হয়ে পড়ছে। জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের নির্বাহী পরিচালকের মতে, উন্নয়নশীল বেশিরভাগ দেশেই আমেরিকা ও ব্রিটেনের মতো হটলাইনে সাহায্য চাইবার মতো ব্যবস্থা নেই বা থাকলেও তৃণমূলের অধিকাংশ নারীই তা জানেন না। ফলে এসব দেশে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে নির্যাতনকারীর অত্যাচারের প্রতিকার চাওয়া বর্তমান সময়ে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকেও। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য মতে, যে কোনো ধরনের সংকটে দুর্বল গ্রুপ হিসেবে নারী ও শিশুদের নির্যাতন এবং তাদের প্রতি অবহেলার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী চলা হোম কোয়ারেন্টাইনে নির্যাতনকারীদের হাতে বেশি নির্যাতিত হচ্ছে নারী ও শিশুরা। পরিবারগুলোর সবচেয়ে খারাপ সময়ে যখন অবিশ্বাস্য চাপ থাকে তখন এমন নির্যাতনের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঠিক এভাবে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে বিশ্বে মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। চলছে লকডাউন। সব মানুষ এখন ঘরে। মানুষ দীর্ঘ সময় কাছাকাছি অবস্থান করছে। বাড়ছে বেকারত্ব। ফলে বাড়ছে মানুষের উদ্বেগও। এসব কারণেও নারী ও শিশুরা ঘরে-বাইরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আবার এই সংকটময় অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোযোগ থাকছে অন্যদিকে। ফলে অপরাধীদের তৎপরতা যাচ্ছে বেড়ে। করোনাভাইরাসের এই সংকট যদি দীর্ঘ সময় থাকে, তবে সমাজে নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। তাই এখনই এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে, নিতে হবে দীর্ঘ পরিকল্পনাও।

এছাড়া লকডাউনের সময়ে যৌতুকের দাবিতেও নারীদের ওপর নির্যাতন বাড়ছে। ঘরে থাকা নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছে। আবার নির্যাতনের শিকার হয়েও অনেক ভুক্তভোগী ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না। ফলে নির্যাতনের খবর পৌঁছায় না প্রশাসনের কাছে। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই সমাধানের পথ তৈরি করতে হবে আমাদের। মাঠ প্রশাসনকে নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ে সক্রিয় রাখা এবং করোনা পরিস্থিতিতে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল ‘ভার্চুয়াল কোর্ট’-এর মাধ্যমে পরিচালনা করা যেতে পারে। পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে হটলাইন ১০৯ ও পুলিশি সহায়তার হটলাইন ৯৯৯ আরও কার্যকর ও সক্রিয় রাখা বিশেষ প্রয়োজন।

পাশাপাশি দরকার সামাজিক উদ্যোগেরও। নারীর প্রতি সম্মানের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে গণমাধ্যমগুলোও প্রচার কার্যক্রম হাতে নিতে পারে। ঘরের কাজ শুধু নারীরএমন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার চর্চার উপযুক্ত সময় এই করোনাকাল। লকডাউনের সময়টাতে সহধর্মিণীর পাশে থেকে পুরুষরা যদি বাড়ির নানা কাজে তাকে সহযোগিতা করেন তাতে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর হবে। বিশেষ করে পরিবারের শিশুটির মনে নারীর প্রতি পুরুষ সদস্যদের শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানোর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই চর্চা নারীবান্ধব সমাজ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

ছবি: সংগৃহীত

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৭ মে ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button