মুক্তিযুদ্ধ

২০২০-এর যুদ্ধটা হলো ঘরে থাকার

মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল মান্নান (বীরপ্রতীক)

বাবা ছিলেন পাকিস্তান আর্মিতে। ১৯৬১-তে উনি অবসর নেন, মেজর হিসেবে। তখন থেকেই থাকি ক্যান্টনমেন্টে, কচুক্ষেত এলাকায়। বাবা আমর্স অ্যামুনেশনের অফিসার ছিলেন। অবসরের পরও তাকে ক্যান্টনমেন্ট কম্বাইন্ড ওয়ার্কশপে ডাকা হতো নানা প্রয়োজনে। ফলে অধিকাংশ আর্মি অফিসারই ছিল তার চেনা।

ক্যান্টনমেন্ট এলাকাতেও পাকিস্তানি সেনারা অকারণেই ‘শালা বাঙালিকা বাচ্চা’ বলে গালি দিত। এটা শুনেছি ছোটবেলা থেকেই। সহ্য হতো না। ক্যান্টনমেন্টে পাবলিক বাস চলত। মহিলাদের জন্য সিটও নির্ধারিত ছিল। একবার মহিলা সিটের দুইপাশে দুই পাকিস্তানি সেনা বসা। এক মহিলা উঠলে তাকে বসতে বাধ্য করা হয় মাঝখানে। বাসের সবাই এর প্রতিবাদ করলে ওরা তেড়ে আসে। আদমজী কলেজের ঠিক উল্টোদিকে এসে থামে বাসটি। হট্টগোল শুনে আমি, বন্ধু সুলতান, ইউসুফ ফরাজি, মোস্তাফিজ প্রমুখ এগিয়ে যাই। ওই সেনাদের সঙ্গে হাতাহাতি হয় ওইদিন।

পাকিস্তানি সেনারা কচুক্ষেত বাজারে হোটেলে খেয়ে পয়সা দিত না। সিপাহি থেকে হাবিলদার পর্যন্ত মুরগি নিয়ে চলে যেত। খাসির মাংস নিয়ে টাকা দিত অর্ধেক। ভয়ে বাঙালিরাও কিছু বলত না। দলবেধে আমি এর প্রতিবাদ করতাম। ফলে ডিজিএফআই ও এমপি ইউনিটে আমার নামে কেস হয় তখনই। কয়েকবার ধরা পড়লেও ছাড়া পেয়ে যেতাম বাবার কারণে। তখন রাগ হয়ে বাবা বলতেন, ‘আর্মিতে যাও। আর্মি অফিসার হলেই তুমি এই পাকিস্তানি সিপাহিদের কন্ট্রোল করতে পারবা।’

একবার রাজি হয়ে যাই। আর্মি অফিসার নেওয়ার সার্কুলার হলে দাঁড়িয়ে গেলাম। ১৯৬৯ সালে আই গট কমিশনড। কিন্তু সিলেকশন পেয়েই মত পাল্টে ফেলি। যে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি, তাদেরই অফিসার হবো। ঠিক মেনে নিতে পারলাম না। সো ইট বেটার নট টু গো। ট্রেনিংয়ে যাই না। তাই ডিজিএফআই আমায় খুঁজতে থাকে। ফলে ইকবাল হল (বর্তমান জহিরুল হক হল) ও গ্রীন রোডে পরিচিতদের বাড়িতে লুকিয়ে থাকি কিছুদিন।

একাত্তর পূর্ববর্তী নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল মান্নান (বীরপ্রতীক)। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয় আমাদের।

প্রধানমন্ত্রীর নিকট হতে সম্মাননা নিচ্ছেন বীরপ্রতীক শেখ আব্দুল মান্নান

এম এল শেখ ও আমেনা বেগমের তৃতীয় সন্তান আব্দুল মান্নান। বাড়ি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষেত এলাকায়। তিনি ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৬৫ সালে। এরপর ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি হন তেজগাঁও কলেজে।

ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ তিনি করেন ঠিক এভাবে– ‘শেখ কামালও পড়ত শাহীন স্কুলে। আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল। তবে একসাথে ভলিবল, বাস্কেট বল ও ক্রিকেট খেলতাম। তার সঙ্গে প্রায়ই তার বাড়িতে যেতাম। তখনও জানতাম না শেখ মুজিব তার বাবা। বাসায় গেলে উনা বলতেন– কই যাবি রে তোরা?

শেখ মুজিবের স্মরণশক্তি ছিল অন্যরকম। একদিন দেখলাম আওয়ামী লীগের লোকজন আসছে কোন এক জেলা থেকে। উনি পাইপ টানতে টানতে হঠাৎ বলেন– ‘ওই, তুই করিম না? তোর বাড়ি পঞ্চগড় না।’ আমি ভাবি, এত লোকের মাঝে উনি নাম মনে রাখলেন কীভাবে! কাউকে আবার কাছে ডেকে নিয়ে পকেটে গুজে দিচ্ছেন ৫০-১০০ টাকা। গ্রাম-গঞ্জ থেকে যেই আসত লিডারের সঙ্গে দেখা করে যেত। মুজিবের কাছে যেতে তাদের ভয় হতো না। শেখ মুজিবের মতো সাধারণ মানুষ আর অসাধারণ স্মরণশক্তি এত বছরে আর একজনও পাইনি।

তেজগাঁও কলেজে গিয়ে যুক্ত হই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে। কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে তখন ছাত্রলীগের পুরা প্যানেল পাশ করে। শেখ কামালের মাধ্যমে শেখ মুজিব জানত আমি অ্যাকটিভ কর্মী। ক্রমেই তিনি আমায় কাছে টেনে নেন। পল্টন ময়দানে ছাত্রনেতাদের নানা মিটিং হতো তখন। সেটা শুনে নেতারা কে কি বলল তা রির্পোট করতাম শেখ মুজিবকে। যেকোনো সময় তার বাড়িতে যাওয়ার অনুমতিও ছিল আমার।

সত্তরের নির্বাচনে আদমজী কলেজ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ কর্মীদের ভোট দেওয়া নিয়ে মান্নানের সঙ্গে হাতাহাতি হয় এক পাকিস্তানি সেনার। ফলে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তার বাবা আন্ডার টেকিং দিয়ে ছাড়িয়ে আনেন। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহান করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ফলে সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। মান্নান তখন থাকেন ফার্মগেট এলাকায়। আন্দোলনে রাজপথে নামেন সাদু ভাই, বাধু ভাই, নুরুজ্জামান, মিলন, হুদা প্রমুখের সঙ্গে।

৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন রেসকোর্স ময়দানে। খুব কাছ থেকে ওই ভাষণ শোনেন আব্দুল মান্নান। তার ভাষায়– “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’–এই কথাটাতেই আবেগটা আবদ্ধ হয়। হোয়াট ডাজ ইট মিন। আমি মনে করি, এটাই স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু বললেন– ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি..’ তার মানে এটাই ফাইনাল হুকুম। এটাই স্বাধীনতার ফাইনাল অর্ডার।“

২০ মার্চের পরেই খবর আসে আর্মি নামার। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফার্মগেটে আর্মি মুভ করার তখন একটাই রাস্তা। মান্নানরা কাঠাল বাগান থেকে করাত সংগ্রহ করে রাখে গাছ কেটে ব্যারিকেড দিতে। আওলাদ হোসেন মার্কেট এলাকা থেকে বাঁশ আর ঠেলাগাড়ি দিয়ে বাধা সৃষ্টিরও পরিকল্পনা হয়।

২৫ মার্চ ১৯৭১। রাত তখন ৮টা। শালিমার হোটেলের সামনে গাছ কেটে ক্যান্টনমেন্টের রাস্তা ব্লক করেন তারা। ফার্মগেট পুলিশবক্স পর্যন্ত ব্যারিকেড দেওয়া হয় তিনটি। কারওয়ান বাজারেও ব্যারিকেড পড়ে। রাতেই একটি গ্রুপের সঙ্গে মান্নান চলে যান বুড়িগঙ্গার ওপারে। এর কয়েকদিন পরই তিনি অ্যারেস্ট হন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে।

কীভাবে?

সে ইতিহাস শুনি শেখ আব্দুল মান্নানের জবানিতে। তার ভাষায়– ‘কারফিউ উইথড্রো হলে জিনজিরায় আসি। সেখানেই দেখা হয় ধামালকোর্টের লতিফের সঙ্গে। জড়িয়ে ধরে সে বলে– ‘ক্যান্টনমেন্টের সিভিল এলাকা পুড়িয়ে দিছে ওরা। খোঁজ নেন আপনার বাপ-মা বেঁচে আছে কিনা।’ বুকের ভেতরটা তখন খামচে ধরে। সদরঘাট আসতেই দেখি রাস্তা রক্তে রক্তাক্ত। ফায়ার বিগ্রেডের হোজ পাইপে পানি দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করা হচ্ছে। দেখেই মনটা খারাপ হয়। এত বড় ম্যাসাকার করবে পাকিস্তানিরা! আমরা ধারণাও করতে পারিনি।

ভিডিও:  আমাকে তুলে নিয়েই ওরা ইলেক্ট্রিক শক দিতে থাকে

ফার্মগেট আসলাম। কয়েকজন বন্ধু বলল, ‘ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা ভাল না। ওইদিকে যাস না।’ কিন্তু আমার মন মানছে না।

২৯ মার্চ ১৯৭১। সকাল তখন ১১টা। ক্যান্টনমেন্টের গাড়ির জন্য ফার্মগেট পুলিশবক্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ একটা জিপ এসে থামে। সিভিল পোশাকে চারজন লোক নেমেই আমাকে তুলে নেয়। অ্যারেস্ট হয়ে গেলাম। ওরা ডিজিএফআই অফিসে নিয়েই আমাকে টর্চার চেয়ারে বসিয়ে দেয়।

মূলত মার্চের প্রথম দিক থেকেই গোয়েন্দারা ফলো করছিল। এক কলেজ থেকে গাড়িতে কয়েকটি অস্ত্র নিয়ে আমি ঢাকা কলেজে পৌঁছে দিয়েছিলাম। এ খবর ছিল তাদের কাছেও। ওরা বলে– ‘তুম গাড়ি ড্রাইভ করতাহে।’ বলি– না। শুনেই ক্ষিপ্ত হয় আর্মিরা। বলে– ‘মুজিব কা বাচ্চা। ঝুট বলতাহে।’

এরপরই শুরু হয় ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া। এমন কষ্ট পাই। মনে হচ্ছিল কলিজা বেরিয়ে যাবে। নড়ার চেষ্টা করলাম। চেয়ার তো নড়ে না। নিজেও নড়তে পারি না। পুরোদিন টর্চার করছে ওরা। দ্বিতীয় বার শক দেওয়ার পরেই অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান যখন ফিরে গলাটা তখন শুকিয়ে গেছে। পানি পানি বলে চিৎকার করি। পানিও দেয়নি ওরা।

ক্যান্টনমেন্টে তাহের লতিফ নামে এক পাঠান ক্যাপ্টেন ছিলেন বড় ভাইয়ের বন্ধু। তার সহযোগিতায় একদিন পরই বাবা আমাকে ছাড়িয়ে বাসায় নেন। হাঁটার শক্তি তখন ছিল না। ইলেক্ট্রিক শকে দুই হাতে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। বিছানাতেই ছিলাম বেশি কিছুদিন। কিন্তু মন তখনও ভাবছে দেশের কথা। পাকিস্তানি সেনাদের এ দেশ থেকে তাড়াতে হবে– এটাই ছিল তখন একমাত্র লক্ষ্য।’

ভিডিও: খালেদ মোশাররফ দেখেই বলে তুমি কেন আসছো?

মান্নান তখন সুস্থ। বাড়িতে তার বাবা নেই। কচুক্ষেত বাজারে তাদের দোকানে যাওয়ার ইচ্ছার কথা শুনে মাও নিষেধ করে না। কিন্তু মান্নান আর বাড়ি ফেরেন না। বাজার থেকেই বেবিট্যাক্সিতে চলে যান সদরঘাটে। সেখানে বন্ধু দুলালের সঙ্গে কুমিল্লার নবীনগর বর্ডার পার হয়ে চলে আসেন ভারতের কলেজটিলায়। ট্রেনিংয়ের জন্য সেখানেই নাম লেখান রিক্রুটিং ক্যাম্পে।

তার ভাষায়– ‘কলেজে থাকতেই ইউটিসি করতাম, সার্জেন্ট ছিলাম। স্টেনগান ও রাইফেল চালানো তখন থেকেই জানি। খালেদ মোশাররফ সাহেব বললেন– ‘তুমি প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের ওপর ট্রেনিং নাও। তাই করলাম। কলেজ টিলার ভেতরেই ছিল ট্রেনিং ক্যাম্প। ট্রেনিং তখনও শেষ হয়নি। আমরা কসবায় এক অপারেশনে অংশ নিই। পরে ঢাকায় যুদ্ধ করার ইচ্ছের কথা শুনে খালেদ মোশাররফ একটা চোতা (হাতে লেখা কাগজ) লিখে পাঠিয়ে দেন এ টি এম হায়দারের কাছে। এভাবে ১৫ জনের একটা গেরিলা দল নিয়ে বেরাইদ হয়ে আমরা ঢাকার ভেতরে ঢুকি। এরপরই গেরিলা অপারেশন করি গ্রীনরোড, ওয়াটার বোর্ডের অফিস, ক্রিসেন্ট রোডে নিউ মডেল স্কুলে (তখন সেখানে পাকিস্তানি মিলিশিয়া ক্যাম্প ছিল), লালাবাগ থানা আক্রমণ (থানা তখন ছিল সাইন্সল্যাবের পুলিশ বক্সের পাশে), সেন্ট্রাল রোডে এক বিহারী বাড়িসহ প্রভৃতি স্থানে।’

ঢাকায় গেরিলা অপারেশনে কি খুব বেশি ঝুঁকি ছিল?

‘অবশ্যই। তবে এর ইফেক্টটা বড় ছিল। বিশ্ব গণমাধ্যমে দ্রুত এ খবরগুলো ছড়িয়ে পড়ত। পরিচয় গোপন করে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতাম সেন্ট্রাল রোডে ভুতের গলি মসজিদের পাশে, ইমাম সাহেবরা যেখানে থাকতেন সেখানকার দুটো রুমে। ভুতের গলি এলাকায় তখন সুয়ারেজ লাইন হচ্ছে। ফলে গোটা এলাকার মাটি খোড়া। হেঁটে চলাচল করা ছাড়া উপায় নেই। নেই বিকল্প কোনো রাস্তাও। নিরাপদ ভেবে আত্মগোপনের জন্য আমরা ওই এলাকাটাই বেছে নিয়েছিলাম। ইনফরমার ছিল। ওদের খবরের ভিত্তিতেই রাতে বেরিয়ে গেরিলা অপারেশন চালাতাম।’

গেরিলাদের কৌশল কী ছিল?

‘আক্রমণ করেই সরে পড়া। হায়দার সাহেবের নির্দেশ ছিল– ‘প্রতিদিন পাকিস্তানি সেনাদের ডিসটার্ব করতে হবে। সেটা গ্রেনেড মেরে হোক কিংবা ফায়ার করেই হোক। ইউ মাস্ট ডু সামথিং।’

১৯৭১-এ ঢাকায় গেরিলাদের সবচেয়ে বড় অপারেশনটি হয় গ্রীনরোডে। যার খবর ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে। সে খবর উদ্দীপ্ত করে সারা দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। অপারেশনটির পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ছিলেন বীরপ্রতীক শেখ আব্দুল মান্নান। ওদিনের ঘটনার আদ্যোপান্ত জানান তিনি।

তার ভাষায়– ‘রেকি কোনো খবর দিচ্ছে না। তাই অনেকদিন অপারেশন নেই। এক রাতে একটা বিল্ডিংয়ের ওপর বসে দেখি আশপাশটা। দেখলাম রাত নয়টার পর কোনো লোকজনের চলাচল নেই। শুধু পিআইএ-এর লোকজন আর আর্মি মুভমেন্ট চলছে। তখনই সিদ্ধান্ত নেই গ্রীনরোড অপারেশনের।

অপারেশনটা কোথায় করবো? খুঁজে বের করলাম নুর হোটেলকে। যেটা এখন ক্যান্সার হাসাপাতাল করছে। বিল্ডিংয়ের কাজ তখন চলছিল। নিচ থেকে ওপর তলা পর্যন্ত খালি। আশপাশেও কেউ নেই। আমরা পাঁচজন–আমি, মনসুর আলম দুলাল, আলমগীর, আবদুল্লাহ আর মাহমুদ। কমান্ডে আমি নিজেই। সঙ্গে অস্ত্র ছিল দুইটা স্টেনগান, দুইটা এসএলআর আর আমার কাছে একটা চাইনিজ এসএমজি। দুই ব্যাগ হ্যান্ড গ্রেনেড আর দুই ব্যাগ ফসফরাস গ্রেনেডও ছিল। আগুন লাগানোর কাজে ব্যবহার করতাম ফসফরাস গ্রেনেড।

২১ অগাস্ট ১৯৭১। রাত সাড়ে দশটার দিকে নুর হোটেলের বিল্ডিংয়ের ওপর গিয়ে বসি। দুলালকে বললাম, যা মাইন বিছিয়ে আয়। স্ট্রিট লাইটটাও ভেঙে দিলাম। রাস্তা তখন অন্ধকার। মাইন ফিট করে সবাই বিল্ডিংয়ের চারতলায় পজিশন নিয়ে থাকি।

ভিডিও: ঢাকায় গেরিলাদের গ্রীণরোড অপারেশন

আধাঘন্টার মধ্যে একটা ভেসপা আসে। পিআইএ-এর স্টাফ হয়তো। রাস্তা দিয়ে চলে গেল। মাইন বার্স্ট হলো না। এরপর হঠাৎ দেখি লেফট-রাইট করে ৮-১০ জন ছেলে আসতেছে। পরণে পায়জামা পাঞ্জাবি। ওরা আসছে ছয় নম্বর রোডের দিক থেকে। আলবদর, আল শামসের হেড কোয়ার্টার ছিল ওখানে। সেখানে বসতেন বিগ্রেডিয়ার বশির। সেখান থেকেই এসেছে ওরা। পুরা রাস্তা পায়ে হেঁটে চলে গেল। এবারও কোনো মাইন বার্স্ট হলো না। আমি দুলালের ওপর ক্ষিপ্ত হই।

এরপর মাইন দেখতে নিচে আসি। হঠাৎ একটা গাড়ি আসে। আড়ালে লুকাই। দেখলাম আর্মি জিপ। পেছনে দুজন সোলজার আর্মস নিয়ে বসা। বুঝলাম ব্রিগেডিয়ার বশিরের জিপ। এবারও বার্স্ট হলো না মাইন। পুরো রাস্তা শুনশান।

আমি তখন সব মাইন উঠিয়ে ডাব্লিউ প্যাটার্ন করে সেট করি। ক্যামোফ্লেজ করি ময়লা ফেলে। ওয়ানলি সিক্স সেকেন্ড সাইন্ড প্রেসার সেট করে ব্লিডিংয়ে পজিশন নিয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকি। এক ঘন্টা পার হয়। কিছু আসে না। রাত তখন সোয়া দুইটা থেকে আড়াইটা হবে। দেখলাম, সাইন্স ল্যাবরেটরি থেকে তিনটা হলুদ লাইট পরপর আসছে। বুঝে যাই আর্মির গাড়ি। একটা সামনে এসেই বমবম করে উল্টে ওয়ালের পাশে ধাক্কা খায়। আব্দুল্লাহকে রাস্তার পাশেই অস্ত্র দিয়ে বসিয়েছিলাম। সে শুধু ফায়ার করলেই সব কলা গাছ হয়ে যেত। কিন্তু ওদের পড়তে দেখে গুলি না চালিয়েই সে ভয়ে পালিয়ে যায়।

দেখেন পাকিস্তানিরা কত ভোদাই। প্রথম গাড়ি উল্টে গেলেও পেছনের দুইটা ব্রেক করে নাই। বরং স্পিড বাড়িয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের ফায়ার ওপেন করার আগেই ওরা ফায়ার শুরু করে। গাড়ির তলায় পড়ে মরে গিয়েও ফায়ার করতে থাকে। আমি তখন বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে ধাম ধাম গুলি করি। গর্জে ওঠে বাকীদের এসএলআরগুলোও।

১৫-২০ মিনিট গোলাগুলি চলে। এরপরই দুপাশ থেকে সহযোদ্ধারা ছুটে আসে। কারণ তাদের ম্যাগজিন কাজ করছিল না। এসএলআর-এ রিপিট ফায়ার ও ব্রাশ ফায়ার অপশন থাকে। ওরা ব্রাশে দিয়ে ফায়ার করছিল। ফলে গরমে এমটি ম্যাগজিন আনলোড হচ্ছিল না।

সস্ত্রীক বীরপ্রতীক শেখ আব্দুল মান্নান

তখন তিনটা ট্রাকে রিপিট ফায়ারের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। আমিও গুলি চালাচ্ছি। হঠাৎ এসএমজিটা খাট করে একটা শব্দ হয়। গুলি শেষ। পেছন ফিরে দেখি সহযোদ্ধারা নেই। ভয় হয় তখন। সিড়ি বেয়ে আরেকতলায় উঠেই নিচে লাফিয়ে পড়ি। ফলে ব্যাথা পাই বাঁ পায়ে। অন্ধকারে কোনো রকমে একটা ওয়াল টপকেই পানিতে পড়ি। সাতার জানি না। ভেবেছি মরে যাব। বহুকষ্টে উঠে এক বাড়িতে লুকাই।

ভোরে রফিক এসে বলে– ‘স্যার আনন্দ সিনেমা হলের রোড থেকে গ্রীনরোড হয়ে আর্মি আসতেছে। সোনারগাঁও হোটেলের দিক দিয়ে হাতিরপুল পর্যন্ত রাস্তাটা আর্মি ব্লক করছে। ওরা ট্রাকের পর ট্রাকে আসতেছে। তাড়াতাড়ি পালান।’

বিছানা থেকে উঠতে পারি না। বাঁ পা-টা চলছে না। করিম ও জাহাঙ্গীর ছিল সঙ্গে। একটা রিকশা নিয়ে আমরা কোনোরকমে ওই এলাকা ছাড়ি।

এই অপারেশনে তিন ট্রাকে স্পট ডেড হয় ৬০-৭০ জন পাকিস্তানি আর্মি। সিএমএইচে নেওয়ার পর মারা যায় আরও ১৫-২০ জন। এ কারণেই ইস্ট পাকিস্তানের রাজধানীতে এটাকেই বিগেস্ট অপারেশন বলা হয়। আর্মিরাও এতে ক্ষিপ্ত হয়। অনেক যুবককে হাতিরপুল ও গ্রীনরোড থেকে ধরে নিয়ে টর্চার করে। অনেককে মেরেও ফেলে তারা।’

একাত্তরে আপনার বাবার ভূমিকা কী ছিল?

মুচকি হেসে তিনি বলেন– ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই কাজ করেছেন উনি। চৌদ্দ নম্বরে এখন যেখানে ডেন্টাল কলেজ সেখানেই নদী পথে নৌকা এসে ভিড়ত। আমরাও ওই পথে গোপনে বাড়ি আসতাম। বাবা আমাদের অব্যবহৃত ও নষ্ট হওয়া আর্মসগুলো রিপেয়ারিং করে দিত। একাত্তরে ওটাও ছিল আমাদের জন্য বড় সার্পোট।’

ঢাকায় অন্যান্য গেরিলা গ্রুপগুলোর সঙ্গে কি যোগাযোগ ছিল?

গেরিলা আব্দুল মান্নানের উত্তর– ‘মায়ার গ্রুপের কথা জানতাম। তারাও জানত। কিন্তু তেমন যোগাযোগ ছিল না। ‘ক্রাক প্লাটুন’ বলে এখন। তখন এ নাম শুনেনি। ইট ইজ নট গিভেন বাই ইন্ডিয়ান আর্মি নর বাংলাদেশি আর্মি। তবে তারাসহ অন্যান্য গেরিলা গ্রুপগুলো ঢাকায় দুর্ধর্ষ সব অপারেশন করেছিল একাত্তরে।’

যে দেশের জন্য যুদ্ধ করলেন, স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?

এ সূর্যসন্তানের উত্তর– ‘স্বাধীন একটা দেশ পেয়েছি, এটাই বড় পাওয়া। কিছু পাওয়ার জন্য তো মুক্তিযুদ্ধে যাইনি। তবে স্বাধীন দেশে থাকা-খাওয়া, বাসস্থান, ছেলেমেয়ের শিক্ষা–এগুলো কয়জন মুক্তিযোদ্ধা পেয়েছে বলেন? ছেলেমেয়ে একটাকেও সরকারি চাকুরি দিতে পারিনি। কারণ পয়সা লাগবে। অন্যায়ভাবে পয়সা উপার্জন করাও শিখিনি। সততাই পিছিয়ে দিয়েছে আমাকে। কারও পয়সা মেরে বড়লোক হবো– এটা স্বপ্নেও ভাবি না। অথচ স্বাধীন দেশে এখন আওয়ামী লীগের নেতারও বাড়ি আছে ১৩০টা। চোরগুলা কি করবে এই সম্পদ দিয়ে! এটা কি স্বাধীনতার মূল্য? কিছু সংখ্যক দুর্নীতিবাজদের লুটপাটের জন্য কি আমরা স্বাধীন করেছি এই দেশ?

এমনটা হওয়ার কারণ কী?

এই যোদ্ধার মত– ‘মন মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। একটা গ্রুপ পেয়েছে অগাধ সুযোগ। সরকারের ব্যর্থতাও আছে। সরকারি লোকের ৫টা বাড়ি কীভাবে হয়? ধরা পড়লে কয়– আমার শ্বশুর দিছে। প্রত্যেকের শ্বশুরই যদি ৫টা করে বাড়ি দেয় তবে তো এ দেশ গরীব না। ইললিগ্যাল কাজ যারা করে তাদের কয়টার বিচার হয়েছে দেখাতে পারবেন? বিচার হয়নি! বিচার দ্রুত ও কার্যকর না হলে এই রোগ রোধ করা অসম্ভব।’

দেশের উন্নতি দেখলে তৃপ্ত হন এই বীরপ্রতীক। দেশ নিয়ে ভাললাগার অনুভূতি প্রকাশ করতে তিনি বলেন– ‘আগে কারেন্ট যেত দিনে দশবার। এখন দশ মিনিটও যায় না। দেশের অনেক উন্নতি হচ্ছে, হবেও। তবে নৌকার বৈঠা শক্ত হাতে ঠিক রাখতে হবে।’

খারাপ লাগে কখন?

খানিক নিরব থেকে অকপটে বলেন– ‘লুটপাট আর ঘুষ, দুর্নীতি দেখলে খারাপ লাগে। এটা না থাকলে ৫০ বছরে আমরা অনেক এগিয়ে যেতাম। কোনো ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী অর্ডার না করলে কাজ আগায় না। তাহলে এত মন্ত্রী ও আমলারা বসে বসে কী করেন? শেখ মুজিব তো এমন আমলা চাননি। যার যার সিদ্ধান্ত তাকেই দিতে হবে দ্রুত। সম্পত্তির হিসাব নিতে হবে নিয়মিত। অবৈধ সম্পদ মিললেই অ্যাকশনে যেতে হবে। নিজের দলের লোকদেরও ছাড় দেওয়া যাবে না। আমরা অশান্তিতে বাস করেই মারা যাই। ক্ষতি নেই। কিন্তু তবুও প্রজন্মকে তো শান্তির একটা দেশ দিয়ে যেতে হবে।’

সারা বিশ্ব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। এটির সংক্রমণ রোধ করতে দেশেও চলছে নানা প্রস্তুতি। ভিন্ন ধরনের এক যুদ্ধ মোকাবেলার কথা বলছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। আমরা কি পারব এই যুদ্ধে জয় আনতে?

বীরপ্রতীক শেখ আব্দুল মান্নান আশার কথা শোনালেন ঠিক এভাবে– ‘একাত্তরের যুদ্ধ ছিল দেশের জন্য ঘর ছড়ার, অস্ত্র হাতে নেওয়ার। কিন্তু মার্চ ২০২০-এর যুদ্ধটা হলো ঘরে থাকার, অন্যের মাঝে ভাইরাস ছড়িয়ে না দেওয়ার। সচেতনতা বোধটা ছড়িয়ে দিতে পারলেই ইনশাল্লাহ আমরা পারব। তবে সঠিক সিদ্ধান্তগুলো কঠোর হলেও সরকারকে তা খুব দ্রুত নিতে হবে। বাঙালি হারার জাতি নয়। দুই হাত যতদিন থাকবে ততদিন কর্মও থাকবে। অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াবে। তাই আমি আশাবাদী। ঐক্যবদ্ধভাবে সচেতন হলে আমরা করোনাভাইরাস মুক্ত হবোই।’

মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল মান্নান (বীরপ্রতীক) স্বপ্ন দেখেন প্রজন্মকে নিয়ে। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো– ‘তোমরা সৎভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো। সৎভাবে বাঁচার আনন্দটা আলাদা, অন্যরকম শান্তিরও। সৎ থাকলে মনে ভয়-ডর থাকে না। আর অন্যায় করলেই তোমার মাথা নিচু হয়ে থাকবে। মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখো, দেশটাকেও সবার উপরে রাখো।’

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বীরপ্রতীক শেখ আব্দুল মান্নান

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল মান্নান (বীরপ্রতীক)।

ট্রেনিং: কলেজে ইউটিসির সার্জেন্ট ছিলেন। স্টেনগান ও রাইফেল চালানো তখন থেকেই জানা। পরে ভারতের কলেজটিলা থেকে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের ওপর বিশেষ ট্রেনিং নেন।

মুক্তিযুদ্ধ করেছেন: দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে গেরিলা অপারেশন করেন গ্রীনরোড, ওয়াটার বোর্ডের অফিস, ক্রিসেন্ট রোডে নিউ মডেল স্কুলে (তখন সেখানে পাকিস্তানি মিলিশিয়া ক্যাম্প ছিল), লালাবাগ থানা আক্রমণ (থানা তখন ছিল সাইন্সল্যাবের পুলিশ বক্সের পাশে), সেন্ট্রাল রোডে এক বিহারী বাড়িসহ প্রভৃতি স্থানে ।

ছবি ভিডিও: সালেক খোকন

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ০৯ জুন ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button