নদী আমাদের যে শিক্ষা দিচ্ছে
নদী নিয়ে স্মৃতিকথা দিয়েই শুরু করছি। নদীর জলে সাঁতার কাটা, নৌকা বাওয়া, ডিগবাজি খেয়ে পড়ার আনন্দটা কৈশোর জীবনে অন্যরকম ছিল। বিকেলবেলা নদীর পাড়ে আড্ডা, পাল তোলা বিশাল সব নৌকা দেখা, নদীর ধারে বসে মুগ্ধ হয়ে সূর্যাস্ত দেখা, ঢেউগুলো তীরে আছড়ে পড়ার শব্দ কি যে ভালো লাগত! কিন্তু এখন কি নদীগুলো সে রকম আছে?
নদীর এপার-ওপার কিছুই দেখা যেত না আগে। এখন নদীগুলোর মাঝখানে চর পড়েছে। সরু হয়ে যাচ্ছে নদীপথ। ফলে আগের রূপটি হারিয়ে অধিকাংশ নদীই আজ মৃতপ্রায়। একসময় নদীতে ভট ভট আওয়াজ ছিল না। এখন নৌকাগুলোতে লেগেছে ইঞ্জিন। ফলে নিঃশব্দে নদী দেখার আনন্দটা তেমন মেলে না। নদী পাড়ের মানুষ মাছ ধরত জাল দিয়ে। কারেন্ট জালের কারণে এখন নদীর কিছুই বাদ পড়ে না। সব ধরনের জলজ প্রাণী আর উদ্ভিদও উঠে আসে জালে।
প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহারও বেড়েছে বহু গুণ। আগে জালে গোল মাটির চাকা ব্যবহার করা হতো। সেখানে এখন প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করা হচ্ছে। লঞ্চ, ফেরি ও নৌকার শিক্ষিত বা নিরক্ষর সব যাত্রীই হাতের কাছের পলিথিন, কাগজ, কাপড় যাই হোক তা-ই নদীতে ফেলেন। যেন এটি তার অধিকার! ফলে দূষিত হয়ে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নদীর ইকোসিস্টেম।
বহু গুণে বেড়েছে নদী দখলের দৌরাত্ম্য। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বলছে, বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৪০৬টির মতো। যার একটিও দখলদারদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। নদীর জায়গা দখল করে বাড়িঘর ও শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি দোকানপাট ও বাজার তোলা হয়েছে। ঘরবাড়ি করে স্থানীয়রাও নদী-খালের জমি অবৈধভাবে দখল করেছে। ফলে নদীদূষণসহ অবৈধ স্থাপনা তৈরি করায় মূল নদীর প্রবাহ অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এভাবেই হত্যা করা হচ্ছে নদীগুলোকে।
যারা নদী দখল করছে, তাদের শাস্তি কী? জানা যায়, নদীর পরিবেশ কেউ ধ্বংস করলে আইন অনুযায়ী তাকে দুই বছর পর্যন্ত জেল দেওয়া যায়। আবার নদীতীরের কারখানা নিয়ম ভেঙে বর্জ্য ফেললে জরিমানা হয় ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। নদী দখল ও দূষণের প্রভাবের তুলনায় এসব শাস্তি একেবারেই লঘু। সিআরপিসির ১৩৩ ধারায় ‘পাবলিক নুইসেন্স’ হিসেবে দখলকারীর শাস্তি হয় মাত্র পাঁচ দিনের জেল। এ কারণেই নদী দখলকে ‘ফৌজদারি অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছে আদালত। সেটি করতে পারলেই দেশের নদ-নদীগুলো মানুষের মতোই পাবে আইনি অধিকার। এতে রক্ষা পাবে নদীর-জীবন্ত সত্তাও।
বেশ কিছুদিন আগে দেশের সব নদ-নদীর সুরক্ষা ও সংরক্ষণে নদী রক্ষা কমিশনকে ‘আইনগত অভিভাবক’ ঘোষণা করে সর্বোচ্চ আদালত এক রায়ে বলেছে, ‘দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদকে নিজ নিজ এলাকার নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়ের অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করে তাদের নামের তালিকা জনসম্মুখে ও পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে। নদী বা জলাশয় দখলকারী বা অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীরা ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ‘অযোগ্য’ বিবেচিত হবেন। ঋণ দেওয়ার সময় আবেদনকারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার যথাযথ ব্যবস্থা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় বা স্থানীয় কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রার্থীর বিরুদ্ধে নদী দখলের অভিযোগ থাকলে তাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। হাইকোর্টের এই রায়ের আলোকে সারা দেশের নদী দখলকারীদের তালিকা প্রকাশ শুরু হলেও উপজেলা পর্যায়ে নদী দখলকারীর তালিকা প্রকাশ এখনো হয়নি। ফলে অবৈধ দখলের মাধ্যমে নদী দূষণের কার্যক্রম থেমে থাকেনি।
সারা বিশ্বে যখন কভিড-১৯-এর তাণ্ডব চলছে, তখন প্রকৃতি ফিরে পেয়েছে প্রাণ। প্রকৃতির ওপর চালানো অবিচার কমে আসায় সে যেন মেলে ধরেছে নিজেকে। অনেকেই বলছেন প্রকৃতি মেরামতের কাজ চালাচ্ছে। ফলে বদলে গেছে নদীগুলো। গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ ছুটির মধ্যে ঢাকার আশপাশের পাঁচটি নদ-নদীর পানির মানের উন্নতি ঘটেছে। বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর পানির মান দ্বিগুণেরও বেশি উন্নত হয়েছে। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণে এ চিত্র উঠে এসেছে।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর দূষণের মূল উৎস শিল্পবর্জ্য। করোনার সাধারণ ছুটির সময় কলকারখানা বন্ধ ছিল। তাই স্বভাবতই পানির মান বাড়বে, এটা প্রত্যাশিত। পাশাপাশি নৌযানের জ্বালানিবর্জ্যও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’
লকডাউনের কারণে নদীগুলো শিল্পবর্জ্যরে দূষণ থেকে রেহাই পেলেও ওয়াসার পয়োবর্জ্য এখনো বড় দূষণকারী হিসেবে রয়ে গেছে। প্রতিদিন রাজধানীতে ১৫ লাখ ঘনমিটার পয়োবর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে ১৪ লাখ ঘনমিটারই অপরিশোধিত অবস্থায় ঢাকার চারপাশের নদ-নদীগুলোতে গিয়ে মেশে। এর থেকে নিষ্কৃতি না পেলে নদীগুলোকে রক্ষা করা সত্যি কঠিন হবে।
পরিবেশবিদরা মনে করেন, এবার প্রকৃতির ওপর মানুষের অন্যায্য আচরণ একটু কমেছে বলেই নদীগুলোতে পানির হাল ফিরেছে। অনেক ক্ষতির মধ্যেও করোনা আমাদের শিক্ষা দিল যে, আমাদের আচরণের জন্যই হচ্ছে প্রকৃতি ও নদীদূষণ, যা পাল্টাতে হবেই। নদীকে বাঁচাতে, প্রকৃতিকে বাঁচাতে শুধু সচেতন হলে চলবে না, পৃথিবীর অন্য দেশের মতো সবাইকে আইন মানতেও ‘বাধ্য’ করতে হবে।
শুধু দেশেই নয়, এ সময়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের নদীও প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সেখানে পঁচিশ বছরে পাঁচ হাজার কোটি রুপি ব্যয় করে সরকার যে আবর্জনা অপসারণ করতে পারেনি, করোনাভাইরাসের কারণে টানা দুই মাসের লকডাউনে তা সাফ করে বর্জ্যমুক্ত হয়েছে যমুনা নদী। শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ ও বাণিজ্যিক তৎপরতা স্তিমিত হওয়ার সুযোগে নদীটি নিজেকে পরিষ্কার করে নিয়েছে। ফলে যমুনা তার স্বরূপে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বহু স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি ভিড় করছে সেখানে। ধূসর বক, কাস্তেচরা, সারসের মতো পরিযায়ী পাখির পাশাপাশি ভারতের স্থানীয় পাখিগুলোকেও নদীর টলটলে স্বচ্ছ পানিতে মাছ ধরতে ও ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। এখন আমাদের নদীগুলোতেও ফিরতে শুরু করেছে জীববৈচিত্র্য।
দিন কয়েক আগেই পেরিয়ে গেল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘টাইম ফর নেচার’ অর্থাৎ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এখনই সময়। সত্যিই তাই। সময়টা প্রকৃতির। তাই প্রকৃতি ও নদী বাঁচাতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। ভুটান জিরো কার্বন নিঃসরণের দেশ। তারা অরগানিক খাবারে অভ্যস্ত হতে পারলে আমরা কেন পারব না?
জাতিসংঘ বলছে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ না করাতে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্যই শুধু নষ্ট হচ্ছে না, আমরা এর মাধ্যমে আমাদের জীবনকে ধ্বংস করছি। কভিড-১৯ আমাদের সেই শিক্ষাই দিচ্ছে।
তাই প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরও এগোতে হবে। বর্তমানে দূষণ কমে নদীগুলোর যে হাল ফিরেছে, সেটি ধরে রাখতে হবে, নদীগুলোর পানির মান বৃদ্ধি অব্যাহত রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। করোনার এ সময়ের শিক্ষা নিয়েই আগামী দিনের দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। আর এ কাজটি করতে হবে সরকারকেই। আমরা চাই, সব উন্নয়ন হোক প্রকৃতি ও নদীর প্রবাহ ঠিক রেখে। দূষণমুক্ত হয়ে নদীগুলো জীবন্ত হোক। ফিরে আসুক নদীর প্রাণপ্রবাহ।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১০ জুন ২০২০
© 2020, https:.