কোভিড-১৯: মাস্কের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে কে?
করোনাভাইরাসের এই সময়ে ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার না করলে জেল ও জরিমানার বিধান করেছে সরকার। ২০১৮ সালের সংক্রমণ আইনের ২৪ (১,২), ২৫(১-এর ক,খ) এবং ২৫ (২) ধারায় ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার না করলে শাস্তি সর্বোচ্চ ছয় মাসের জেল এবং এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
তবে জেলা প্রশাসকদের এটি সতর্কতার সাথে প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। সেটি মেনেই জনসাধারণকে মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সারাদেশে পরিচালিত হচ্ছে মোবাইল কোর্ট। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই কি নাগরিকদের মাস্ক পরা নিশ্চিত করা সম্ভব?
মাস্ক নিয়ে নাগরিকদের সচেতনতা সত্যিকারভাবে কেমন? এ নিয়ে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছি প্রথমে।
আমার বাসা রাজধানীর কাফরুল এলাকায়। একদিন আগে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ছোট্ট জটলায় পড়ি। সাত-আটজন তরুণ দাঁড়িয়ে হাসি-তামাশা করছেন। মাঝেমধ্যে একে-অপরের ওপর লুটিয়েও পড়ছেন। সকলেরই বয়স আঠার ছুইছুই। কারও মুখেই কোনো মাস্ক নেই। আড্ডা প্রকাশ্য হওয়ায় নিজেরা ভাইরাসে আক্রান্ত বা ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি সেখানে অধিক। তবুও কেন মাস্ক ব্যবহার করছেন না?
প্রশ্ন করতেই একজন এগিয়ে এসে জবাব দিলো- ‘আমাদের কারওই করোনা হইব না। তাই মাস্ক পরি না।’ এই নিশ্চিয়তা কে দিল, সচেতন হয়েও তারা কেন এমন ‘ডোন্টকেয়ার’ স্টাইলে চলছেন? এসব প্রশ্নের মুখে সবাই ‘সরি’ বলেই কায়দা করে কেটে পড়ে।
বাজারে ফল বিক্রি করছেন এক যুবক। তারও মুখে মাস্ক নেই। ওভাবেই দিব্যি ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। মাস্ক কোথায়? কড়া ভাষায় বলাতে পাশের ফার্মেসি থেকে একটি সার্জিক্যাল মাস্ক কিনে আনলেন। তা দেখে পাশের দোকানের ছেলেটি ড্রয়ার থেকে ময়লার আস্তরণ পড়া কাপড়ের একটি মাস্ক বের করে দ্রুত পরে নিলেন। খানিক পরেই ওই দোকানে আসেন অন্যজন। আগের জনের রেখে যাওয়া মাস্কটি পরেই তিনি দিব্যি কাজ শুরু করলেন।
মাছ বিক্রির দোকানগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। বিক্রিতাদের অনেকেরই মাস্ক ঝুলছে গলায়। মুরুব্বি বয়সী এক লোক মাছ কিনছেন। তার মুখেও কোনো মাস্ক নেই। কেন? মুচকি হেসে বললেন- ‘আল্লাহই রক্ষা করবো।’ ফুটপাতে মাস্কবিহীন বসে লেবু বিক্রি করছে এক যুবক। মাস্কের কথা উঠতেই বলেন- ‘মাস্ক আছে, ভুলে আইজকা বাড়িত রাইখা আইছি।’
বাজারের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করছেন নানা বয়সীরা। তাদের কারোর মুখেই মাস্ক মিলল না। মানুষের বাজার মাথায় নিয়ে ঘুরছে ছোট ছোট শিশুরা। তাদের অধিকাংশই মাস্ক পরেনি।
ফেরার পথে রাস্তায় রিকশার জটলা। খেয়াল করে দেখলাম অধিকাংশ রিকশার হাতলে ঝুলছে কাপড়ের মাস্ক। মাস্ক ওখানে কেন? একজনের উত্তর- ‘খুব গরম লাগে স্যার। তাই খুইল্যা রাখি।’ এখানেই শেষ নয়, পাড়া-মহল্লার হোটেল বা চায়ের দোকানগুলোতে মাস্ক পরা বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো লক্ষণই চোখে পড়ল না।
জনসাধারণের মাস্ক পরা নিয়ে এটি একদিনের অভিজ্ঞতা। যার অধিকাংশই হয়তো আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু মানুষ যদি সচেতন না হয় তবে সীমিত ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ দিয়ে কি দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা কি সম্ভব হবে?
তবে এ ক্ষেত্রে আশার কথা হলো এখন পর্যন্ত শতকরা আশি ভাগ মানুষ খুব নিয়ম করে না হলেও মাস্ক পরছেন। কিন্তু অবশিষ্ট বিশ ভাগ মানুষের মাস্ক না পরার কারণে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। যেটির জন্য কাজ করতে হবে সম্মিলিতভাবে।
করোনায় মাস্ক কতটা সুরক্ষা দেয়? সম্প্র্রতি এ নিয়ে এক গবেষণার তথ্য উঠে এসেছে গণমাধ্যমে।
বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের মহামারীর কেন্দ্রস্থলগুলোতে মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা আরোপ করায় হাজার হাজার সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হয়েছে। দ্য প্রসিডিংস অব ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেসে (পিএনএএস) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানিরা জানান, মহামারীর বিস্তার রোধে কোনো কোনো সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও বাসায় থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় মাস্ক পরিধান করা।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, উত্তর ইতালি এবং নিউ ইয়র্ক শহরে মাস্ক পরার নিয়ম জারির পর সে সময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাবের এই দুই এলাকায় সংক্রমণের প্রবণতা নাটকীয়ভাবে বদলে গিয়েছে। নিউ ইয়র্কে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর নতুন সংক্রমণের হার প্রতিদিন ৩ শতাংশ করে হ্রাস পেয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, ভাইরাস বহনকারী ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা মানুষের মুখে মাস্কের আচ্ছাদনের কারণে বাতাসে ছড়াতে বাধা পায় বলেই সংক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তাই আইনের পাশাপাশি মাস্ক পড়াতে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যক্তিগত সচেতনতাসহ প্রয়োজন সামাজিক উদ্যোগের। আর সেটি করতে পারলে করোনাভাইরাস মোকাবেলা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে।
এ নিয়ে কিছু আশাবাদের খবরও উঠে এসেছে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে। যা আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে উৎসাহ দেয়। মুখে মাস্ক না পরা ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি না করার অভিনব প্রচারে নেমেছেন বাগেরহাটের ব্যবসায়ীরা। সেখানে মাস্ক পরা না থাকলে ক্রেতা সাধারণের কাছে পণ্য বিক্রি করা হবে না- এমন প্রচারমূলক পোস্টার ছাপিয়ে দোকানে দোকানে লাগিয়ে দিয়েছেন তারা। এতে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মাঝে মাস্ক পরার সচেতনতা তৈরি হচ্ছে।
এমন উদ্যোগ চালু করা যেতে পারে সারাদেশে। শুধু নিজেকে রক্ষাই নয়, নিজের বা অন্যের মাধ্যমে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এটি বিশেষ প্রয়োজন। সামাজিক-রাজনৈতিক ও ছাত্রসংগঠনগুলোও এ কাজে উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া গণমাধ্যমেও শুরু করা যায় বিশেষ প্রচারণামূলক কার্যক্রম।
সরকার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার আদেশ দিলেও সাধারণ মানুষ কোন ধরনের মাস্ক কতদিন পর্যন্ত ব্যবহার করবেন- তার কোনো নির্দেশনা দেয়নি। আর মাস্কের দামের ব্যাপারেও নেই কোনো সরকারি নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্বিবিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান খান কয়েকদিন আগে এ প্রসঙ্গে জার্মানির ডয়চে ভেলেকে বলেছেন ঠিক এভাবে- ‘সাধারণের ব্যবহারের জন্য সার্জিক্যাল মাস্কই যথেষ্ট। এটা তিন স্তরের। আমরা বলে থাকি এই মাস্ক ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ ভাইরাস বা জীবাণু প্রতিরোধ করে। আর এন-৯৫ মাস্ক চিকিৎসকদের জন্য। এটা ৯৫ ভাগ পর্যন্ত প্রতিরোধ করে। তবে এই মাস্ক যাদের শ্বামকষ্ট আছে, যারা হার্টের রোগী, তারা ব্যবহার করলে বিপদে পড়তে পারেন। কারণ, এই মাস্কে অক্সিজেন সরবরাহ কম হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘তিন লেয়ারের সার্জিক্যাল মাস্ক একবার ব্যবহার করেই ফেলে দিতে হবে। ধুয়ে ব্যববহারের সুযোগ নেই। আর তথাকথিত কাপড়ের মাস্ক আসলে কোনো কাজে আসে না। দিনের পর দিন না ধুয়ে এই কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করলে উল্টো ক্ষতির কারণ হতে পারে।’
তাহলে সাধারণ মানুষ কোন ধরণের মাস্ক কীভাবে পরবে, সে প্রশ্নটি কিন্তু থেকেই যায়।
২৬ মার্চের আগে বাংলাদেশে একটি সার্জিক্যাল মাস্কের পাইকারি দাম ছিল দেড় টাকা। আর সর্বোচ্চ খুচরা দাম ছিল ৫ টাকা। এখন তা ২০ টাকার ওপরে। চাহিদার কারণে এখন নিম্নমানের মাস্কও স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে। ফুটপাতে মাস্কের পসরা সাজিয়ে বসেছেন অনেকেই। যে যার মতো দাম নিচ্ছেন। মান নিয়ন্ত্রণের নেই কোনো ব্যবস্থা। এরই মধ্যে র্যাব এবং ভ্রাম্যমান আদালত মাস্কের নকল কারখানাও খুঁজে পেয়েছে। ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া মাস্ক আবার ধুয়ে ও শুকিয়ে বিক্রির ঘটনাও ধরা পড়ছে কোথাও কোথাও। এটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা না গেলে মাস্ক নতুন বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে মনে করেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।
তাই সুলভ মূল্যে বিভিন্ন পেশাশ্রেণীর মানুষ যেন মানসম্পন্ন মাস্ক সহজে কিনতে পারে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। এ ক্ষেত্রে ভালো মানের তিন স্তরের মাস্ক তৈরির উদ্যোগ এখনই নিতে হবে।
মাস্ক ব্যবহারে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি এর সহজলভ্যতা ও দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা নিশ্চিত করা না গেলে এ উদ্যোগ প্রশ্নের মুখে পড়বে। গরীব ও শ্রমজীবী মানুষের মাঝে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণের উদ্যোগসহ এ ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকিও প্রদান করতে পারে। তাতে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা যেমন বাড়বে তেমনি স্বাভাবিক কাজ অব্যাহত রাখার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল থাকবে।
ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৫ জুন ২০২০
© 2020, https:.