কলাম

পর্বতারোহী রত্নার মৃত্যু ও নিরাপদ সড়কের দাবি

প্রায় নিঃশব্দেই চলে যেতে হলো স্বপ্নবাজ পর্বতারোহী রেশমা নাহার রত্নাকে। ৩৩ বছর বয়সী রত্না হিমালয় জয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন। নিজেকে প্রস্তুতও করছিলেন সেভাবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে ঢাকার সড়কে। মৃত্যু হয় একটি সম্ভাবনার। তাকে ঘিরে প্রিয়জনদের স্বপ্নগুলোও আজ গুমরে কাঁদছে। গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে, শুক্রবার সকাল পৌনে ৯টায় ঢাকার সংসদ ভবন এলাকার চন্দ্রিমা উদ্যান সংলগ্ন লেক রোডে সাইক্লিং করার সময় একটি মাইক্রোবাসের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পিচঢালা পথে রত্নার শরীরের ছোপ ছোপ রক্ত আর দুমড়ানো-মোচড়ানো সাইকেলটির ছবি দেখে আমাদের ভেতরটাও কেঁপে উঠবে। অসংখ্য প্রশ্ন জাগে এটা কি মৃত্যু নাকি হত্যা? এমন ভিআইপি সড়কেও কেন বেপরোয়া গাড়ি চলবে? সড়কে আর কত মানুষের রক্ত ঝরবে?

রত্নার বাবা আফজাল হোসেন বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বীরের কন্যার বীরত্বও কম ছিল না। পর্বত আরোহণের মাধ্যমে দেশের পতাকাকে শিখরে তুলে ধরেছিলেন রত্না। ছিলেন একাধারে শিক্ষক, পর্বতারোহী, দৌড়বিদ ও সাইক্লিস্ট। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রমের সঙ্গেও। নতুন কিছু করার স্বপ্নে বিভোর থাকতেন রত্না। ২০১৬ সালে কেওক্রাডং পর্বত চূড়ায় ওঠার মাধ্যমে তার পর্বতারোহণ শুরু হয়। পরপর দু’বছর ভারতের উত্তর প্রদেশের নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেইনারিং থেকে পর্বতারোহণের মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। গত বছরের আগস্টের কথা। ভারতের লাদাখের স্টক কাংরি (৬১৫৩ মিটার) ও কাং ইয়াস্তে-২ (৬২৫০ মিটার) পর্বত দুটিতে সফলভাবে সামিট করেন রত্না। এছাড়া ২০১৮ সালে আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট কেনিয়া অভিযানেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। এ সময় তার বুকে জড়ানো থাকত লাল-সবুজের পতাকা। দেশ ও পতাকাকে তুলে ধরতে দুর্গম পর্বত আরোহণের কষ্টকেও মেনে নিয়েছিলেন। তাই থেমে থাকেননি কখনো।

২০১৯ সালের ৮ আগস্টে ভারতের লাদাখের মারাখা ভ্যালির কাং ইয়াস্তে-২ মাউন্টেন রোড থেকে অভিযান শুরুর পর পাহাড় বেয়ে নামা পানির স্রোত তার অভিযানকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। অনুকূল আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে একসময় প্রতিকূলতা পেরিয়েই যাত্রা করেন স্টক কাংরি পর্বতের দিকে। বেইসক্যাম্প থেকে সামিটের উদ্দেশে যখন এগোন ততক্ষণে তার পায়ে ভয়ংকর রকমের ফোসকা পড়ে যায়। তবু থামেননি বীরকন্যা রত্না। সারা রাত ট্র্যাক করে ভোরে সামিট করেন সেইন্ট কাংরিতে। বাংলাদেশের পতাকা তখন তার হাতে। মৃত্যুকে জয় করে দেশের পতাকাকে যিনি তুলে ধরেছেন পর্বতের শিখরে, তাকেই জীবন দিতে হলো এই রাজধানীর সড়কে। এটা মেনে নেওয়া সত্যি কঠিন ও কষ্টের। রত্নার মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আবারও দেখিয়ে দিল, এই নগরে আমরা কতটা অনিরাপদ। যখন লিখছি তখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরত্নাকে চাপা দেওয়া মাইক্রোবাসটির চালককে শনাক্ত করতে পারিনি। অথচ ওই সড়কে একাধিক সিসি ক্যামেরা বসানো রয়েছে। যেসব যাচাই করে সহজেই ঘাতককে চিহ্নিত করা সম্ভব হওয়ার কথা। এর মধ্যেই রত্নার হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার দাবিতে পথে নেমেছেন তার সতীর্থসহ বেশ কয়েকটি সামাজিক সংগঠনের সদস্যরা। তাদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে নিরাপদ সড়কের সেই পুরনো দাবি।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই। রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের প্রতিযোগিতায় বাসচাপায় নিহত হন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব এবং একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম। ফলে নিরাপদ সড়কের দাবিতে পথে নামে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা। তারা সড়ক অবরোধ করাসহ সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজও করতে থাকে। যানবাহনের লেন ঠিক করা ছাড়াও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্থানে গাড়ির কাগজপত্র চেক করে। যা সে সময় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। ওই আন্দোলনে সপ্তাহখানেক উত্তাল ছিল গোটা দেশ। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সরকার নতুন সড়ক ও পরিবহন আইন পাস করে এবং সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নানা প্রতিশ্রুতি দেয়। যার পুরোপুরি বাস্তবায়ন ঘটেনি এখনো। এর পরও থামেনি সড়কে মৃত্যুর মিছিল। এক বছর পরেই বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালসের (বিইউপি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথমবর্ষের ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী সড়কেই নিহত হন। ঢাকার বসুন্ধরা গেট এলাকায় একটি বাস আবরারকে চাপা দেয়। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী হয়ে রাস্তায় নামে।

নানা সময়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন হলেও সড়ক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন ঘটেনি তেমন। বিষয়টি নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্টরা কিছুদিন সচেতন বা সক্রিয় থাকলেও একসময় তা আগের নিয়মেই চলতে থাকে। ফলে প্রতিনিয়তই বাড়ছে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা। ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) নামের সংগঠনটি বলছে২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চার হাজার ৭০২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে পাঁচ হাজার ২২৭ জন নিহত হয়। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে যা ছিল তিন হাজার ৩৪৯টি। তাতে প্রাণ হারায় চার হাজার ৪৩৯ জন। ২০১৮ সালের তুলনায় এক হাজার ৫৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ঘটেছে ২০১৯ সালে। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যাও ৭৮৮ জন বেশি।

পর্বতারোহী রত্নার মতো সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ নিহত এবং হাজার হাজার আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। এছাড়া নৌপথ এবং রেলপথেও নিহত ও আহত হওয়ার সংখ্যা কম নয়। প্রতিদিনই বাড়ছে সড়কে দুর্ঘটনার নামে এ ধরনের হত্যাকান্ড। ফলে গোটা দেশের যাতায়াত নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এ বিষয়ে ব্যাপক পরিমাণ জনসচেতনতার প্রয়োজন থাকলেও তা চলছে ঢিমেতালে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও একটু সতর্কতা অবলম্বন করলে সড়ক, নৌ ও রেলপথের দুর্ঘটনাগুলোর অধিকাংশই এড়ানো সম্ভব। যাত্রী নিরাপত্তার জন্য আইন ও আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং ট্রাফিক ব্যবস্থার শৃঙ্খলাই সড়কে অরাজকতা ও দুর্ঘটনা হ্রাস করতে সাহায্য করবে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে যান্ত্রিক বাহনে করে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে থাকে। নীতিমালায় ও আইনে পথচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। এমনকি পথচারী পারাপারে সুব্যবস্থাও নেই রাজধানীর অধিকাংশ রাস্তায়। আবার সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ হলেও তা বাস্তবায়নে শিথিলতা দেখাচ্ছে সরকার। ফলে বেপরোয়া গাড়ি চালানো কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। গভীর রাতে ও ভোরে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চলাচল রাজধানীতেও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দুর্ঘটনা নামে হত্যাকান্ড বাড়ছে। যার শিকার রেশমা নাহার রত্নার মতো অনেকেই। রত্নার হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। শুধু প্রতিশ্রুতি নয় আমরা চাই সড়ক আইনের সঠিক বাস্তবায়ন। চাই, সবার জন্য সড়ক হোক নিরাপদ।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১১ আগস্ট ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button