বীরপ্রতীক মেজর (অব.) শওকত আলীর প্রয়াণ
“২৬ মার্চ ১৯৭১। সকাল বেলা। রাতেই ঢাকায় শুরু হয়েছে গণহত্যা। খবরটি পেয়ে ঠিক থাকতে পারি না। দৌড়ে চলে যাই চট্টগ্রাম মেডিকেলের হোস্টেলে। বোরহান, সালাউদ্দিন সেখানে হাতবোমা বানাচ্ছিল। হেল্পিংয়ে ছিলাম আমি। ক্লোজ ফ্রেন্ড শওকত হোসেন। হঠাৎ দেখি একটা জিপ ঢুকছে মেডিকেলে। গাড়ি থামিয়েই সে শুধু বলল ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যাবি?’ রাজি হতেই তুলে নিল জিপে। চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্সটির জায়গায় তখন ছিল একটি বড় গোডাউনের মতো। এইট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাম্প ছিল সেখানে। বন্ধু শওকত হোসেনের আত্মীয় ছিলেন তখন এইট বেঙ্গলের দায়িত্বে থাকা মেজর মীর শওকত আলী। সে সুবাদেই স্টুডেন্ট হিসেবে আমরা জয়েন করি তার কাছে। অতঃপর থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানো শেখানো হয় ক্যাম্প থেকেই। তা দিয়েই নিয়মিত সেনাদের সঙ্গে কাজ করতাম আমরা। স্বাধীনতার স্বপ্নে এভাবেই যুক্ত হয়েছিলাম এইট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে। এ খবর পরিবার জানত না। দুই একদিন কেটে গেল। অতঃপর ক্যাম্প থেকে বাড়িতে আসি। সঙ্গে ছিলেন নায়েক সুবেদার অলিসহ কয়েকজন। আব্বা চাকরি করতেন পাকিস্তান রেলওয়েতে। যুদ্ধে যাওয়ার কথা শুনে প্রথম বাধা দেন তিনি। বললেন ‘দুই তিনদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার যাওয়ার দরকার নেই।’ কিন্তু মা তখন পক্ষে ছিলেন। প্রতিবাদ করে তিনি শুধু বললেন ‘ওকে যেতে দেন। দেশের জন্য আমি ওকে উৎসর্গ করলাম।’ মায়ের কথায় মনোবল দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাইনি।”
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেছিলেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরপ্রতীক এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর শওকত আলী। এই বীর এখন প্রয়াত। ৪ জুলাই ২০২০ আনুমানিক বিকেল ৫.৩০ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি চট্টগ্রাম সিএমএইচ-এ শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। বেশ কিছুদিন আগে তার মুখোমুখি হয়েছিলাম যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। একাত্তর নিয়ে এই বীরের কথাগুলোই মুক্তিযুদ্ধের অকাট্য দলিল হিসেবে অনন্তকাল থেকে যাবে। শ্রদ্ধা রইল এই বীরের প্রতি।
এম আশরাফ আলী ও শিরিন আরা বেগমের ছোট ছেলে শওকত আলী। বাবা ছিলেন রেলওয়ের চিফ ট্রাফিক ম্যানেজার। শওকত আলীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরেই। নার্সারি থেকেই তিনি লেখাপড়া করেন সেন্ট প্ল্যাসিড হাই স্কুলে। মেট্রিক পাস করেন ১৯৬৮ সালে। অতঃপর ভর্তি হন চট্টগ্রাম গভর্নমেন্ট কলেজে। ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে চলে যান ঢাকায়। অনার্সে ভর্তি হন ইংলিশে, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র।
৭ মার্চ ১৯৭১। শওকত আলী তখন জিন্না হলের (বর্তমান সূর্যসেন হল) ১৫৪ নম্বর রুমে থাকেন। বন্ধুদের সঙ্গে চলে আসেন রেসকোর্স ময়দানে। খুব কাছ থেকে প্রথম দেখেন বঙ্গবন্ধুকে। ভাষণের পর বন্ধু আফতাব, মান্নান, শওকত, কামাল প্রমুখের সঙ্গে চলে যান চট্টগ্রামে। অতঃপর সেখানেই যুক্ত থাকেন মিছিল মিটিংয়ে। পরবর্তীকালে যোগ দেন এইট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এপ্রিল ১৯৭১। মাসটি তখনো শেষ হয়নি। শওকতরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন চট্টগ্রাম শহরে। চকবাজার রোডে কক্সবাজারমুখী রাস্তার মুখেই ডিফেন্স ছিল তাদের। ক্যাপ্টেন হারুন ও লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরী ছিলেন সেখানে। তারা কমান্ড করতেন। সহযোগিতার জন্য অস্ত্র হাতে তাদের সঙ্গে থাকতেন শওকতরা। এক পর্যায়ে পাকিস্তানিরা ট্যাঙ্ক নিয়ে আক্রমণ করলে টিকতে না পেরে তারা চলে যান কালুরঘাট ব্রিজে।
সামনে থাকত এক সেকশন ইপিআর। এরপর এইট বেঙ্গল। আর পেছনে ছিল বেঙ্গল রেজিমেন্ট। সবাই ট্রেইন্ড সোলজার। শওকতরা তখন ছিলেন স্টুডেন্ট। তাদের বলা হতো অনারারি সোলজারস। কালুরঘাটের যে অপারেশনে শমসের মবিন আহত হন সেখানে তার সঙ্গেই ছিলেন শওকত আলী। ফেনী নদীর নিকটবর্তী এলাকায় এক অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের শেলের স্পিøন্টার বিদ্ধ হয় এই বীরের ডান পায়ের গোড়ালির নিচে। পরে গৌহাটি বেইজ হাসপাতালে অপারেশন করে তা বের করে আনা হয়। সুস্থ হয়েই তিনি চলে আসেন রণাঙ্গনে।
এরপর তারা রামগড় ক্রস করে চলে যান ভারতের সাবভুমে, ত্রিপুরায়। ওখানে হরিণা ক্যাম্পে তাদের ট্রেনিং হয় প্রায় একমাস। ট্রেনিং শেষে ট্রুপসের সঙ্গে শওকতরা বর্ডার পার হয়ে হিট করেই আবার ফিরে আসতেন। মে মাসের কথা। প্রায় কয়েক হাজার স্টুডেন্ট থেকে বাছাই করা হয় সাত জনকে। শওকত আলী সেখানে প্রথম হন। তাদের রিক্রুট করা হয় সেনাবাহিনীতে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচে কমিশনড হন তিনি। সাড়ে চার মাস আর্মির বেসিক ট্রেনিং হয় আগরতলায় ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে (মূর্তি)। অতঃপর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে তাকে পোস্টিং দেওয়া হয় ১ নম্বর সেক্টরে। ৯ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখে সেনাবাহিনীতে জয়েন করেন এই বীর যোদ্ধা। আর্মি নম্বর ছিল বিএসএস ৭২৮।
তখন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম। ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ মোট ৩১০ জন সেনা দিয়ে উনি শওকতকে পাঠিয়ে দেন ফটিকছড়িতে। সেখানে কিরাম পাহাড়ে ডিফেন্স গড়ে তোলেন শওকত আলী। পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প তখন ছিল হাটহাজারীতে ও নাজিরহাট কলেজে। শওকত আলীর ট্রুপস সামনে এগিয়ে গিয়ে হিট করেই আবার ফিরে আসত। ফটিকছড়ির বাসস্ট্যান্ডের পাশে একবার অ্যাম্বুশ করতে গিয়ে শওকতদের এগারজন যোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু ওইদিনই তারা উড়িয়ে দিতে সক্ষম হন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক লেফটেন্যান্ট কর্নেল, তিনজন মেজর ও দুজন লেফটেন্যান্টসহ ১৭২ জনের একটি পাকিস্তানি সেনাদলকে। তার নেতৃত্বে এভাবেই সফল অপারেশন চলে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত।
স্বাধীনতা লাভের পর এই বীর যোদ্ধা সেনাবাহিনীতে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম ব্যাচের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল করার কথা ছিল ১৯৭৯ সালে। কিন্তু জিয়াউর রহমান তা হতে দেননি। জিয়া হত্যাকা-ের সময় মেজর হিসেবেই শওকত আলীর পোস্টিং ছিল রুমায়। সন্দেহবশত তাকে জড়ানো হয় জিয়া হত্যা মামলায়। পাঁচ বছর চলে ইন্টারোগেশন ও টর্চার। টর্চারে এই মুক্তিযোদ্ধার সামনের মাড়ির দাঁতগুলো সব পড়ে যায়। অতঃপর কোর্ট মার্শালে তাকে ১৪ বছর সাজা দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে ১৯৮৬ সালে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু চাকরি আর ফিরে পাননি।
রক্তের বিনিময়ে মানচিত্র আনা এই যোদ্ধার কণ্ঠ আমৃত্যু সরব ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। ইতিহাসে বীরদের মৃত্যু নেই। প্রজন্মই বাঁচিয়ে রাখবে মুক্তিযোদ্ধা ও বীরপ্রতীক মেজর (অব.) শওকত আলীর ইতিহাসকে। তাই পাহাড়সম আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশেই তিনি বলে গেছেন শেষ কথাটি ‘তোমরা দেশকে মায়ের মতো ভালোবেসো। দেশের উন্নতি হয় এমন কাজে যুক্ত থেকো। মাদক ও জঙ্গিবাদ থেকে নিজেকে মুক্ত রেখো। তোমরাই পারবে দেশটাকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে। মুক্তিযোদ্ধাদের দোয়া সবসময়ই তোমাদের সঙ্গে থাকবে।’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ০৬ জুলাই ২০২০
© 2020, https:.