গরু বিষয়ক একটি আদিবাসী লোককথা
গো-হত্যা উৎসব ম্রো আদিবাসী সমাজে সর্ববৃহৎ সামাজিক অনুষ্ঠান। সাধারণত এ উৎসব আয়োজন করা হয় ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে যখন তাদের বাৎসরিক ফসল উত্তোলন শেষ হয়। আবার গৃহের রোগ মুক্তির কামনায়, গৃহ শান্তি ও উচ্চ ফলনের আশায়ও ‘থুরাই’ বা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে মানত করে পূজা দেওয়া হয় এ উৎসবে। পরিবারের কোনো সদস্য দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হলে তখনোও ম্রোরা গো-হত্যা অনুষ্ঠানের মানত করে।
ম্রোদের বিশ্বাস, গরুর আত্মা তাদের জাতির শত্রু। কোনো পরিবারের উপর যখন গরুর আত্মার নজর পড়ে তখনই সে পরিবারের সদস্যরা নানা ধরনের রোগ-শোকে ভোগে। তখন এ থেকে মুক্তি পেতে তারা গো-হত্যা অনুষ্ঠান মানত করে।
তিনটি গরু হত্যার মাধ্যমে এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। ম্রোরা ঝরনার পানি দিয়ে জীবন যাপন করে। তাই ঝরনার দেবতাকে সন্তুষ্ট করা ও ধন্যবাদ জানাতে তারা জীবের বলিদান করে। এ কারণে কোনো পরিবার যখন গো-হত্যা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তখন ঝরনার দেবতার জন্যও একটি গরুকে বলি দিতে হয়। অপর দুটো গরুকে হত্যা করা হয় পাড়ার মধ্যস্থলে।
অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে পাড়ার সবাই একত্রে বাঁশের চাঁচারি এবং দুতলা বিশিষ্ট একটি মাচাং তৈরি করে নেয়। মাচাংয়ের নিচে দেওয়া হয় ছোট্ট আকারের একটি ঘের। এ ঘেরের ভেতরই বাঁধা হয় গরু। অনুষ্ঠানের দিন সন্ধ্যায় আমন্ত্রিত অতিথি, গোত্রের লোকজন, নিকট আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসী অনুষ্ঠান আয়োজনকারীকে সম্মানস্বরূপ এক বোতল করে মদ (তাদের প্রিয় পানীয়) উপহার দেয়। চলে মদ্যপানের আসর। ম্রো ভাষায় এ আসরকে বলা হয় ‘তাঅই’।
উৎসবের রাতে নাচার প্রস্তুতি নিয়ে যুবতীরা নানা ধরনের রূপার অলংকার ও রং-বেরঙের ফুলে রূপসজ্জা করে। তারা খোঁপায় ও কানে নানা রকম নানা রঙের ফুল, গলায় পুঁতির মালা, বিভিন্ন ধরনের কোমরবন্ধ, হাতে রূপার চুড়ি, পায়ে ঘুঙুর পরিধান করে। রূপসজ্জা শেষে যুবতীরা নাচের জন্য গাছের তলায় সমাবেত হয়। তাদের ঘুঙুরের আওয়াজে চারপাশের নিস্তব্ধতা ভাঙে। যুবকরা ১০-১২ হাত লম্বা ‘পুং’ (বাঁশের তৈরি বাঁশি) নিয়ে মাচাং হতে সারিবদ্ধভাবে নিচে নামে।
এসময় এক প্রকার জংলি লাউকে ছিদ্র করে ১০-১২ হাত লম্বা চিকন বাঁশ ঢুকিয়ে মোম লাগিয়ে বাঁশির সুর তোলা হয়। এতে সব পাহাড়ি বনভূমি কেঁপে উঠে। তখন যুবকরা বাঁশি বাজায় আর যুবতীরা বাঁশির তালে তাল মিলিয়ে নাচতে থাকে। অদ্ভুত এক বাঁশির সুর যেন গরুকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। বাঁশির সুরে ও নাচের তালে সেও তার শেষ জাবর কাটতে থাকে। সারারাত চলে এমন আচার।
সকালে গৃহকর্তা এক হাতে ধারালো বল্লম আর আদা-জল মিশ্রিত মদ মুখে পুরে গরুর গায়ে ফুঁ দেয় এবং মন্ত্র উচ্চারণ করে। মন্ত্র পড়া শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তিনি গরুর ডান পাশের হৃৎপিণ্ড বরাবর বল্লমের খোঁচা দেন। বল্লমের আঘাতে যখন গরুটি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে থাকে তখন ম্রোদের নাচ ও গানের গতি আরো বাড়তে থাকে। গরু যখন মৃত্যুর জন্য ছটফট করছে গৃহকর্তা তখন বল্লম দিয়ে তার জিহ্বা বের করে কেটে ‘লিং’(গরু বাঁধার খুঁটি) এর উপর গেঁথে রাখে। কারণ তারা বিশ্বাস করে, এককালে গরু ম্রোদের বর্ণমালা সংবলিত ধর্মীয় গ্রন্থ খেয়ে ফেলেছিল। তাই গরুর জিহ্বা আজ খুঁটির মাথায় গেঁথে রাখা হয়েছে। পরে আনন্দ-ফূর্তি করে সবাই গরুর মাংস দিয়ে নানা পদ রান্না করে।
ম্রোদের গো-হত্যা অনুষ্ঠান আয়োজনের পেছনে লুকিয়ে আছে একটি লোক কাহিনি। কী সেই কাহিনি?
ম্রো আদিবাসীরা বিশ্বাস করে চাঁদ, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পৃথিবী বা ভূমণ্ডলের জীবকুল ও উদ্ভিদকুল সৃষ্টির পেছনে রয়েছেন এক মহাশক্তিমান। তিনি হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা বা থুরাই।
একদিন সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্ট মানুষজাতিসহ জীবকুলকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বর্ণমালা সংবলিত ধর্মীয় গ্রন্থ দান করবেন বলে মনস্থির করেন। তিনি ওই পুস্তক বা ধর্মীয় গ্রন্থ গ্রহণের জন্য পৃথিবীর সব জাতির নেতাকে উপস্থিত থাকার জন্য একদিন ডেকে পাঠালেন। তখন জুমের ফসলাদি উঠছিল। তাই কাজের ব্যস্ততায় ওই অনুষ্ঠানে ম্রো জাতির নেতা যথাসময়ে উপস্থিত থাকতে পারেনি। অন্য জাতির নেতারা যখন গ্রন্থখানা নিয়ে ফিরে আসছে তখন ম্রো প্রধান সেখানে উপস্থিত হয়। ততক্ষণে সৃষ্টিকর্তা বা থুরাই স্বর্গে ফিরে গেছেন।
পরদিন সকালে সৃষ্টিকর্তা বা থুরাই গরুর মাধ্যমে ম্রোদের কাছে তাদের গ্রন্থ পাঠানোর উদ্যোগ নিলেন। গ্রন্থে বার মাসিক চাষাবাদ, ধর্মীয় নীতিমালা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্কে উল্লেখ ছিল। ধর্মীয় সব বিধিনিষেধ ও উপদেশবাণীও লেখা ছিল কলার পাতায়।
থুরাইয়ের নির্দেশে গরু গ্রন্থখানা নিয়ে রওনা হলো। সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। প্রখর রোদে গরুটি হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পথে ছিল বিরাট এক বটগাছ। তার ছায়ায় গরু গ্রন্থের ওপর মাথা রেখে বিশ্রাম নিতে গিয়ে মনের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল ততক্ষণে বিকেল ঘনিয়ে এলো সন্ধ্যা হয় হয়। ক্ষুধার জ্বালায় তার পেট চু চু করতে লাগল। কোনো উপায় না দেখে কলা পাতার গ্রন্থখানা সে খেয়ে ফেলল।
বর্ণমালা ও ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও ওই পুস্তকে আরো নির্দেশাবলী ছিল যে, বৎসরে তিনবার ধান, তিনবার তুলা, তিনবার তিল-তিসি ফসল তোলা যাবে এবং মাত্র একবার নিড়ানি দিতে হবে। পুস্তকবিহীন গরু যখন ম্রোদের নিকট উপস্থিত হলো, তখন সে সব বিষয়ই ভুলে গেল।
কোনো উপায় না দেখে গরু ম্রোদের কাছে গিয়ে বলল, ‘গতকাল পুস্তক প্রদান অনুষ্ঠানে তোমরা যে সঠিক সময়ে উপস্থিত থাকতে পারনি তার জন্য থুরাই তোমাদের উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন। তাই তোমাদের গ্রন্থ দেওয়া হবে না বলে তোমাদের ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয় জানাতে তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন’। নির্দেশাবলী জানতে চাইলে গরুটি বলে, ‘জুম হতে একবার ফসল উত্তোলন করা যাবে এবং জুমের ফসল রক্ষণাবেক্ষণসহ বহুবার নিড়ানি দিতে হবে।’ এ কথা বলেই সে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যায়।
গরু ফিরে গেলে থুরাই ম্রোদের কাছে সঠিকভাবে গ্রন্থ পৌঁছানো হয়েছে কিনা প্রশ্ন করলে গরুটি অগোছালোভাবে জবাব দিতে থাকে। থুরাই বা সৃষ্টিকর্তা তখনই বুঝতে পারেন বিষয়টি। এদিকে ম্রোরা দেখলো জুম চাষ নিয়ে অপরাপর জাতির নির্দেশনার সঙ্গে তাদের নির্দেশনাটির কোনই মিল নেই। তাই একদিন তারা থুরাই বা সৃষ্টিকর্তার কাছে গেল এর কারণ জানতে।
সব শুনে থুরাই গরুকে মিথ্যা বলার অপরাধে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করলো। পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘যতদিন ম্রো জাতি বর্ণমালা সংবলিত ধর্মীয় গ্রন্থ পাবে না, ততদিন পর্যন্ত তোমাদের (গরুর) ওপর ম্রোরা নির্যাতন চালাবে। তোমাদের শাস্তি হবে ম্রোদের গ্রামের মধ্যখানে লিম্পুতে (পাড়ার মাঝখানে)। পিঞ্জরে আবদ্ধ করে তোমাদের চারদিকে ঘুরে ঘুরে তারা সারারাত নাচবে। আর ভোরে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করবে। আর তোমাদের মিথ্যাশ্রিত জিহ্বা কেটে বাঁধানো খুঁটির মাথায় গেঁথে রাখবে। এটাই হচ্ছে তোমাদের মিথ্যা বলার উপযুক্ত শাস্তি।’
ম্রো আদিবাসীদের বিশ্বাস এ ঘটনার পর থেকেই তাদের পূর্বপুরুষরা গো-হত্যা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে ম্রোদের মধ্যে যারা ‘ক্রামা’ ধর্ম গ্রহণ করেছে তারা গো-হত্যা থেকে বিরত থাকেন। কারণ ‘ক্রামা’ ধর্মাবলম্বীদের কাছে বর্তমানে বর্ণমালা ও ধর্মীয় গ্রন্থ রয়েছে। ফলে তারা মনে করেন, গরু এখন সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ থেকে মুক্ত।
অলঙ্করণ: সমর মজুমদার
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৭ জুলাই ২০২০
© 2020, https:.