মাস্ক পরায় উদাসীনতার আত্মপ্রসাদ
করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দিকের তথ্য দিয়েই শুরু করছি। দেশে সচেতনতা তখন কেমন ছিল? বাইরে গেলে মাস্ক পরতে হবে, সমাজে চলাফেরায় শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করতে হবে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ তাহলে সহজ হবে এমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সরকার নানা নির্দেশনা জারি করে। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে সচেতনভাবে মানুষ তখন নিয়মগুলো গুরুত্বের সঙ্গে পালন করত। কিন্তু সেগুলো প্রায় বদলে যেতে শুরু করেছে। বিশেষ করে হাটবাজার, গণপরিবহন, জনসমাগম স্থলে মানুষের মাস্ক পরার প্রবণতা নেমে আসছে শূন্যের কোঠায়। করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে মানুষের মনে যে আতঙ্ক ও ভয় ছিল। ক্রমেই তা কেটে যাচ্ছে। আর এ কারণেই মাস্ক পরাতে উদাসীন হচ্ছে অনেকেই, যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াবে।
ঢাকার বাজারগুলোতেই এখন মাস্ক ছাড়া কেনাবেচা করতে দেখা যায় বহু মানুষকে। অনেকেই মনে করেন মাস্ক না পরলেও তার কিছু হবে না। আবার নিম্ন আয়ের মানুষের ভাষ্য করোনাভাইরাস বড়লোকদের রোগ। ফলে তারা আক্রান্তই হবেন না। সারা দেশের পেশাজীবী বহু মানুষ গরমের অজুহাতে মাস্ক পরেন না। তাদের মাস্ক থাকে পকেটে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখানোর প্রয়োজনে।
সরকার ঘরের বাইরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করলেও এখন এ বিষয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা হচ্ছে আগের চেয়ে ধীর গতিতে। ফলে এ নিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত সচেতনতাবোধও কমছে প্রবলভাবে। অথচ বর্তমানে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মাস্ক পরলে ‘জীবাণু বহনকারী ড্রপলেট’ থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণ থামাতে পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরা উচিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ফেস মাস্ক পরলে শরীরের ভেতর অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ করোনাভাইরাস ঢুকতে পারে। সে ক্ষেত্রে হয়তো তার উপসর্গ হবে খুবই মৃদু বা আদৌ কোনো উপসর্গ দেখা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় সংক্রামক-ব্যাধি-বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একজন মানুষের সংক্রমণ কতটা গুরুতর তা জানার ক্ষেত্রে তার দেহে কী পরিমাণ ভাইরাস ঢুকেছে তা গুরুত্বপূর্ণ। তাই মাস্ক পরলে তা যে শুধু অন্যদেরই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে, তা শুধু নয়, যিনি মাস্ক পরছেন তিনিও সুরক্ষিত থাকেন।
বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাস মহামারীর কেন্দ্রস্থলগুলোতে মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা আরোপ করায় হাজার হাজার মানুষের মধ্যে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হয়েছে। দ্য প্রসিডিংস অব ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসে (পিএনএএস) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা জানান, মহামারীর বিস্তার রোধে কোনো কোনো সময় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং বাসায় থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় মাস্ক পরিধান করা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উত্তর ইতালি ও নিউ ইয়র্ক শহরে মাস্ক পরার নিয়ম জারির পর সে সময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাবের এই দুই এলাকায় সংক্রমণের প্রবণতা নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। নিউ ইয়র্কে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর নতুন সংক্রমণের হার প্রতিদিন তিন শতাংশ করে হ্রাস পেয়েছে। তাই বাংলাদেশেও মাস্ক পরার বিষয়ে সরকারের আরও সতর্ক ও কঠোর হওয়া প্রয়োজন।
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় মানুষ যখন উদাসীন হচ্ছে, ঠিক তখনই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এক উক্তি সেটিকে আরও উৎসাহিত করেছে। এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেন ‘করোনাভাইরাস বাংলাদেশ থেকে এমনিতেই চলে যাবে।’ এই ধারণার পক্ষে যুক্তি হিসেবে এরই মধ্যে দেশে সব ধরনের কাজকর্ম শুরু হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি। আরও বলেন ‘ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে কি না জানি না। কভিড-১৯ এমনিতেই বাংলাদেশ থেকে চলে যাবে। মানুষ এখন বাসায় বসেই চিকিৎসা পায়। তাই তাদের হাসপাতালে আসতে হয় না। এজন্য হাসপাতালে রোগী কম। আমরা আনন্দিত, দেশে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু হার কমেছে।’ মন্ত্রীর এমন আত্মতৃপ্তির উক্তি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের নানা উদ্যোগকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে বলে মনে করেন অনেকেই। এতে মানুষের কাছে দুই ধরনের বার্তা পৌঁছায়। একটি হলো সরকারে যারা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের কাজের সঙ্গে জড়িত, তারা মনে করবেন ভালোই যখন অর্জন করেছি বা করোনা যেহেতু চলেই যাবে, তাহলে ঢিলেঢালাভাবে কাজ চললেও অসুবিধা নেই। সুতরাং টেস্ট, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন না করলেও চলে। আর মন্ত্রীর কথায় সাধারণ মানুষ মনে করতে পারে এখন তাহলে মাস্ক না পরলেও চলবে, বাইরে যাওয়া যাবে, সমাবেশ করা যাবে, স্বাস্থ্যবিধি না মানলেও অসুবিধা হবে না প্রভৃতি।
বাংলাদেশে করোনায় সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে, নাকি কমছে? এমন প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকার প্রতিদিনই আক্রান্ত, মৃত ও সুস্থ হওয়ার সংখ্যা তথ্য প্রকাশ করছে। আগে প্রতিদিন সংবাদ ব্রিফিংয়ে তা দেওয়া হলেও এখন তা কেবলই ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু তবু কেন এ নিয়ে প্রশ্ন থাকছে? এর কারণ হতে পারে দুটি। প্রথমত, সরকারের তথ্যের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, সরকার যতই করোনা মোকাবিলায় সাফল্য ও অগ্রগতির কথা বলুক না কেন, বাস্তবতার সঙ্গে তার মিল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে, বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার পাঁচ মাসের মাথায় (৮ আগস্ট) শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। শেষ ২০ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ৫০ হাজার। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে এমন ২১২টি দেশের মধ্যে শনাক্ত রোগীর সংখ্যায় শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় ইতালিকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ এখন রয়েছে ১৫ নম্বরে। যখন লিখছি তখন দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৩ হাজার ৮২২ জনে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন করোনার গত পাঁচ মাসে আমাদের অর্জন খুব একটা নেই। বরং করোনার সংক্রমণ থেকেও আমরা তেমন শিক্ষাও নিচ্ছি না। উল্টো ভালো করছি বলে আত্মপ্রসাদে ভুগছি।
তবে বাংলাদেশে যে উচ্চহারে সংক্রমণ হচ্ছিল, সেটা কিছুটা নিচু ধাপে নেমেছে। বিশেষজ্ঞরা যাকে ‘উইন্ডো পিরিয়ড’ বলছেন। ৮ মার্চ প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয়। মার্চ-এপ্রিল আক্রান্তের সংখ্যা কমই ছিল। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে বাড়তে শুরু করেছে। জুনে এসে বেশ বেড়েছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে এখন তা কম হচ্ছে। এটা উইন্ডো পিরিয়ড। এ সময়েই নিয়ন্ত্রণে কাজ করা উচিত সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। উল্টো মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে সংক্রমণ আরও বাড়বে। সেটি হলে আর বাংলাদেশ করোনা বিস্তারের দ্বিতীয় ধাপে ঢুকলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া প্রকৃতপক্ষেই কঠিন হয়ে পড়বে। কভিড-১৯ মহামারীতে দেশের অর্থনীতি সচল রাখার যে উদ্যোগ সরকার হাতে নিয়েছে, সেটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। আর এটি বাস্তবায়নে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হারে যেন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে সবচেয়ে বেশি। মাস্ক পরাকে বাধ্যতামূলক এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করতে না পারলে করোনায় সরকারের সব উদ্যোগই মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই দায়িত্বশীলদের কথার লাগাম টানার পাশাপাশি মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে সরকারকে এখনই কঠোর হতে হবে।
ছবি: এএফপি
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৪ আগস্ট ২০২০
© 2020, https:.