কলাম

মাস্কের মান ও দাম নিয়ন্ত্রণ জরুরি

করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা শুধু বাড়ছেই। সংক্রমণ ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে তিনটি জোনে ভাগ করে লাল জোনে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। কিছু এলাকায় লকডাউন দেওয়াসহ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া সরকার ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার না করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের জেল এবং এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান করেছে। তবে জেলা প্রশাসকদের তা সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে। মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সারা দেশে পরিচালিত হচ্ছে মোবাইল কোর্টও। কিন্তু মাস্ক নিয়ে নাগরিকদের সচেতনতা কতটুকু তৈরি হচ্ছে? শুরুতে এ নিয়ে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি।

আমার বসবাস রাজধানীর কাফরুল এলাকায়। দুদিন আগে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ছোট্ট জটলায় পড়ি। সাত-আটজন তরুণ দাঁড়িয়ে হাসি-তামাশা করে একজন আরেকজনের ওপর প্রায় লুটিয়ে পড়ছে। সবারই বয়স আঠার ছুঁইছুঁই। তাদের কারও মুখেই কোনো মাস্ক নেই। আড্ডা প্রকাশ্য হওয়ায় নিজেরা ভাইরাসে আক্রান্ত ও ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সেখানে অধিক। তবুও কেন কারও মুখে মাস্ক নেই? প্রশ্ন করতেই একজন এগিয়ে এসে জবাব দিল ‘আমাদের কারোরই করোনা হইব না। তাই মাস্ক পরি না।’ এই নিশ্চয়তা কে দিল, সচেতন হয়েও তারা কেন এমন ডোন্টকেয়ার স্টাইলে চলছে? এসব প্রশ্নের মুখে ‘সরি’ বলেই কেটে পড়ে সবাই। বাজারে গিয়ে দেখলাম ফল বিক্রি করছে এক যুবক। তারও মুখে মাস্ক নেই। ওভাবেই দিব্যি ফল বিক্রি করছে। মাস্ক কোথায়? কড়া ভাষায় বলাতেই পাশের ফার্মেসি থেকে একটি সার্জিক্যাল মাস্ক কিনে আনল। তা দেখে পাশের দোকানের ছেলেটি ড্রয়ার থেকে ময়লার আস্তরণ পড়া কাপড়ের মাস্কটি বের করে দ্রুত পরে নিল। খানিক পরেই ওই দোকানে আসেন অন্যজন। আগের জনের রেখে যাওয়া মাস্কটি পরে নিয়েই দিব্যি কাজ শুরু করেন তিনি।

মাছ বিক্রির দোকানগুলোতে অনেক ভিড়। বিক্রিতাদের অনেকেরই মাস্ক ঝুলছে গলায়। মুরব্বি বয়সী এক লোক মাছ কিনছেন। তার মুখেও কোনো মাস্ক নেই। কেন? মুচকি হেসে বললেন- ‘আল্লাহই রক্ষা করব।’ ফুটপাতে বসে মাস্কবিহীন লেবু বিক্রি করছে এক যুবক। মাস্কের কথা উঠতেই বল ‘মাস্ক আছে, ভুলে আজকে বাড়িত রাইখা আসছি।’ বাজারের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করছেন নানা বয়সীরা। তাদের কারোর মুখেই মাস্ক মিলল না। বাজার মাথায় নিয়ে ঘুরছে ছোট ছোট শিশুরা। তাদের অধিকাংশই মাস্ক পরেনি।  ফেরার পথে রাস্তায় রিকশার জটলা। খেয়াল করে দেখলাম অধিকাংশ রিকশার হাতলে ঝুলছে কাপড়ের মাস্ক। মাস্ক কেন ওখানে? একজনের উত্তর ‘খুব গরম লাগে স্যার। তাই খুইলা রাখি।’ এ ক্ষেত্রে বেশ খারাপ অবস্থা পাড়া-মহল্লার হোটেল ও চায়ের দোকানগুলো।

জনসাধারণের মাস্ক পরা নিয়ে এটি একদিনের অভিজ্ঞতা। তবে আশার কথা শতকরা আশি ভাগ মানুষ খুব নিয়ম করে না হলেও মাস্ক পরছেন। কিন্তু অবশিষ্ট বিশ ভাগ মানুষের মাস্ক না পড়ার কারণে কভিড-১৯ সংক্রমণের যে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে সেটি ঠেকানো যায় কীভাবে? করোনায় মাস্ক কতটা সুরক্ষা দেয়? সম্প্রতি এ নিয়ে এক গবেষণা উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের মহামারীর কেন্দ্রস্থলগুলোতে মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা আরোপ করায় হাজার হাজার সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হয়েছে। দ্য প্রসিডিংস অফ ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসে (পিএনএএস) প্রকাশিত এই গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা জানান, মহামারীর বিস্তার রোধে কোনো কোনো সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও বাসায় থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় মাস্ক পরিধান করা। সমীক্ষায় দেখা গেছে, উত্তর ইতালি এবং নিউ ইয়র্ক শহরে মাস্ক পরার নিয়ম জারির পর সে সময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রাদুর্ভাবের এই দুই এলাকায় সংক্রমণের প্রবণতা নাটকীয়ভাবে বদলে গিয়েছে। নিউ ইয়র্কে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরার নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর নতুন সংক্রমণের হার প্রতিদিন ৩ শতাংশ করে হ্রাস পেয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, ভাইরাস বহনকারী ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা মানুষের মুখে মাস্কের আচ্ছাদনের কারণে বাতাসে ছড়াতে বাধা পায় বলেই সংক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তাই আইনের পাশাপাশি মাস্ক পরায় উদ্বুদ্ধ করতে ব্যক্তিগত সচেতনতাসহ প্রয়োজন সামাজিক উদ্যোগের। আর সেটি করতে পারলে করোনা মোকাবিলা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। এ নিয়ে কিছু আশাবাদের খবরও উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। যা আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে উৎসাহ দেয়। মুখে মাস্ক না পরা ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি না করার অভিনব প্রচারে নেমেছেন বাগেরহাটের ব্যবসায়ীরা। সেখানে মাস্ক পরা না থাকলে ক্রেতা সাধারণের কাছে পণ্য বিক্রি করা হবে না এমন প্রচারমূলক পোস্টার ছাপিয়ে দোকানে দোকানে লাগিয়ে দিয়েছেন তারা। এতে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মাঝে মাস্ক পরার সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। এমন উদ্যোগ সারা দেশে চালু হতে পারে খুব সহজেই। সামাজিক-রাজনৈতিক ও ছাত্রসংগঠনগুলোও এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া প্রয়োজন গণমাধ্যমের ব্যাপক সহযোগিতাও। সরকার মাস্ক পরার আইন প্রয়োগ করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ কোন ধরনের মাস্ক কতদিন ব্যবহার করবেন তার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি এখনো। আর মাস্কের দামের ব্যাপারেও নেই কোনো সরকারি নীতিমালা। তাছাড়া সুলভ মূল্যে বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির মানুষ যেন মানসম্পন্ন মাস্ক সহজে ক্রয় করতে পারে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। এ ক্ষেত্রে ভালো মানের মাস্ক তৈরি ও তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।

২৬ মার্চের আগে বাংলাদেশে একটি সার্জিক্যাল মাস্কের পাইকারি দাম ছিল দেড় টাকা। আর সর্বোচ্চ খুচরা দাম ছিল ৫ টাকা। এখন তা ২০ টাকার ওপরে। চাহিদার কারণে এখন নিম্নমানের মাস্কও স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে। ফুটপাতে মাস্কের মৌসুমি পসরা সাজিয়ে বসেছেন অনেকেই। যে যার মতো দাম নিচ্ছেন। মান নিয়ন্ত্রণের নেই কোনো ব্যবস্থা। এরই মধ্যে র‌্যাব এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত মাস্কের নকল কারখানাও খুঁজে পেয়েছে। ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া মাস্ক আবার ধুয়ে ও শুকিয়ে বিক্রির ঘটনাও ধরা পড়ছে কোথাও কোথাও। এটি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে মাস্ক নতুন বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে মনে করেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।

তাই মাস্ক ব্যবহারে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে হলেও সারা দেশে মাস্কের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের মাঝে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণের উদ্যোগসহ মানসম্পন্ন মাস্কের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা দ্রুত বাড়বে। এতে করোনার সংক্রমণ ঠেকানো যেমন সম্ভব হবে তেমনি স্বাভাবিক কাজ পরিচালনার মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাও সচল থাকবে।

ছবি: সংগৃহীত

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৭ জুন ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button