আদিবাসী

রানি ও তার আধফোটা ফুল

আদিবাসী লোককথা

কলাগাছে তীর বিদ্ধ করা আর লাঠি দিয়ে হাঁড়ি ভাঙ্গা সাঁওতাল আদিবাসীদের কাছে অত্যাবশ্যকীয় দুটি খেলা। এ খেলা দুটিকে তারা অশুভ শক্তির প্রতীকী বিনাশ বলে মনে করে। কিন্তু সাঁওতাল সমাজে এমন বিশ্বাসের জন্ম হলো কবে এবং কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর মিলে দিনাজপুরের মহেশপুর গ্রামের সানজিলা হাজদার কাছে। তাঁর মুখে শুনি এ নিয়ে প্রচলিত গদ্যটি। যার ভাবার্থ এমন-

কোনো এক দেশে সাঁওতালদের এক রাজা ছিল। নাম তার তখভন। সে তার রানিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। কিন্তু তারপরও রানি এক প্রেমিকের সঙ্গে গোপনে প্রণয়বন্ধনে আবদ্ধ হতো। প্রেমিক থাকত বনের একটি নির্দিষ্ট দিকে, সর্পরাজের বেশ ধরে। শুধু রানি চিনত ওই জায়গাটি। রাজা যখন শিকারে বের হতেন রানি তাকে জঙ্গলের ওই বিশেষ দিকটিতে যেতে নিষেধ করতেন। নানা প্রশ্ন করেও রাজা রানির কাছ থেকে তেমন উত্তর পেতেন না।

একবার রাজা শিকারে বের হলেন। বনে গিয়ে কৌতূহলবশত রাজা যান ওই নিষিদ্ধ বিশেষ দিকটায়। অবাক হয়ে তিনি দেখতে পান সর্পরাজকে। নিজের প্রাণ যাবে ভেবেই তিনি তীর-ধনুক দিয়ে ওই হিংস্র সর্পরাজকে মেরে ফেলেন। শিকার থেকে ফিরে রাজা সব ঘটনা রানিকে খুলে বলেন। সর্পরাজরূপি প্রেমিকের মৃত্যুর খবর শুনে ভেতরে ভেতরে রানি বেশ কষ্ট পায়। প্রেমিক হত্যার বদলা নিতে তিনি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন।

অনেক দিন কেটে গেলো। একবার রাতের আঁধারে জঙ্গলে গিয়ে রানি সেখান থেকে সর্পরাজের হাড়গোড় কুড়িয়ে এনে রাজবাড়ির বাগানে পুঁতে রাখে। বেশ কিছুদিন পর ওই জায়গা থেকে জন্মায় অদ্ভুত ধরনের একটি গাছ। ওই গাছটিতে এক সময় একটি আধফোটা ফুল ফুটে। তখন ফুলের আলোয় আলোকিত হয় গোটা বাগান।

এরপর পরিকল্পিতভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ রানি কৌশলে রাজার সঙ্গে মেতে ওঠে সর্বনাশা এক বাজির খেলায়। কী সেই বাজি? রাজাকে বাগানের সব ফুলের নাম বলতে হবে। অন্যথায় রানির হুকুমে প্রজারা রাজার প্রাণদণ্ড দেবে। রানির কথা শুনে রাজা মুচকি হাসেন! নিজের বাগানের ফুলের নাম বলাটা খুবই সহজ। এমনটা ভেবেই আত্মবিশ্বাসী রাজা বাজিতে রাজি হয়।

তারপর গ্রামে গ্রামে ঢোল পিটিয়ে এ খবর সর্বত্র জানিয়ে দেওয়া হলো। নির্দিষ্ট দিনে রাজ্যের প্রজারা বাজির খেলা দেখার জন্য রাজপ্রাসাদের বাগানে উপস্থিত হলো। রাজা একে একে সব ফুলের নাম বলতে লাগলেন। কিন্তু অদ্ভুত আধফোটা ফুলটির কাছে এসে থমকে গেলেন। ফুলটি দেখে তিনি অবাক হলেন। কিন্তু কিছুতেই অপরিচিত ফুলটির নাম বলতে পারলেন না। রাজার প্রাণ যাবে ভেবে রানি ভেতরে ভেতরে খুশি হয়। সে সময় রাজার পক্ষে প্রজারা রানির কাছ থেকে সাতদিন সময় চেয়ে নেয়।

এ খবর ছড়িয়ে পড়ে অন্য রাজ্যগুলোতে। খবর পেয়ে রাজাকে বাঁচাতে আরেক দেশ থেকে হেঁটে রওনা হয় তারই এক বোন। হাঁটতে হাঁটতে ষষ্ঠ রাতে সে বিশ্রাম নিচ্ছিল বনের ভেতর, একটি শিমুল গাছের তলায়। গাছটির মগডালে বাসা বেঁধে থাকত এক শকুনি।

গভীর রাতে হঠাৎ বোনটি শুনতে পায় শকুনি তার ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের সান্ত্বনা দিচ্ছে এই বলে যে, পরের দিনই সে বাচ্চাদের জন্য রাজার দেহের মাংস তাদের খাওয়াবে। কীভাবে তা সম্ভব? শকুনির উৎসুক বাচ্চারা মায়ের কাছে জানতে চায়। শকুনি তখন গল্পচ্ছলে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে পাড়াতে সব ঘটনা এবং ফুলের নাম ও জন্ম বৃত্তান্ত খুলে বলে।

শিমুল গাছের নিচে বসে রাজার বোন সেসব কথা শুনে নেয়। ভোর হতেই সে দৌড়ে পৌঁছে যায় রাজ দরবারে। তারপর রাজার কাছে ফুলের নামসহ সব ঘটনা খুলে বলে। সাতদিনের দিন রাজা, প্রজা ও রানির সম্মুখে বলে অদ্ভুত ওই ফুলের নাম হলো ‘কারি নাগিন হাড় বাহা’। নামটি বলতেই বাগানের ফুলটি পূর্ণ প্রস্ফুটিত হলো। রাজাও বাজির খেলার প্রাণদণ্ড হতে মুক্তি পেলেন। এরপর রাজার মুখে সব ঘটনা জেনে ক্ষুব্ধ প্রজারা রানিকে শাস্তি দেয়।

এ ঘটনার পর থেকেই যে কোন উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতায় কলাগাছে তীর বিদ্ধ ও লাঠি দিয়ে হাঁড়ি ভাঙ্গা সাঁওতালদের কাছে অত্যাবশ্যকীয় দুটি বিষয়। যুগে যুগে এসব কাহিনি আর বিশ্বাসের গদ্যগুলোই আদিবাসীদের প্রেরণা হয়ে আছে, যা বাঁচিয়ে রেখেছে আদি মানুষগুলোকে।

অলঙ্করণ: সমর মজুমদার

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১২ আগস্ট ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button