আদিবাসী

পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস

আদিবাসী লোককথা

পৃথিবী কীভাবে সৃষ্টি হলো? গারো আদিবাসীদের বিশ্বাস শুরুতে চারদিকে ছিল পানি আর পানি। কোথাও স্থলের চিহ্ন নেই। সবকিছু অন্ধকারে আচ্ছন্ন।

এমন অবস্থা দেখে ভগবান তাতারা রাবুগা পৃথিবী সৃষ্টির ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি নস্ত নুপাস্তকে স্ত্রীলোকের আকার দিয়ে পাঠালেন। সঙ্গে দিলেন কিছু বালি।

নস্ত নুপাস্ত প্রথমে মাকড়সার জালে আশ্রয় নিয়ে সমস্ত জলরাশির ওপর সে জাল বিস্তার করলেন।

তারপর তিনি সঙ্গে আনা বালি মুষ্টিবদ্ধ করে পানিতে নিক্ষেপ করে বললেন, অনন্ত জলরাশির নিচ থেকে মাটি নিয়ে এসো।

যথা সময়ে মাটি আসলো এবং নস্ত নুপাস্ত সে মাটি দিয়ে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। গারো ভাষায় একে বলে ‘মেন পিলটি

পৃথিবী সৃষ্টির পর ভগবান তাতারা রাবুগার কাছে তা ভিজে মনে হলো। তাই তিনি তা শুকাতে আসিমা দিংগাসীমার পুত্র ও কন্যাকে স্থাপন করলেন পৃথিবীতে। এরাই সূর্য (রেঙ্গরা বলসা) ও চন্দ্র (বীরে জিতজে)। তাই গারোদের কাছে চন্দ্র ও সূর্য ভাই-বোন।

চন্দ্র কেন কম আলো দেয়? চন্দ্র ছিল খুবই সুন্দরী। ভাই সূর্য থেকে ছিল অনেক বেশি উজ্জ্বল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তৈরি হতো মনোমালিন্য। সূর্য বোনের রূপলাবণ্যে হিংসা করতো। দুই ভাইবোনে ঝগড়া চলে হরহামেশাই। তাদের মা তা থামাতেন।

একদিন তাদের বাড়িতে রেখে জরুরি কাজে মা গেলেন বাইরে। সে সুযোগে ভাইবোনে শুরু হয় তুমুল ঝগড়া। সে ঝগড়া রূপ নেয় হাতাহাতিতে। ক্ষেপে যায় সূর্য। মুঠি ভরা কাদা নিয়ে বোন চন্দ্রের মুখে তা লেপ্টে দেয় সে। এতে বোনও রেগে যায়। ভাই সূর্যকে শায়েস্তা করতে হবে। তাই মুখের কাদা না ধুয়ে অপেক্ষা করে মায়ের জন্য।

মা বাড়িতে আসতেই চন্দ্র কাদা মাখা মুখ দেখিয়ে জানায় ভাইয়ের কুকীর্তির কথা। মা এতে খুশি হন না। বরং চন্দ্রের এমন প্রতিহিংসা পরায়ণ আচরণে ক্ষেপে গিয়ে মেয়ে চন্দ্রকে অভিশাপ দিয়ে বলেন- চিরদিনই তোমার মুখ যেন এমনি কর্দমাক্ত থাকে। গারো আদিবাসীদের বিশ্বাস সে থেকেই সূর্যের চেয়ে কম আলোর অধিকারিণী হয়েছে চন্দ্র।

মাচাং ঘর এলো কীভাবে? সে অনেক কাল আগের কথা। এক গারো নারী জন্ম দেন দুটি জমজ পুত্র। দুই ভাইয়ের বেজায় ভাব। বড় হয়ে তারা হয় অসীম সাহসী। মানুষ তাদের বীর বলে সম্বোধন করতো। একবার ভাইদের একজন দেশজয়ের উদ্দেশে যাত্রা করে পূর্বদেশে। যাত্রার পূর্বে সে অপর ভাইকে গ্রাম ও গোষ্ঠী রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে যায়।

ভাইয়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে ওই ভাই। পাশাপাশি নানা আচার পালনের মাধ্যমে গোষ্ঠী রক্ষায়ও কাজ করে। অনেকদিন কেটে যায়। ভাইটি যেন নিরাপদে ফিরে আসে সে প্রহর গুণতে থাকে সবাই।

গ্রামে থাকা ভাইটি কখনও মাটিতে লম্বা হয়ে ঘুমাতো না। তার বিশ্বাস জমজ হওয়ায় তার দেহে ও মাথায় ধুলাবালি লাগলে অপর ভাইয়েরও অমঙ্গল হবে। তাই সে দাঁড়ানোর অবস্থায় কোন কিছুর সঙ্গে হেলান দিয়েই ঘুমাতো।

ছেলের এমন কষ্ট দেখে মায়ের মন কাঁদে। তিনি ছেলের জন্য মাচং ঘর তৈরি করেন যাতে সে ধুলাবালির সংস্পর্শ এড়িয়ে আরামে ঘুমাতে পারে। গারো আদিবাসী সমাজে সেটিই ছিল প্রথম মাচাং ঘর। সে সময় সমাজের লোকেরা ওই মাকে সম্মানের সঙ্গে ডাকতেন ‘চাংমা’ অর্থাৎ মাচাং ঘরের মা বলে। কালক্রমে চাংমা সম্বোধনটি সাংমাতে রূপান্তরিত হয়। পরে ওই মায়ের বংশধরেরা সাংমা হিসেবে পরিচিতি পায়।

অলঙ্করণ: সমর মজুমদার

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button