অন্তর্জালে সাহিত্যচর্চা
বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। প্রাসঙ্গিক হওয়ায় লেখার শুরুতেই সেটি তুলে ধরছি। বইমেলায় পরিচিত এক তরুণীর বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে ছিল আয়োজনটি। লেখক সম্পর্কে ছোটবোন। লেখালেখি করেন অনলাইন প্লাটফর্মে, ফেইসবুকের কয়েকটি গ্রুপ ও ব্লগে। তবে তার লেখার মান বেশ। মোড়ক উন্মোচনে অতিথি ছিলেন একাধারে প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার ও টিভি উপস্থাপক। তার কাছে আগেই বইটি পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি বক্তৃতায় নানা যুক্তি তুলে ধরলেন বইটি ও লেখকের অনলাইনে লেখালেখির বিরুদ্ধে।
তার মতে, অনলাইনে যে সাহিত্য চর্চার চেষ্টা হচ্ছে তা মূলত সাহিত্যের বারোটা বাজাচ্ছে, এগুলো কোনো সাহিত্য নয়। লেখালেখির জন্য উপযুক্ত জায়গা অনলাইন নয়। সাহিত্যের মান বাঁচাতে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা উচিত বলেও মত দেন। হয়তো অজ্ঞতা, নয়তো গোঁড়ামি। এছাড়া কী কারণে ওই অতিথি অনলাইন প্লাটফর্মকে কোনোভাবেই পজেটিভলি মেনে নিতে পারলেন না তার উত্তর খুঁজেছি বহুদিন।
অনুষ্ঠানে যারা ছিলেন তারা সবাই লেখকের কাছের মানুষ ও অনলাইনে নানা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। সৌজন্যবশত কেউ সেদিন অতিথির বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে অতিথির কথা ও আচরণে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।
এলো কভিড-১৯ এ। ওই অতিথিকেই দেখলাম দিব্যি লেখালিখি করছেন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ফেইসবুকের সাহিত্যকেন্দ্রিক কিছু গ্রুপে। শুধু তাই নয়, আলোচনা অনুষ্ঠানও চলছে অনলাইনে। চলছে তার বিভিন্ন বইয়ের আলোচনা ও অনলাইন বিপণনও।
তাহলে অতিথি কি তার নিজের ভুলটি বুঝতে পেরেছেন? সময়কে ধরে রেখে নিজেকে দিয়েই সব বিচার ও বিবেচনা করতে নেই। সময় শিল্প-সাহিত্য ও ভাষাকে যেমন বদলে দেবে, তেমনি বদলে দেবে এর প্ল্যাটফর্মও। তাই লেখা কোথায় প্রকাশ পেল, কোথায় পাঠক বেশি পড়ল, সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রকৃত অর্থেই লেখার গুণ বিচার প্রয়োজন।
পুরনো সময়টা এখন নেই। অনলাইনে রয়েছে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার ছোট-বড় অংসখ্য গ্রুপ। ফলে এখানে যুক্তদের এখন আর খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বরং যারা যুক্ত থেকে সাহিত্য ও সৃজনশীলতার চর্চা করছেন তাদের হাত ধরেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে আমাদের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি।
এখন অনলাইনে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় আলোচিত পেন্সিল নামক গ্রুপটি। মূলত বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষীদের অনন্য প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছে এটি। কীভাবে শুরু হলো পেন্সিল? এর অগ্রযাত্রার কাহিনী হয়তো অনেককেই উৎসাহিত করবে।
পেন্সিলের ফেইসবুক গ্রুপ ও ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে মননে ও মানসিকতায় মেলবন্ধন খুঁজে পাওয়া কিছু মানুষের স্বপ্ন নিয়ে গড়ে ওঠে পেন্সিল। আলো ছড়ানো, পরিচ্ছন্ন মতবিনিময়ের জন্য লেখিয়ে এবং পাঠকদের নিয়েই শুরু হয় এটি। নানা বয়সের, নানা মতাদর্শের, নানা রঙের মানুষের সমাবেশ এখানে। বলা যায় স্বপ্ন, আবেগ এবং প্রত্যাশার সমন্বয়ের নাম পেন্সিল। যা লাখো মানুষকে আলোকিত করছে। এদের চাওয়া-পাওয়াও খুব সামান্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি জীবনের সময়গুলোকে সৃজনশীলতায় পূর্ণ করে একটি নান্দনিক সমাজ গড়ে তোলা।
স্বরচিত গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, জোকস, ট্রাভেলগ, নিজের তোলা ছবি, নিজের গাওয়া গান, নিজের করা আবৃত্তি, ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ক এবং নিজের রান্না, আইনি বৃত্তান্ত, স্বাস্থ্য টিপস, ইন্টেরিয়র প্রভৃতি নিয়ম মেনে পোস্ট করা যায় পেন্সিলের ফেইসবুক গ্রুপে। বাংলা ভাষাভাষী লেখক, গায়ক, চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্রশিল্পীসহ ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির সৃজনশীল কিছু মানুষ নিয়ে পেন্সিলের যাত্রা ২০১৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বরে। বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্তদের সংখ্যা দুই লাখ আটাশি হাজার ছয়শো জন। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে বসবাসরত বাঙালিরা যুক্ত রয়েছেন এখানে।
কেবল অনলাইনেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি এরা। অফলাইন কার্যক্রম এগিয়ে নিতে গড়ে তুলেছেন পেন্সিল ফাউন্ডেশন। শুরু থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে বই ও ম্যাগাজিন প্রকাশ করলেও এর প্রকাশনা বিভাগ ‘পেন্সিল পাবলিকেশনস’ নামে নিবন্ধিত হয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশ নেয় ২০১৯ সালে। বাঙালির স্বাধিকার চেতনার প্রথম সোপান ভাষা আন্দোলনকে সম্মান জানিয়ে তারা ‘বই বায়ান্ন’ স্লোগানে ৫২টি বই প্রকাশ করে ওই বছর। একইভাবে ২০২০-এর গ্রন্থমেলায় ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের স্মারকসংখ্যা বিবেচনা করে পেন্সিল ‘বই চুয়ান্ন’ স্লোগানে প্রকাশ করে ৫৪টি বই। শুধু সাহিত্য নয় শিল্পচর্চার অংশ হিসেবে এরা শুরু থেকেই সদস্যদের তোলা ছবি নিয়ে নিয়মিতভাবে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে আসছে। যা ফটোগ্রাফি চর্চায় অনেককেই উৎসাহিত করেছে।
পেন্সিল মানবিক কাজেও পিছিয়ে নেই। বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, করোনার মহামারীতে সাধারণ সদস্যদের থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে ৫০০টি পরিবারকে সহায়তা প্রদান, বৃক্ষরোপণের কর্মসূচির আয়োজন করা এবং দেশীয় ও পরিযায়ী পাখির নিরাপদ অবস্থানের জন্য জনসাধারণকে সচেতন করতে রাজশাহীর পদ্মার পাড়ে সাইনবোর্ড স্থাপন প্রভৃতি কাজ করেছে পেন্সিল ফাউন্ডেশন।
পেন্সিলে মানুষ স্বচ্ছন্দ্যে মন খুলে লিখতে পারে। অনেকেই ওই লেখা নিয়ে আলোচনা করেন। লেখা ও আলোচনায় অংশ নিতে পারেন সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষীরা। ফলে ব্যাপক পরিসরে অনলাইনে বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার একটি ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। আগে যেটি হতো বিভিন্ন পাঠচক্রের আসরে।
একেক মানুষের চিন্তা ও সৃজনশীলতা একেক রকম, একেক রঙের। এভাবে লাখো মানুষের চিন্তা, চেতনা ও ভালোবাসার রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে পেন্সিল গ্রুপটি। যা আমাদের আশা জাগায়, ভালো কাজের প্রেরণাও জোগায়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ সময়টাতে অনলাইনে সক্রিয় অনেকগুলো সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গ্রুপ। চাইলে পেন্সিলের মতো কাজ করে তারাও ঐক্যবদ্ধ করতে পারে সৃজনশীল লাখো বাঙালিকে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০
© 2020, https:.