শিক্ষক হিসেবে আব্বা চাকুরি পান ঢাকার গোপীবাগে, রামকৃষ্ণ মিশন হাইস্কুলে। সে সুবাদে ষাটের দশকেই আমরা চলে আসি ঢাকায়। স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি পশ্চিম নাখালপাড়ায়, বাড়ি নম্বর ছিল ৩৩৮/১। ওই এলাকাটি তখন ছিল ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অধীনে।
আব্বা নামাজি ছিলেন, তার হাত ধরেই মসজিদে যেতাম। ধর্ম পালন করলেও আব্বার গোঁড়ামি ছিল না কখনও। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন। রামায়ণ ও মহাভারত কিনে এনে বলতেন পড়তে। আমাদের বাড়িতে যারা কাজ করতেন তারা বেশির ভাগই ছিলেন গ্রামের হিন্দু পরিবার। ঢাকায় ডেকে এনে আব্বা তাদের কাজ দিয়েছেন। টিনের একটা ঘরও তুলে দেন থাকার জন্য।
গ্রামের সবাই আব্বাকে সম্মান করত। জয়পুরে ঈদের জামাত কে পড়াবেন? এ নিয়ে সমস্যা হতো মাঝেমধ্যে। দলবেধে সবাই তখন আব্বার সঙ্গে দেখা করতেন। বলতেন– ‘মৌলভী সাব’ এইবার আপনিই ঈদের জামাতটা পড়াবেন।’
ধর্মীয় বিষয়ে রেষারেষি তখন ছিল না। নাখালপাড়াতে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের বন্ধুরা ছিল। ওদের অনুষ্ঠানে আমরা যেতাম। ওরাও সবসময় আমাদের বাড়িতে এসে খাওয়া-দাওয়া করত। মৌলভী হলেও এ নিয়ে আব্বা কিছু বলতেন না। জাত যাওয়ার ভয়ও তখন ছিল না। এখন তো ধর্মীয় ব্যাপারে রেষারেষি বেড়েছে রাজনৈতিক কারণেই।
স্কুলের পরেও আব্বা দুর্বল ছাত্রদের বাড়িতে গিয়ে পড়িয়ে আসতেন। কিন্তু এর জন্য কোনো টাকা নিতেন না। তবে দুয়েক বাড়ি থেকে মাঝেমধ্যে পাঞ্জাবি কিনে দিত। তবুও টাকার বিনিময়ে পড়ানোর রীতি একেবারেই ছিল না।
বাবার স্মৃতিচারণ এভাবেই করছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. শহিদউল্লাহ্। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে শৈশব, কৈশোর ও যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।
মৌলভী আব্দুস সোবহান ও অজিফা খাতুনের পঞ্চম সন্তান মো. শহিদউল্লাহ্। তাদের বাড়ি কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার জয়পুর গ্রামে হলেও সবাই স্থায়ীভাবে থাকতেন ঢাকার নাখালপাড়ায়। তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি নাখালপাড়া হোসেন আলী হাই স্কুলে। এর পর তিনি পড়াশোনা করেন রাজাবাজারের রোটারি প্রাইমারি স্কুল, নাজনীন স্কুল ও মহাখালীর আইপিএস স্কুলে। ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৬৯ সালে, মুসলিম মর্ডান একাডেমি থেকে। এর পর তিনি ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন জিন্না কলেজে (বর্তমান তিতুমীর কলেজ)। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহিদউল্লাহ্ ছিলেন ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।
ছাত্র অবস্থায় নানা ঘটনার কথা তুলে ধরেন শহিদউল্লাহ্–
‘স্কুলে আমার হাতের লেখা ছিল সবচেয়ে ভাল। তখন দেওয়াল পত্রিকা লিখতে হতো। এভাবে লেখা ও আল্পনা আঁকার প্রতি ঝোক তৈরি হয়। বন্ধু রাকিবের হাতের লেখা ও আল্পনা ছিল অসাধারণ। সে কারণেই দেশ স্বাধীনের পরে রাকিব রেখায়ন ও আমি চিত্রায়ণ নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি।
মহাখালীতে তখন ছাত্রনেতা ছিলেন ওবায়দুর রহমান ভাই। মূলত তার হাত ধরেই আমরা ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হই। মিছিল-মিটিংয়ে যেতাম। হাতের লেখা ও আল্পনা আঁকতে পারায় আমার ও বন্ধু রাকিবের কদর ছিল বেশ। ঊনসত্তরের আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার পোস্টার লিখেছি। যেখানে দরকার নিয়ে যাওয়া হতো। ওখানে থেকেই পোস্টার ও চিকা মারা (দেওয়াল লিখন) এবং পথে আল্পনা এঁকে দিতাম। রাতে ঘুমাতাম জহুরুল হক হলে। খাওয়া-দাওয়াও ওখানে। আম্মা মাঝেমধ্যে রাগ হতেন। কিন্তু আব্বা তাকে বোঝাতেন– দেশের এ সময়ে ছাত্ররা এগুলো একটু করবেই।’
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের বিষয়গুলো শহিদউল্লাহরা শুনতেন তার বাবার মুখে। কিন্তু বাস্তবেও সে বৈষম্য ও অবহেলার শিকারও হয়েছিলেন তারা।
কীভাবে?
তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ছিল বিটাকলা কোম্পানি। শহিদউল্লাহ্ বলত পানি ফ্যাক্টরি। সোডা ওয়াটার বানানো হতো ওখানে। ওই কোম্পানির নিরাপত্তায় থাকত বিহারী ও পাকিস্তানিরা। বিটাকলা খেতে শহিদউল্লাহ্ গেলেই তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। মাদারচোদ, বাইনচোদ বলে গালাগালি করত ওরা। শহিদউল্লাহ্ তখন প্রতিবাদ করত। মাঝেমধ্যে চলত হাতাহাতিও। পাকিস্তানি ও বিহারীদের দোকানে গেলেই তারা বাঙালিদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করত তখন। এসব ছোট ছোট ঘটনা শহিদউল্লাহ্সহ অন্যদের মনে ঝড় তোলে। পাকিস্তানিদের হটাতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তারা যুক্ত হয় আন্দোলন সংগ্রামে।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে শহিদউল্লাহ্ ছিলেন ছাত্রলীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি, শহিদ মাহমুদ সেক্রেটারি। ওখানে জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতা তখন ছিলেন রুহুল আমিন ভূঁইয়া। পদ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কর্মীদের সংগঠিত করে মিছিল-মিটিং করা, পোস্টার ও দেওয়াল লিখনই ছিল তাদের প্রধান কাজ।
সত্তরের নির্বাচনে নাখালপাড়া হাই স্কুলে আওয়ামী লীগের পক্ষে পোলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন শহিদউল্লাহ্। সারাদেশে নির্বাচনে জয় লাভ করলেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। শহিদউল্লাহ্ তখন যুক্ত হয় অসহযোগ আন্দোলনে।
মার্চ মাসের কথা। সারাদেশ তখন উত্তাল। ওই সময়ের একটি অজানা ইতিহাসের কথা তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা শহিদউল্লাহ্। তার ভাষায়–
‘ক্যান্টনমেন্টে এখন যেখানে হাজী মহসিন তখন সেখানে ছিল এমওডিসি (মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স কোর)। সামরিক স্থাপনা রক্ষার দায়িত্ব ছিল এ কোরের। সেখানে চাকরি করতেন ল্যান্স নায়েক আনিসুর রহমান, সম্পর্কে তিনি ভাই হতেন।
সে সুবাদে আমি ও জব্বার সাহেবের ছেলে বন্ধু হাশেম নিয়মিত সেখানে যেতাম। সুবেদার শামসুদ্দিন, সুবেদার মেজর শামসু, হাবিলদার আইয়ুব আলী (পরে হাতিমারা ক্যাম্পে ট্রেনার ছিলেন) প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারা আমাদের সিনেমার টিকিট দিতেন। ফলে প্রতি সপ্তাহে যেতাম গ্যারিসন হলে। এভাবে ওখানকার অনেকের সঙ্গেই ঘনিষ্টতা তৈরি হয়। গোপনে তাদের সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি নিয়েও চলত নানা আলোচনা।
ভিডিও : মার্চের শুরুতেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে নাখালপাড়ায় অস্ত্র সরাতে থাকে কয়েকজন বাঙালি সেনা
মার্চের প্রথম দিকের কথা। বঙ্গবন্ধু তখনও ভাষণ দেননি। এমওডিসির একটি গ্রুপ গোপনে কয়েকদিনে আর্মস ও অ্যামুনেশন সরিয়ে আমাদের বাড়িতে এনে জড়ো করতে থাকে। বাড়িটিকে তারা নিরাপদ মনে করতেন। আম্মাও তাদের আদর করতেন খুব। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা এটি করেছিলেন। আমাদেরও বিপদে পড়ার ভয় ছিল। তবুও দেশের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করে ঝুঁকি নিয়েছিলাম। তারা কয়েকজনকে এখানেই পিস্তল চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। অস্ত্র সরানোর পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বীরপ্রতীক মতিউর রহমান, গোলাম নবী, আনোয়ার, আব্দুল মজিদ, শাহজাহান, আনিসসহ দশজনের মতো। তারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপক্ষোয় ছিলেন। কিন্তু তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দেওয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমাদের বাড়িতে রাখা ওই অস্ত্রগুলো নিয়েই তারা মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। এ ইতিহাস কোথাও পাবেন না, ভাই। তুলে ধরাও হয়নি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের যুদ্ধের কথাও জানাতে হবে প্রজন্মকে।
এ বিষয়ে কথা বলি বীরপ্রতীক মতিউর রহমানের সঙ্গেও। একাত্তরের এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন– ‘সত্তরের নির্বাচনের পর পাকিস্তানিরা যখন ক্ষমতা দিলো না তখনই আমরা বুঝে যাই যুদ্ধটা অনিবার্য। পাকিস্তানি সেনাদের প্রস্তুতিটাও ভেতর থেকে টের পাচ্ছিলাম। ফলে মার্চের শুরুতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রেনেড রাইফেল, এসএলআর, এলএমজিসহ প্রায় ২৫টি অস্ত্র ও অ্যামুনেশন সরিয়ে নিই। তখন তো বাড়িতে অস্ত্র রাখার মতো সাহসই কেউ করত না। কিন্তু ঝুঁকি জেনেও নাখালপাড়ায় শহিদউল্লাহ্ এগিয়ে এসেছিলেন। তাদের বাড়িটাই ছিল আমাদের গোপন ঘাঁটি।’
২৫ মার্চের আগেই খবর ছিল পাকিস্তানি সেনারা কিছু একটা করবে। ফলে শহিদউল্লাহ্ও প্রস্তুতি নেয়। রুহুল আমিন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে সংগ্রহকৃত কিছু বন্দুক চলে আসে তাদের হাতে। ২৫ মার্চের সন্ধ্যার দিকে তারা গাছ কেটে বেরিকেড দেয় নাখালপাড়ার লুকাসের মোড়ে। রাতে দেখেন পাকিস্তানি আর্মিদের সাজোয়া যান বেরোচ্ছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে। রাতভর চলে গুলির শব্দ। বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখা যায় আগুনের লেলিহান শিখাও।
তখন আপনারা কী করলেন?
শহিদউল্লাহ্র উত্তর: ‘ওরা এভাবে মানুষ মারবে, আমার ভাবতেও পারিনি। পাকিস্তানি সেনারা আগেই অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান বসিয়েছিল এখানকার কয়েকটি টিলাতে। শাহিনবাগে ছিল দুইটি, প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান কার্যালয়ের কাছে একটি ও পুরাতন বিমান বন্দরের ওখানে ছিল একটি। ২৬ মার্চ ১৯৭১। সকালবেল। অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গানের দায়িত্বরতরা পুরাতন বিমান বন্দরের কাছে একজনকে গুলি করে মারে। পশ্চিম নাখালপাড়ার আট নম্বর রোডে থাকতেন এক সিইও, নাম মজিবুর রহমান। পাকিস্তানি সেনারা তাকেও হত্যা করে ফেলে রাখে। রেললাইনের পাশেও মিলিশিয়ারা গুলি করে মারে একজনকে। তখন কারফিউ চলছিল। লাশগুলো নেওয়ারও কেউ নাই। খবর পেয়ে আমি, জামাল, লতিফসহ কয়েকজন লাশ তিনটি ছাত্রলীগের অফিসে এনে প্রথম রাখি। নাখালপাড়া কবরস্থানের পাশেই ছিল অফিসটি। এরপর বিকেলের দিকে কাফনের কাপড় সংগ্রহ করে এক কবরে দুইজনকে এবং আরেক কবরে একজনকে মাটি দিই।’
ওখানে স্বাধীনতাবিরোধী কারা ছিল?
‘পিসকমিটির লোকেরা। ওরা বেশ ক্ষমতাধরও ছিলেন। নাখালপাড়ায় পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মাহবুবুর রহমান গোরহা। উনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীরও বড় নেতা। গোরহার লগেই পাকিস্তানি সেনারা থাকত। পূর্বপাকিস্তান জামায়াতে ইসলামের হেডকোয়ার্টার ছিল নাখালপাড়ায়। উনারাই পরে রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে।
গোরহা একদিন আমাকে ডেকে বলেন– ‘তুই ভালো মানুষের পোলা। তুইও আয় পিস কমিটিতে।’ আব্বাকে বলতেন– ‘ছেলেকে বোঝাও। তার কী চাই? তাই-ই পাবে।’
তারে ঘৃণা করতাম আমরা। গালাগালিও করছি। রক্ত তখন গরম ছিল। ভয় হইত না।
যুদ্ধ তখন চলছে। আমরাও ঢাকাতে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা কাজে যুক্ত। এ খবর যায় গোরহার কাছে। একদিন আব্বাকে বলেন– ‘তোমার ছেলেকে একটু পাঠাও।’
গেলাম তার কাছে। আমার ওপর খুব ক্ষেপা। বললেন– ‘তুই তো নাকি মুক্তিবাহিনী করস। তোরে তো ধইরা নিয়া মাইরা ফালাইব।’
বলেই কিছুক্ষণ ধমকালেন। তখনই বুঝে যাই এলাকায় থাকা ঠিক হবে না। বন্ধু আলীর বাসা ছিল নাখালপাড়া লিচু বাগানে। ভয়ে রাতে ওদের বাড়িতে গিয়ে থাকতাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রও শুনতাম। একদিন বন্ধু আলীকে নিয়েই চলে যাই মুক্তিযুদ্ধে।’
কোন মাসে?
তিনি বলেন– ‘জুনের দিকে। মামার বাড়িতে যাই প্রথমে, কুমিল্লার দাউদকান্দির লালপুর গ্রামে। সেখান থেকে শাকতলা হয়ে বর্ডার ক্রস করে যাই সোনামুড়া রিক্রুটিং ক্যাম্পে। আলী আর স্বর্ণকার সেহের আলী সঙ্গে থাকলেও ক্যাম্প থেকেই ওরা বাদ পড়ে।
রিক্রুট করা হয় প্রায় ৬০-৭০ জন। তিনটি সেকশন করে একটি সেকশনের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় হাতিমারা ক্যাম্পে। ওখানে খুব কষ্ট ছিল। ২০০ জনের খাবার রান্না হলে লোক হতো ৪০০ জন। থাকার জায়গাও নাই। লোক শুধু বাড়ছেই। কষ্টে অনেকেই পালিয়ে গেছে ক্যাম্প থেকে।
১৫-২০ দিনের মতো ছিলাম ওখানে। প্রাথমিক কিছু ট্রেনিংও হয়। আমরা ছিলাম এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার)। পুলিশ, আনসার, আর্মি ও ইপিআর সদস্যরা ছিলেন এমএফ (মুক্তিফৌজ)। মাঝেমধ্যে তাদের সঙ্গে অপারেশনে যেতে হতো কুমিল্লায়। অস্ত্র ছিল কম, ১০-১৫টা রাইফেল আর একটি এলএমজি। এগুলোও থাকত মুক্তিফৌজের হাতেই। এফএফদের কাছে থাকত শুধু লাঠি। তবুও সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতাম। শেলিংয়েও তখন মারা গেছে বহু এফএফ। শহীদ হওয়া ওই মানুষগুলোর বাবা-মা আজও জানে না তার সন্তানের কি হয়েছে! শহীদের তালিকাতেও নেই তাদের নাম। ওদের কথা মনে হলেই কষ্ট পাই।’
ট্রেনিং নিলেন কোথায়?
‘একদিন ক্যাম্পে আসেন কর্নেল বাকচি। দশ-বারোজনকে বাছাই করলেন। বিভিন্ন ক্যাম্প থেকেও নেওয়া হলো আরও লোক। এরপর পাঠানো হয় আসামের লোহারবন ক্যাম্পে। আটাশ দিন হয় বেসিক ট্রেনিং আরও বাইশ দিন ছিল জেএলডাব্লিউ (জুনিয়ার লিডার উইং) নামক বিশেষ প্রশিক্ষণ। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটরা) নম্বর ছিল ই-৭৮৯৮।
আসামের লোহারবন ট্রেনিং ক্যাম্পের তথ্য ফরম। যা শহিদুল্লাহ্ সংগ্রহ করেন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে।
এক টিমে ১২ বা ১৪ জনের মতো ছিলাম। প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন বাঘা আর কমান্ডো অফিসার ছিলেন রাজপুত। তারা খেয়াল রাখতেন আমাদের যেন কোনো কষ্ট না হয়। বাকচি স্যার অনেক আন্তরিক ছিলেন। তিনি বলতেন– ‘বাঘের বিরুদ্ধে তোমরা চুয়া। তাদের সাথেই তোমরা যুদ্ধ করতে যাবে। এখানে যদি ফাঁকি দাও তাহলে প্রথমেই মারা পড়বা। ফাঁকি দিও না।’
শহিদুল্লাহদের ট্রেনিং ছিল বেশ কঠিন, কমান্ডো ট্রেনিং। থ্রি নট থ্রি থেকে সব অস্ত্র চালানো শিখানো হয়। এক্সপ্লোসিভের ওপরও ছিল বিশেষ প্রশিক্ষণ। তাদের কশম প্যারেড হয় লোহারবনেই। সেখান থেকে অস্ত্র দিয়ে পাঠানো হয় চার নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাব-সেক্টরে। কমান্ডার ছিলেন মাহবুবুর রব সাদী।
শহিদুল্লাহ, আব্দুল খালেক রতন (বাড়ি ঢাকার কলাবাগান), দেলোয়ার হাসান (বাড়ি চাঁদপুরে), রব ভাই (সিআর দত্তের ভাষায় সিভিলিয়ান রব), মোখলেসুর রহমান প্রমুখ সাতজন সাতটি দলের নেতৃত্ব দিতেন। সবাই ছিলেন এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট। তাদের বলা হতো সেভেন স্টার্স। ইন্ডিয়ান আর্মিরা নির্দেশ দিলেই তারা টিম নিয়ে অপারেশন চালাতেন। একবার মাইন ও এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেন সিলেটের কানাইঘাটের ব্রিজটি। এর পর অপারেশন করেন একটি চা বাগানে। প্রথম দিকে ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করেই ক্যাম্পে ফিরে আসতেন। ভেরিফাই পিস্তল থাকত তাদের সঙ্গে। পরবর্তীতে তারা অংশ নেন সম্মুখযুদ্ধে।
ভিডিও : সিলেটের আটগ্রাম অপারেশনের বর্ণনা করছেন মুক্তিযোদ্ধা শহিদউল্লাহ্
এক অপারেশন রক্তাক্ত হন এই বীর। পাকিস্তানিদের শেলের স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয় তার ডান পায়ের হাঁটুর ওপর ও বাম পায়ের বিভিন্ন জায়গায়। ওই দিনের আদ্যোপান্ত শুনি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল্লাহ্র মুখে। তার ভাষায়–
‘নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। জৈন্তার কাছাকাছি দরবজ নামক জায়গায় একটা ক্যাম্পে ছিলাম আমরা। ওখানে দুইট কোম্পানি সংগঠিত করেন সিআর দত্ত ও রব স্যার। তাদের সঙ্গে ছিলেন আরও দুইজন ক্যাপ্টেন।
পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল আটগ্রামে। একবার ইন্ডিয়ান আর্মিদের সঙ্গে গোলাগুলির পর তারা উইথড্রো করে ক্যাম্প নিয়ে যায় গাঙ্গের ওপাড়ে। ছোট ছোট বাঙ্কার করে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে সেখানে।
কিন্তু ওদিক দিয়েই আমাদের এগোতে হবে সিলেট টাউনের দিকে। রেকি বলেছিল ওখানে কোনো পাকিস্তানি সেনাদের বাধা নেই। তাই আমরা রওনা দেওয়ার পরিকল্পনা করি। সবকিছু ব্রিফ করা হলো। সেকশন, প্লাটুন, কোম্পানিও ভাগ হয়। জৈন্তা থেকে বড় বড় হাওর পার হয়ে এগোতে হবে। মাঝেমধ্যে ছিল গাছগাছালি পূর্ণ টিলাও।
দুই কোম্পানি মুভ করে রাত তিনটার দিকে। হাওর পেরিয়ে অ্যাডভান্স হচ্ছি। আটগ্রামের কাছাকাছি আসতেই গাঙ্গ পড়ে। কিন্তু সেটি পার হওয়ার কোনো উপায় ছিল না। রেকির খবর ছিল ভুল। দেখলাম পাকিস্তানি সেনারা পজিশন নিয়ে বসে আছে। এপার থেকে ওদের এলএমজির ব্যারেলগুলোও দেখা যাচ্ছে। পজিশন নেওয়ার আগেই ওরা ফায়ার ওপেন করে।
কী করব এখন? বলা হলো খানিক পেছনে গিয়ে পাশের গ্রামে ঢুকে পড়ার জন্য। তাই করি। গ্রামে ঢুকতেই ভোর হয়ে আসে। টাইমিংটাও সুবিধার ছিল না।
আমি পাকিস্তানিদের টার্গেটে ছিলাম। তুমুল গুলি ও আর্টিলারিতে ওরা গোটা গ্রাম ঝাঁঝরা করে দেয়। পেছনে এমএমজি হাতে ছিল দুইজন। সম্পর্কে তারা পিতা-পুত্র। শেলের আঘাতে দুজনই স্পটে শহীদ হন।
ওই গ্রামের গাঙ্গের মুখেই আমি। পাশে কয়েকটা গাছ। গাছটাতে চু চু করে গুলি এসে লাগছে। আমি একবার গাছের পেছনে আবার সাইডে নিজেকে লুকাই। এর মধ্যেই এলএমজি নিয়ে কয়েকটা ফায়ার দেই। কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে দেখি আশপাশে কেউ নেই। ভাবলাম পেছনে আছে। কিন্তু না, সেখানেও নেই। সবাই উইথড্রো করে চলে গেছে।
প্রথমে ভয় পেয়ে গেলাম। পাকিস্তানি সেনারা আমাকে টার্গেট করে ফায়ার করছে। অনেকের লাশও পড়ে আছে এদিক-ওদিক। একসময় তারা শেলিং করতে থাকে। নিয়ম হলো ফার্স্ট শেলিং যেখানে হবে দ্বিতীয় শেল ওখানে পড়বে না। তাই ধোয়া তোলা শেলের গর্তে নিজেকে লুকাই। আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করছি। হঠাৎ পাশেই একটা শেল এসে পড়ে। সেটার বিস্ফোরণ ঘটতেই স্প্লিন্টারে বিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত হই।
প্রথম কিছুই বুঝিনি। দেখি রক্তে কাপড় ভিজে গেছে। দৌড়ে একটা টিলার কাছাকাছি চলে আসি। তখনও শেলিং ও ফায়ার চলছিল। একটা শেলের গর্তে বসে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে পায়ে বিদ্ধ স্প্লিন্টারের টুকরাগুলি বের করে আনি। ডান পায়ের হাটুর ওপরসহ স্প্লিন্টার লাগে বিভিন্ন জায়গায়। বাম পায়েও বিদ্ধ হয় কয়েকটি। আমাদের কাছে শেলড্রেসিং থাকত। নিজেই ড্রেসিংটা খুলে ক্ষতস্থানে বেঁধে দিই। পরে আরেকটা গ্রামে গিয়ে পাই সহযোদ্ধাদের। সুস্থ হওয়ার পর জৈন্তা থেকেই আবার অপারেশন করতাম। সিলেট মুক্ত হলে অস্ত্র জমা দিই সিলেটের আম্বরখানায়।’
যে দেশের জন্য যুদ্ধে করেছেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?
এই যুদ্ধাহতের অকপট উত্তর: ‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি। মনে করছিলাম মুক্তিযুদ্ধেই মরে যাব। আমি মরলেও আমার জেনারেশন তো ভালো থাকবে। সেই চিন্তাটাই ছিল। এর চেয়ে খুব বেশি চিন্তা তখন ছিল না। আরও দশ বছর যুদ্ধ হলেও তো আমরা করতাম। বেঁচে আসছি, স্বাধীন দেশ ও পতাকা পেয়েছি এটাই বড় পাওয়া। আমি সেটিসফাইড।’
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এ দেশের জন্য, আমাদের মুক্তির জন্য, বাঙালির স্বাধীনতার জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। সেই নেতাকেই স্বাধীন দেশে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫ তারিখে। এটি মেনে নিতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধা শহিদউল্লাহ্। তার ভাষায়–
‘ওইদিন রাতে অফিসেই ছিলাম। ফজরের সময়ে নাখালপাড়ার নেতা জলিল ভাই শহিদ শহিদ বলে দরজায় বাড়ি দিচ্ছিলেন। খুলতেই কেঁদে দিয়ে বলেন– ‘বঙ্গবন্ধুকে তো মাইরা ফেলছে।’
মনে হইল আকাশটা ভাইঙ্গা পড়ছে। উনি বলেন– ‘লও যাই সামনে।’ পাশেই ছিল লাকড়ির দোকান। ওখান থেকে একটা মোটা লাঠি নিয়া এমপি হোস্টেল পর্যন্ত যাই। কিন্তু নেতাকর্মীরা না আসায় তেমন প্রতিবাদ হলো না। বঙ্গবন্ধু থাকবে না ওই দেশের কথা আমরা চিন্তাও করি নাই!
এরপর তো জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে। বঙ্গবন্ধুর নাম তখন মুখে আনাই যায় নাই। তবে আমার প্রতিষ্ঠান চিত্রায়ণে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল সবসময়। জয় বাংলা স্লোগান থেকেও কখনও পিছিয়ে যাই নাই। রাস্তায় গেলেই জোরে জোরে বলতাম জয় বাংলা। অনেকেই পাগল বলত। তবে তখন আমার কাছে জয় বাংলা স্লোগানই ছিল প্রতিবাদ।’
দেশের উন্নয়ন ও শেখ হাসিনা সরকারের দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মসূচিগুলো দেখলে, তরুণ প্রজন্মের নানা উদ্ভাবনের কথা শুনলে ভালো লাগে এই বীর যোদ্ধার।
খারাপ লাগে কখন?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই সূর্যসন্তানের অকপট উত্তর– ‘মানুষের সীমাহীন লোভের খবর শুনলে খারাপ লাগে। দুর্নীতি দেখলে মন খারাপ হয়। কাজ করতে গেলেই দেখি ঘুষ চায়। ভালোরা কাজ পায় না। আগে নেতারা নিজের বাজারের পয়সা কর্মীদের দিয়ে যেত। তারা ত্যাগী ও দেশপ্রমিক ছিলেন। এখন তো খাই খাই নেতাই বেশি। তারা বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার মতো নীতিবান হতে চায় না। বরং বাড়ি-গাড়ি, অর্থ-বিত্তের জন্য রাজনীতি করেন। ছোট ছোট নেতাদেরই গাড়ি আছে। এই টাকা কোথা থেকে আসে? রাজনীতি ও সমাজে সৎ লোক যদি টিকতে না পারে তাহলে এ কোন দেশ রক্ত দিয়ে স্বাধীন করলাম আমরা!’
কী করলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে?
‘নেতারা যে চাকরি দিবো কইয়া আর সালিশ কইরা টাকা খায়– এইগুলা নেত্রীকে শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। বেআইনী কাজে রাজনৈতিকদের যুক্ত হওয়া ঠেকাতে হবে। সকল স্তরে সরকারি লোক ও রাজনীতিবিদদের চুরি ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলেই দেশ অনেক এগোবে।’
তবে প্রজন্মকে নিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শহিদউল্লাহ্র ভাবনাটা ভিন্ন। তার ভাষায়– ‘আমাদের রক্ত তো বৃথা যেতে পারে না, ভাই। নিউ জেনারেশন চিন্তা-ভাবনায় অনেক এগিয়ে। তারা অনেককিছু বুঝে, বেকুব না। অন্যায়টা তারা চায় না, দেশের ভালোটা চায়। দেখবেন প্রজন্মই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
তাই তাদের উদ্দেশেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো– ‘তোমরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিও না। সাহসের সাথে আদর্শ নিয়ে চলার চেষ্টা করো। নিজের কাজটাকে ভালোবেসে সততার সঙ্গে করো। এটাই সবচেয়ে বড় দেশপ্রেম। মনে রেখো, দেশপ্রেম না থাকলে এই দেশও এগোবে না।’
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. শহিদউল্লাহ্।
ট্রেনিং: আসামের লোহারবন ট্রেনিং ক্যাম্পে আটাশ দিনের বেসিক ট্রেনিং এবং জেএলডাব্লিউ (জুনিয়ার লিডার উইং) নামক বাইশ দিনের বিশেষ ট্রেনিং নেন। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটরা) নম্বর ছিল ই-৭৮৯৮।
মুক্তিযুদ্ধ করেছেন: চার নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাব-সেক্টরের অধীনে সিলেটের কানাইঘাট ও আটগ্রামের বিভিন্ন জায়গায়।
যুদ্ধাহত: নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটের আটগ্রামে এক অপারেশন পাকিস্তানিদের সেলের স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয় তার ডান পায়ের হাঁটুর ওপর ও বাম পায়ের বিভিন্ন জায়গায়।
ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ০২ অক্টোবর ২০২০
© 2020, https:.