করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে
এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ কঠোরভাবে অনুসরণ করা প্রয়োজন। গণপরিবহণগুলো যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, হাট-বাজারের ইজারাদার ও ক্রেতা-বিক্রেতারা যেন মাস্ক ছাড়া বাজারে প্রবেশ না করে, সরকারের ভিজিডি, ভিজিএফ, খাদ্যবান্ধব ও ওএমএস কর্মসূচির সেবা গ্রহীতারা মাস্ক ছাড়া কোনো সেবা পাবেন না এমন নির্দেশনাও জারি করা প্রয়োজন। এছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের অনলাইন ক্লাসগুলোতে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়েও বিশেষ ক্লাসের আয়োজন করা যেতে পারে। এভাবে প্রত্যেক পরিবারকে সচেতন করা গেলেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলা সহজতর হবে।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বর্তমান অবস্থা কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে কেউ কেউ হয়তো মাথা চুলকাবেন। অনেকেই সরকারি টেস্টের ভিত্তিতে সংক্রমণের হার ও মৃত্যুহার তুলে ধরবেন। কিন্তু এ তথ্য করোনাভাইরাস সংক্রমণের সার্বিক চিত্র মনে করা কতটা সঠিক তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
এমতাবস্থায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়ার আগে অবশ্যই রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা পরিচালনা করা সরকারের দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। এতে এ রোগটি সারা দেশে কতখানি ছড়িয়েছে তা যেমন জানা সম্ভব হবে তেমনি এর ওপর ভিত্তি করে সংক্রমণ ঠেকাতে সঠিক কর্মপরিকল্পনাও হাতে নেওয়া যাবে। শীত শুরু হতে খুব একটা দেরি নেই। এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ নতুন করে বাড়তে পারে। যাকে বলা হচ্ছে সংক্রমণের সম্ভাব্য ‘দ্বিতীয় ঢেউ’।
যুক্তরাজ্যের অ্যাকাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সেস এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছিল, শীতের সময় দেশটির পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ হলে সেপ্টেম্বর থেকে আগামী জুন পর্যন্ত সময়ে কভিড হাসপাতালগুলোতে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে। মহামারীর প্রথম ধাক্কায় যুক্তরাজ্যে মারা গিয়েছে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ। গত জুলাই থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে এলেও সেপ্টেম্বর থেকে আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। শীতপ্রধান অনেক দেশেই ঋতু পরিবর্তনের পর দ্বিতীয় ধাপের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। চীনে এই সংক্রমণ প্রথম শুরু হয় গত শীতে। তাই সব বিবেচনায় আসছে শীতে এটি আরও বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ঝুঁকি আসলে কতটুকু? চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতে বাংলাদেশের তাপমাত্রা যাই থাকুক না কেন এ সময় মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসে। যেহেতু মানুষ শীতে দরজা-জানালা বন্ধ রাখবে সে সুযোগে বদ্ধ ঘরে করোনাভাইরাস বাড়বে। কেননা ঘরে আলো-বাতাস ঠিকমতো চললে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিও কম থাকে। আবার ভাইরাস থেকে বাঁচতে নিয়মিত হাত ধোয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। শীতের সময় ঠা-ার কারণে মানুষের এ প্রবণতা অনেকাংশেই কমে আসবে। পাশাপাশি এখন যেভাবে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতি উদাসীন হয়ে উঠছে তাতে মানুষের ক্লোজ কনট্যাক্টও বাড়বে। ফলে শীতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি ব্যাপক পরিমাণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন শঙ্কাকে গুরুত্ব দিয়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সেই নির্দেশনার তেমন প্রতিফলন ঘটেনি এখনো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মাস্ক পরলে ‘জীবাণু বহনকারী ড্রপলেট’ থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণ থামাতে পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরা উচিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ফেইস মাস্ক পরলে শরীরের ভেতর অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ করোনাভাইরাস ঢুকতে পারে। সে ক্ষেত্রে হয়তো তার উপসর্গ হবে খুবই মৃদু বা আদৌ কোনো উপসর্গ দেখা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একজন মানুষের সংক্রমণ কতটা গুরুতর তা জানার ক্ষেত্রে তার দেহে কী পরিমাণ ভাইরাস ঢুকেছে তা গুরুত্বপূর্ণ। তাই মাস্ক পরলে তা যে শুধু অন্যদেরই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে, তা শুধু নয়, যিনি মাস্ক পরছেন তিনিও সুরক্ষিত থাকেন। তাই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক পরার কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু মাস্ক পরা নিয়ে সরকারের নানা নির্দেশনা থাকলেও বর্তমানে হাটবাজার, গণপরিবহন, জনসমাগম স্থলে মানুষের মাস্ক পরার প্রবণতা নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে মানুষের মনে যে আতঙ্ক ও ভয় ছিল ক্রমেই তা কেটে যাওয়ায় মাস্ক পরাতে উদাসীন হচ্ছে অনেকেই। সরকার ঘরের বাইরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করলেও এখন এ বিষয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা হচ্ছে আগের চেয়ে ধীর গতিতে। ফলে এ নিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত সচেতনতাবোধও কমেছে প্রবলভাবে।
এভাবে চলতে থাকলে শীতে বাংলাদেশে করোনা বিস্তারের দ্বিতীয় ধাপে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া প্রকৃতপক্ষেই কঠিন হয়ে পড়বে। কভিড-১৯ মহামারীতে দেশের অর্থনীতি সচল রাখার যে উদ্যোগ সরকার হাতে নিয়েছে, সেটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। আর এটি বাস্তবায়নে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হারে যেন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে সবচেয়ে বেশি। মাস্ক পরাকে বাধ্যতামূলক এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করতে না পারলে করোনায় সরকারের সব উদ্যোগই মুখ থুবড়ে পড়বে।
এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ কঠোরভাবে অনুসরণ করা প্রয়োজন। গণপরিবহণগুলো যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, হাট-বাজারের ইজারাদার ও ক্রেতা-বিক্রেতারা যেন মাস্ক ছাড়া বাজারে প্রবেশ না করে, সরকারের ভিজিডি, ভিজিএফ, খাদ্যবান্ধব ও ওএমএস কর্মসূচির সেবা গ্রহীতারা মাস্ক ছাড়া কোনো সেবা পাবেন না এমন নির্দেশনাও জারি করা প্রয়োজন। এছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের অনলাইন ক্লাসগুলোতে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়েও বিশেষ ক্লাসের আয়োজন করা যেতে পারে। এভাবে প্রত্যেক পরিবারকে সচেতন করা গেলেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলা সহজতর হবে।
পাশাপাশি সুলভ মূল্যে বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির মানুষ যেন মানসম্পন্ন মাস্ক সহজে কিনতে পারে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণের উদ্যোগও ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা যেমন বাড়াবে তেমনি স্বাভাবিক কাজ অব্যাহত রাখার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল থাকবে। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোও উদ্যোগী হতে পারে। এভাবে সম্মিলিত উদ্যোগই পারে করোনার দ্বিতীয় ওয়েবের সংক্রমণ ঠেকাতে। যা শুরু করা প্রয়োজন এখনই।
ছবি: সংগৃহীত
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২১ অক্টোবর ২০২০
© 2020, https:.