কেন বাড়ছে ধর্ষণ
যখন লিখছি তখন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে একমাস আগে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফলে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। এ নিয়ে সারা দেশে চলছে প্রতিবাদের ঝড়। এ মধ্যযুগীয় বর্বরতার ঘটনাটি ঘটেছে ওই নারীর নিজ ঘরে। ওই এলাকার দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার ও বাদল, কালাম ও রহিমসহ তার সহযোগীরা ঘরে ঢুকে এমন নির্যাতন চালিয়েছে।
এর প্রায় এক বছর আগে রাতের বেলায় দেলোয়ার ওই নারীর বাড়িতে গিয়ে লোকজন দিয়ে গণধর্ষণের হুমকি দিয়ে তাকে নিজে ধর্ষণ করে। তার কিছুদিন পর দেলোয়ার তার সহযোগী কালামকে ওই নারীর বাড়িতে পাঠায় এবং নৌকায় করে একটি বিলে নিয়ে দুজনই ধর্ষণ করে। নিরাপত্তাহীনতা ও ভয়ের কারণে তখন ঘটনার মূলহোতা দেলোয়ারের নাম প্রকাশ করতে পারেননি ওই গৃহবধূ। মানুষ কতটা বর্বর হলে এমন ঘটনা ঘটাতে পারে!
একজন নারী কতটা অসহায় হলে অমন বর্বরতা সহ্য করেছেন। ভয়ে প্রতিবাদও করতে পারেননি। পাড়া-প্রতিবেশী, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা ঘটনাটি জেনেও কেন গত একমাস টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করলেন না? দেলোয়ার বাহিনীর অপরাধের বিষয়ে পুলিশের কাছে কি কোনো তথ্য ছিল না! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনাটি যদি না আসত তাহলে হয়তো ওই চক্রটি কখনো ধরা পড়ত না। হয়তো ওই নারী ভয়ে, লজ্জায় আর অপমানে নিঃশব্দে বুকের ভেতর কষ্ট পুষে রেখেই জীবন কাটাতেন। এমন নির্যাতিত নারীর সংখ্যাও এদেশে কম নয়, যাদের কান্নার শব্দ কখনওই প্রকাশ হবে না।
দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। বিরোধী দলের নেত্রী, দেশের স্পিকার সবাই নারী। দেশের সচিব ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদেও আসীন রয়েছেন নারীরা। দেশের অর্থনীতিতেও নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে বহুগুণ। তাই বলা হয়ে থাকে নারীরা আর পিছিয়ে নেই।
কিন্তু উন্নত বিশে^র মতো নারীদের নির্বিঘ্ন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কি পেরেছে রাষ্ট্র? এদেশে কেন একজন নারী চিৎকার করে বলতে পারেন না তার প্রতি বর্বরতা, অত্যাচার ও নির্মমতার কথাগুলো। তাহলে এ কোন উন্নত বাংলাদেশ নিয়ে আমরা তৃপ্ত হচ্ছি!
দেশে ধর্ষণের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে বাদ যায়নি প্রতিবন্ধী কিংবা ছয় বছরের শিশুও। গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে চারটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। তাদের তথ্য বলছে চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ঘটেছে ৯৪৮টি ধর্ষণের ঘটনা, যার ৫৯টিই সেপ্টেম্বর মাসেই। ২০১৯ সালে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪১৩ এবং ২০১৮ সালে ছিল ৭৩২।
কিন্তু কেন বাড়ছে ধর্ষণের মতো অপরাধ?
মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে এবং সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। এইসব ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনাগুলোর সঙ্গে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালীরা জড়িত থাকায় তাদের বিচার হয় না। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও তারা আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে এদের থামানো কঠিন হবে বলে মনে করেন তারা।
ধর্ষণের মতো অপরাধ কমানোর পাশাপাশি এর মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা চলছে সারা পৃথিবীতেই। ধর্ষণ যৌনসুখের উদ্দেশে নয়, বরং অপরপক্ষকে দমিয়ে রাখতে ক্ষমতার প্রদর্শন হিসেবে করা হয়। এই ক্ষমতার প্রকাশ শুধু নারীদের বিরুদ্ধেই হয়। অন্যদিকে, ধর্ষণ কাজ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘জাতে ওঠার’ পন্থা হিসেবে। এমনটাই বলছেন সাইকোলজি অফ ভায়োলেন্স জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শেরি হামবি। আবার ধর্ষণ বিষয়ে ড. স্মিথিম্যানের গবেষণা বলছে, বেশির ভাগ ধর্ষকের মধ্যে রয়েছে নার্সিসিজম বা আত্মমুগ্ধতা, নারীবিদ্বেষ ও অন্যের প্রতি সহানুভূতির অভাব। ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় জয়দীপ সরকার ধর্ষকামী মানসিকতার মোট ছয়টি রূপকে চিহ্নিত করেছেন সুযোগসন্ধানী ধর্ষক, স্যাডিস্টিক ধর্ষক, প্রতিহিংসাকামী ধর্ষক, কল্পনাপ্রবণ ধর্ষক, ক্ষমতালোভী ধর্ষক ও ক্ষুব্ধ ধর্ষক।
এদেশে ধর্ষণের মাত্র তিন ভাগের মতো মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পায়। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আইনের ফাঁক গলে ৯৭ ভাগ মামলাতেই আসামি খালাস পেয়ে যায়। তাই অনেকের মতে এ আইনে বিচার ব্যবস্থা ক্রমেই অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
আবার ধর্ষণের যে ঘটনাগুলো আলোচিত হয় সেখানেই কিছুটা বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিছু মামলায় নিম্ন আদালতে বিচার হলেও তা আটকে যায় উচ্চ আদালতে। আপিলের নামে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে মামলা। ফলে এক যুগ কেটে গেলেও বিচার শেষ হয় না। এতে ধর্ষণকারীরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ বেরিয়ে এসে দ্বিগুণ উৎসাহে ধর্ষণের আরও ঘটনা ঘটাতে সাহস পায়।
২০১৬ সালের মার্চে কুমিল্লায় সোহাগী জাহান তনুর ধর্ষণ ও হত্যা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। ২০১৭ সালের মার্চে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার বিচার চলছে ঢিমেতালে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলে বাসে রূপাকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। ওই মামলায় নিম্ন আদালত ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে চার জনকে ফাঁসির আদেশ দিলেও মামলাটি উচ্চ আদালতে আটকে আছে। ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল রাতে শাজনীনকে ঢাকায় তাদের নিজ বাসায় ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। এই মামলায় চূড়ান্ত রায় পেতে সময় লেগেছিল আঠারো বছর। তাই সমাজে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ রোধ করতে হলে অপরাধীদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যা হয়নি এখনো। ফলে ধর্ষণকারীরা হয়ে উঠছে অপ্রতিরোধ্য।
ধর্ষিত নারী, ধর্ষণের পরেও ধর্ষিত হয়। প্রথমবার ধর্ষণের খবরের শিরোনাম হয়ে, সামাজিকভাবে। দ্বিতীয়বার বিচারের সম্মুখীন হয়ে অস্বস্তিকর নানা প্রশ্নের মুখে। ফলে বেশিরভাগ নারী বিচার না চেয়ে আজীবন এই দুর্বিষহ স্মৃতি বয়ে বেড়ান। এছাড়া সামাজিক মর্যাদাহানি হওয়ার ভয়ে ও বিভিন্ন কারণে ঘটনাগুলো ধামাচাপাও দেওয়া হয়। তাই নারীর প্রতি আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনসহ বিচার প্রক্রিয়াটাকেও নারীবান্ধব রাখা জরুরি।
ধর্ষণ ঘৃণ্য অপরাধ। ক্রমেই এটি যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ষণের মতো ঘটনার দায় সরকারও এড়াতে পারে না। এটি বন্ধে রাজনৈতিক অঙ্গীকারও প্রয়োজন। তাই শুধু আলোচিত ঘটনাগুলোই নয়, সব ধর্ষণের বিরুদ্ধেই সরকারকে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। এর দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।
পাশাপাশি শুধু সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়েই বসে থাকলে চলবে না। এই ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে সবাইকেই রুখে দাঁড়াতে হবে, সামাজিকভাবে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ। মনে রাখতে হবে, রক্ত দিয়ে পাওয়া এই স্বাধীন দেশে কোনো নারী যখন ধর্ষিত হন, তখন ধর্ষিত হয় এই সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রিয় বাংলাদেশও।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৮ অক্টোবর ২০২০
© 2020, https:.