দেশে প্রভাবশালীও নারী, বিবস্ত্রাও নারী
ধর্ষিত নারী ধর্ষণের পরেও ধর্ষিত হয়। প্রথমবার ধর্ষণের খবরের শিরোনাম হয়ে সামাজিকভাবে। দ্বিতীয়বার বিচারের সম্মুখীন হয়ে অস্বস্তিকর নানা প্রশ্নের মুখে। ফলে বেশির ভাগ নারী বিচার না চেয়ে আজীবন এই দুর্বিষহ স্মৃতি বয়ে বেড়ান।
যদি প্রশ্ন করা হয়, দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি কে? সবাই নিশ্চয়ই একবাক্যে বলবেন, প্রধানমন্ত্রী। যিনি একজন নারী। বিরোধী দলের নেত্রী, দেশের স্পিকার- সবাই নারী। দেশের সচিব ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদেও আসীন রয়েছেন নারীরা। দেশের অর্থনীতিতেও নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে বহুগুণ। তাই বলা হয়ে থাকে নারীরা আর পিছিয়ে নেই। এই এগিয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা দেয়া হয় শুধু আগের অবস্থান ও প্রেক্ষাপটের তুলনা করে। সেটি নিয়ে একধরনের আত্মতৃপ্তিতেও ভুগছি আমরা। কিন্তু উন্নত বিশ্বের মতো নারীদের নির্বিঘ্ন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কি পেরেছে আমাদের রাষ্ট্র? যদি প্রশ্ন তোলা হয়, এ দেশে সবচেয়ে নির্যাতিত কে? তাহলেও কিন্তু উত্তরটি হবে, নারী। দেশের প্রভাবশালী ও নির্যাতিতা দুটিতেই নারী। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমনটা হয় কি না, আমাদের জানা নেই।
যখন লিখছি, তখন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার ভিডিও এক মাস পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এ নিয়ে সারা দেশে উঠেছে প্রতিবাদে ঝড়। এই মধ্যযুগীয় বর্বরতার ঘটনাটি ঘটেছে ওই নারীর নিজ ঘরে। ওই এলাকার দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার, বাদল, কালাম, রহিমসহ তার সহযোগীরা ঘরে ঢুকে এমন নির্যাতন চালিয়েছে। ভয়ে প্রতিবাদও করতে পারেননি ওই নারী। প্রতিবেশী, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা ঘটনাটি জেনেও গত এক মাস টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করেনি! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনাটি যদি না আসত, তা হলে হয়তো ওই চক্রটি কখনো ধরা পড়ত না। হয়তো ওই নারী ভয়ে, লজ্জায় আর অপমানে নিঃশব্দে বুকের ভেতর কষ্ট পুষে রেখেই জীবন কাটাতেন। এমন নির্যাতিত নারীর সংখ্যাও এ দেশে কম নয়, যাদের কান্নার শব্দ কখনোই হয়তো প্রকাশ্য হবে না।
দেশে নারী ধর্ষণের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে ধর্ষণের ঘটনায় বাদ যায়নি প্রতিবন্ধী কিংবা ছয় বছরের শিশুও। সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দল বেঁধে ধর্ষণ করে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজন ছাত্র। খাগড়াছড়িতে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েকে হাত-মুখ বেঁধে দল বেঁধে ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এক তরুণীকে দুই দিন ধরে আটকে রেখে দল বেঁধে ধর্ষণ করে কয়েকজন যুবক। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী এলাকায় অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে তারই ‘প্রাইভেট শিক্ষক’ মাজহারুল ইসলাম রায়হান। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের সাঁতারপুর গ্রামে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক দরিদ্র রিকশাচালকের ছয় বছরের শিশুকন্যা। রাজশাহীর তানোরের একটি ক্যাথলিক গির্জায় তিন দিন আটকে রেখে সপ্তম শ্রেণির এক আদিবাসী কিশোরীকে ধর্ষণ করে ফাদার প্রদীপ গ্রেগরী। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে ১৩ বছরের এক শিশুকে জোর করে তুলে নিয়ে দল বেঁধে ধর্ষণ করে মাসুদসহ তিন যুবক। টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই শিশুটির অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। ঢাকার পল্লবীতে নিজের প্রতিবন্ধী ছেলের বউকে চার মাস ধরে যৌন নিপীড়ন করে আসছিল এক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। এসবই গণমাধ্যমে উঠে আসা খবর। কিন্তু বাস্তবে ধর্ষণের ঘটনা আরও অনেক বেশি বলে মনে করেন অনেকেই।
গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে চারটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। তাদের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ঘটেছে ৯৪৮টি ধর্ষণের ঘটনা, যার ৫৯টিই সেপ্টেম্বর মাসে। ২০১৯ সালে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪১৩ এবং ২০১৮ সালে ছিল ৭৩২।
কিন্তু কঠোর আইন থাকতেও কেন বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা?
মানবাধিকারকর্মীরা মনে করেন, বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে এবং সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। এসব ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালীরা জড়িত থাকায় তাদের বিচার হয় না। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও তারা আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে এদের থামানো কঠিন হবে বলেন মনে করেন তারা।
একটি সমীক্ষার তথ্য বলছে, ধর্ষণের মাত্র তিন ভাগের মতো মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পায়। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় আইনের ফাঁক গলিয়ে ৯৭ ভাগ মামলাতেই আসামি খালাস পেয়ে যায়। তাই অনেকের মতে, এই আইনে বিচারব্যবস্থা ক্রমেই অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
আবার ধর্ষণের যে ঘটনাগুলো আলোচিত হয়, সেখানেই কিছুটা বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিছু মামলায় নিম্ন আদালতে বিচার হলেও তা আটকে যায় উচ্চ আদালতে। আপিলের নামে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে মামলা। ফলে এক যুগ কেটে গেলেও বিচার শেষ হয় না। এতে ধর্ষণকারীরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়। কেউ কেউ বেরিয়ে এসে দ্বিগুণ উৎসাহে ধর্ষণের আরো ঘটনা ঘটাতে সাহস পায়।
২০১৬ সালের মার্চে কুমিল্লায় সোহাগী জাহান তনুর ধর্ষণ ও হত্যা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। ২০১৭ সালের মার্চে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার বিচার চলছে ঢিমেতালে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলে বাসে রূপাকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। ওই মামলায় নিম্ন আদালত ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে চারজনকে ফাঁসির আদেশ দিলেও মামলাটি উচ্চ আদালতে আটকে আছে। ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল রাতে শাজনীনকে ঢাকায় তাদের নিজ বাসায় ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। এই মামলায় চূড়ান্ত রায় পেতে সময় লেগেছিল ১৮ বছর। তাই সমাজে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ রোধ করতে হলে অপরাধীদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ধর্ষণ যৌনসুখের উদ্দেশ্যে নয়, বরং অপর পক্ষকে দমিয়ে রাখতে ক্ষমতার প্রদর্শন হিসেবে করা হয়। এই ক্ষমতার প্রকাশ শুধু নারীদের বিরুদ্ধে হয়। অন্যদিকে ধর্ষণকাজ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘জাতে ওঠার’ পন্থা হিসেবে। এমনটাই বলছেন সাইকোলজি অব ভায়োলেন্স জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শেরি হামবি। আবার ধর্ষণ বিষয়ে ড. স্মিথিম্যানের গবেষণা বলছে, বেশির ভাগ ধর্ষকের মধ্যে রয়েছে নার্সিসিজম বা আত্মমুগ্ধতা, নারীবিদ্বেষ ও অন্যের প্রতি সহানুভ‚তির অভাব।
ইন্ডিয়ান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় জয়দীপ সরকার ধর্ষকামী মানসিকতার মোট ছয়টি রূপকে চিহ্নিত করেছেন- সুযোগসন্ধানী ধর্ষক, স্যাডিস্টিক ধর্ষক, প্রতিহিংসাকামী ধর্ষক, কল্পনাপ্রবণ ধর্ষক, ক্ষমতালোভী ধর্ষক ও ক্ষুব্ধ ধর্ষক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন ধর্ষকের মধ্যে একাধিক ধর্ষকামী মানসিকতার ছাপ লক্ষ করা যায় বলেও জানাচ্ছে ওই গবেষণা।
ধর্ষিত নারী ধর্ষণের পরেও ধর্ষিত হয়। প্রথমবার ধর্ষণের খবরের শিরোনাম হয়ে সামাজিকভাবে। দ্বিতীয়বার বিচারের সম্মুখীন হয়ে অস্বস্তিকর নানা প্রশ্নের মুখে। ফলে বেশির ভাগ নারী বিচার না চেয়ে আজীবন এই দুর্বিষহ স্মৃতি বয়ে বেড়ান। এ ছাড়া সামাজিক মর্যাদাহানি হওয়ার ভয়ে ও বিভিন্ন কারণে ঘটনাগুলো ধামাচাপাও দেয়া হয়। তাই নারীর প্রতি আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনসহ বিচার-প্রক্রিয়াটাকেও নারীবান্ধব রাখা জরুরি।
ধর্ষণ ঘৃণ্য অপরাধ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও ক্রমেই এটি যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা সরকারের উদাসীনতাকে স্পষ্ট করছে। ধর্ষণের মতো ঘটনার দায় সরকারও এড়াতে পারে না। ধর্ষণ বন্ধে রাজনৈতিক অঙ্গীকারও প্রয়োজন। তাই শুধু আলোচিত ঘটনাগুলোই নয়, সব ধর্ষণের বিরুদ্ধেই সরকারকে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। ধর্ষণের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।
পাশাপাশি এই ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে সবাকেই রুখে দাঁড়াতে হবে, সামাজিকভাবে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ। মনে রাখতে হবে, রক্ত দিয়ে পাওয়া এই স্বাধীন দেশে কোনো নারী যখন ধর্ষিত হন, তখন ধর্ষিত হয় এই সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রিয় বাংলাদেশও।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সারাক্ষণ ডটকমে, প্রকাশকাল: ০৬ অক্টোবর ২০২০
© 2020, https:.