জিডিপিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা
খুন, ধর্ষণ, হত্যার মতো নেতিবাচক ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যম কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া সরব থাকে দারুণভাবে। কিন্তু দেশের পজিটিভ ও আশাব্যঞ্জক খবরগুলো ততটা আলোচিত হয় না। ভালো ও পজিটিভ খবরগুলো আলোচিত না হলে প্রজন্মের মাঝে পজিটিভ মানসিকতার বিকাশ ঘটবে কীভাবে?
দেশ নিয়ে ভালো খবর জানিয়েই শুরু করছি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ প্রকাশ করে বলেছে, ২০২০ পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার, আর ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। অর্থাৎ জাতীয় উৎপাদনের দিক থেকে বড় অর্থনীতির দেশ ভারতকে পেছনে ফেলবে বাংলাদেশ। তারা বলছে, এ বছর সবচেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বিশ্বের শীর্ষ তিনটি দেশের মধ্যে একটি হবে বাংলাদেশ!
এমন খবর আমাদের আশা জাগায়। এ নিয়ে দেশে তেমন আলোচনা না হলেও সমালোচনার ঝড় বইছে ভারতে। এবারই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হলেও বেশ কিছু সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশটিকে ছাড়িয়ে গেছে আরও ছয় বছর আগেই।
কিন্তু অর্থনীতিতে বাংলাদেশের এই এগিয়ে যাওয়ার কারণ কী? সেটি নিয়ে দ্য ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস-এ গত ১৭ অক্টোবর প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোই দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন জিডিপির দিক থেকে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি শিল্প ও সেবা খাতনির্ভর। এখন কর্মসংস্থান তৈরি করছে এই খাতই, যা কৃষি খাত করতে পারছে না।
আবার ভারতের বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে শ্রমশক্তিতে নারীদের উচ্চতর অংশগ্রহণ একটি বড় ভূমিকা রাখছে। আর এখানেই ভারত যথেষ্ট পিছিয়ে। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক খাত। যা নিয়েই বিশ্ববাজারে একটি ভালো স্থান করে নিয়েছে দেশটি। শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণের হার ৩২ শতাংশ, যা ভারতে মাত্র ২০ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়াও কিছু সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশ এগিয়ে। যেমন স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ। মজার বিষয় হলো স্যানিটেশনের দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও অনিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের কারণে মৃত্যুহার ভারতে বেশি, বাংলাদেশে কম।
পাঁচ বছর আগেও ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি ছিল। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে ভারতের চেয়েও অনেক বেশি হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় ভারতের ১০ দশমিক ৩ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির হার যখন ২০২০ সালে ভারতের নমিনাল জিডিপিকে ২ হাজার ১০০ ডলার থেকে টেনে ১ হাজার ৮৭৭ ডলারে নামিয়ে ফেলছে, তখন বাংলাদেশ যে ভারতকে টপকে যাচ্ছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই! আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশ ও ভারতের মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার পাশাপাশি সারা বিশ্বেরও ফোকাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
করোনাভাইরাসের মহামারী মোকাবিলার পাশাপাশি এবারই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়েছে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি প্রায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষি খাত। তার পরেও সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে মানুষ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলার এমন অভিজ্ঞতা ও জরুরি পদক্ষেপের কারণেই সারা বিশ^ আজ জেনে গেছে শত প্রতিকূলতায়ও এ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ দেশ এগিয়ে যাবে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লড়াইটা খুব সহজ ছিল না। এদেশের অর্থনীতি নিয়ে ১৯৭২ সালে বিশ^ব্যাংকের প্রথম প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছিল এমন ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। এখানকার মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলারের মধ্যে, যা গত ২০ বছরে বাড়েনি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ৪০০ মানুষ বাস করে এখানে। তাদের জীবনের আয়ুষ্কাল অনেক কম, ৫০ বছরের নিচে। বেকারত্বের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে এবং জনসংখ্যার বড় অংশই অশিক্ষিত।’
দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নানা উদ্যোগ থাকলেও ষড়যন্ত্রও কম ছিল না। কিন্তু পঁচাত্তরের পর দেশ চলতে থাকে উল্টোপথে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই স্বাধীন দেশে এখনো পাকিস্তানপ্রেমীরা রয়ে গেছে। তারা পাকিস্তানের গুণকীর্তনে পঞ্চমুখ থাকেন প্রায়শই। কিন্তু অর্থনীতিতে পাকিস্তানের অবস্থান এখন কোথায়?
গণমাধ্যমের খবর বলছে, সর্বশেষ ২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ছিল ১৬৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন, পাকিস্তানের ২০৫ মিলিয়ন। বাংলাদেশের টোটাল ফার্টিলিটি রেট এখন কমে ২ দশমিক ১-এ নেমে এসেছে, অথচ পাকিস্তানে এই রেট এখনো ৩ দশমিক ৮। এছাড়া ২০১৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩৬, পাকিস্তানের ১৪৭।
বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ২০১৮ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৪ বছর, আর পাকিস্তানের ৬৬ দশমিক ৪ বছর। সর্বশেষ হিসাবে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ আর পাকিস্তানের হার মাত্র ৬০ শতাংশ। মুদ্রার বৈদেশিক বিনিময় হারেও বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানকে অনেক পেছনে ফেলেছে। বাংলাদেশের মোট অপরিশোধিত বৈদেশিক ঋণ ৩৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, অথচ পাকিস্তানের মোট ঋণ ১০২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে গেছে। পাকিস্তানে তা আজও ২ দশমিক ১ শতাংশে রয়ে গেছে।
অর্থনীতিতে বাংলাদেশের এমন সম্ভাবনার পেছনে যে মানুষটির নেতৃত্ব আলোচিত হচ্ছে তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত এক যুগে তার শাসনামলে বাংলাদেশে এক বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উত্থান ঘটেছে। তিনগুণেরও বেশি বড় হয়েছে জিডিপি। নির্মাণ হচ্ছে বড় বড় অবকাঠামো। যা দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় অর্থনীতির ইঙ্গিত বহন করে।
প্রাণঘাতী করোনায় বিপর্যস্ত গোটা বিশে^র অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য। কিন্তু যেসব দেশ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে এগিয়ে (আইসিটি) করোনাকালে তারাই বাড়তি সুফল পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দেন। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে গড়ে ওঠা তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামোর উন্নয়নের কারণেই আজ করোনার এই কঠিন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আমাদের পক্ষে সহজতর হচ্ছে।
দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে শিক্ষা, অফিস-আদালত, ব্যাংক, রাজনৈতিক সভা, কনফারেন্স ইত্যাদি অনলাইনভিত্তিক করার পাশাপাশি আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনাকাটা আমরা ঘরে বসেই করতে পারছি। ফলে অর্থনীতির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদির বিল মানুষ ঘরে বসেই অনলাইনে পরিশোধ করতে সক্ষম হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ১৬ কোটি ২৯ লাখ মোবাইল গ্রাহকের মধ্যে ১০ কোটি ১১ লাখ ৮৬ হাজার মানুষ এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। সরকার পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল সেবা (ফাইভ-জি) চালুরও প্রক্রিয়া শুরু করেছে। মোবাইলে আর্থিক সেবা, রাইড শেয়ারিং, ই-কমার্সসহ বেশ কিছু সেবা এখন হাতের নাগালে। উচ্চগতির মোবাইল ইন্টারনেট কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প ও সেবা খাতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। আর এমন অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি। করোনার মহামারীতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে যা বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে।
করোনায় অর্থনীতিকে সচল ও চাঙ্গা রাখার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সবার কাছেই প্রশংসিত হয়েছে। জরুরি সময়ে বড় মাপের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সুযোগ উন্মুক্ত করার মতো সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। ফলে করোনাকালেও বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা কিছুটা হলেও সচল রাখা সম্ভব হয়েছে।
বর্তমানের এই ধারা অব্যাহত থাকলে, ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপির নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুরের মতো দেশ সেখানে থাকবে বাংলাদেশের পেছনে। আর সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে সবাইকেই। করোনার মহামারী সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলার পাশাপাশি দেশের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে সরকারকে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে দেশের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে।
ব্যবহৃত ইমেজ: সংগৃহীত
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৯ অক্টোবর ২০২০
© 2020, https:.