ওরাঁওরা কেন গায়ে উল্কি আঁকে
দিনটি ছিল বৃহস্পতি। মধ্য বিকেল। দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী টিনপাড়া গ্রামটি প্রায় পুরুষশূন্য। হাঁকডাক দিয়েও ওই ওরাঁও গ্রামটিতে কোনো পুরুষের দেখা মিলল না। হাট বসেছে পাশের বহবলদিঘী বাজারে। তাই সেখানে নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছেন এ গ্রামের পুরুষেরা।
এক সময় শতাধিক পরিবারের বসবাস থাকলেও এ গ্রামে এখন রয়েছে মাত্র বিশটি ওরাঁও পরিবার। ধর্মান্তরের টানা-হেচরায় ওরাঁওদের আদি সনাতন ধর্ম আজ প্রায় বিপন্ন।
সন্ধ্যা হয় হয়। ওরাঁও গ্রামের পুরুষেরাও ফিরতে শুরু করে। গোত্রের মহত নিপেন টিগ্গা হাসিমুখে সঙ্গ দেন আমাদের। হঠাৎ ঢোল-মাদলের বাদ্যি। উঠোনের এককোণে একদল ওরাঁও আদিবাসী গাইছে।
‘আরে ও ওরে
রেহি রে রে রে রে রে
দিয়া যে রায়ঝ দিয়ারা রে দিয়ারা
কা করে উরোজনা বাড়িরে
আরে-আগে যে জাগাওয়ে গজোমতি গাহা হো
তোকোর পিছে জাগারো কৃষানোরে।’
গানের ভাবার্থ: বাড়িওয়ালা তুমি বাতি জ্বালিয়ে কী করো, কীসের জন্য বাতি জ্বালাও, বাতি জ্বালিয়ে গোয়ালে গরুগুলোকে জাগিয়ে তুলছি এবং পরে কৃষককে জাগিয়ে তুলবো পূজার জন্য।
সময়টা ছিল আশ্বিনের চাঁদের অমাবস্যার পরের দিন। আসরে যোগ দেন গোত্রের মায়া টিগ্গা। বয়স নব্বই ছুঁইছুঁই। বয়সের টানে তিনি হারিয়েছেন দুইপাটির দাঁতগুলো। ফোকলা দাঁতে হাসি তুলে বসে পড়েন এককোণে। খবর পেয়ে আরেক বাড়ি থেকে আসেন তারই বোন পারলো টিগ্গাও।
কথায় কথায় চোখ পড়ে মুংলী, মায়া ও পারলোর কপাল ও গলায়। সবার কপাল ও ঘাড়ের চামড়ায় হালকা কালো রঙের দাগ। কিসের দাগ এটি? প্রশ্ন করতেই মুংলী বললেন এটি ‘উল্কি’। ওরাঁওরা গায়ে উল্কি আঁকেন। এটি তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস। পাশে বসা পারলো টিগ্গা জানান উল্কি নিয়ে ওরাঁওদের নানা বিশ্বাস ও আচারের কথা।
বার-চৌদ্দ বছর বয়স হলেই ওরাঁওদের বিশেষ নিয়ম মেনে নারী-পুরুষ উভয়ের শরীরে উল্কি আঁকতে হয়। প্রথমে এক প্রকার লতা বেটে তার সঙ্গে মাটির পাতিলের নিচের পোড়া কালি আর দুধ মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করা হয়। তারপর এক জোড়া সুচ আগুনে পুড়িয়ে দেহের যেখানে যেখানে উল্কি আঁকতে হবে সেখানে দ্রুত স্পর্শ করে আঁকা হয় নানা চিত্র।
এরপর সে জায়গায় লতা-বাটা, কালি আর দুধ মিশ্রণ লাগিয়ে দেওয়া হয়। ঘা শুকালে কালো রঙের চিরস্থায়ী উল্কির আকার ভেসে ওঠে চামড়ার মধ্যে। এ রঙ সারা জীবনে এতটুকুও পাল্টায় না।
কবে এবং কেন ওরাঁও সমাজে উল্কি আঁকার প্রচলন হলো, এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে একটি অভিন্ন আদিবাসী কাহিনি। পারলোর মুখেই শুনি কাহিনিটি-
পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে মানুষ ছিল এক জাতের। কারো কোনো পেশা ছিল না। পেশা না থাকায় ছিল না কোনো জাতও। পেশা গ্রহণের জন্য সৃষ্টিকর্তা ধরমেশ সবাইকে ডেকে পাঠালেন। সবাই উপস্থিত হলো।
ধরমেশ একজনকে দিলেন লাঙল। তখন সে হলো চাষি। আরেকজনকে দিলেন কুঠার। সে হয়ে গেল কাঠুরে। একজনকে দিলেন মাছ ধরার জাল। সে হলো জেলে। একজনকে দিলেন কাপড় বুনার সুতা। সে হয়ে গেল তাঁতী।
সবাই সবকিছু পেলো। অবশিষ্ট থাকলো একটি দোতরা। শেষে এক ব্যক্তি পেল সেটি। সে ব্যক্তি দোতরা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান গায়। ফলে সমাজে তার সম্মান বেড়ে যায়।
একদিন সে বাড়ি ফিরে রান্না ভালো না হওয়ায় স্ত্রীকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে স্ত্রী চলে যায় বনে। বনের মধ্যে ছিল এক দেবতা। তিনি তার কান্না থামিয়ে বললেন, আমি তোমাকে এমন কাজ দেবো যে কাজের জন্য সবাই তোমাকে কদর করবে।
দেবতা তাকে উল্কি আঁকার সব পন্থা শিখিয়ে দিল। সে থেকেই পৃথিবীতে উল্কির প্রচলন শুরু হয়। তাই শুধু উল্কি চিহ্ন নয়, উল্কি শিল্পীও ওরাঁওদের কাছে পবিত্রতার প্রতীক।
আদিকালে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে শনাক্তকরণের একমাত্র চিহ্ন ছিল এই উল্কি। ওরাঁওরা উল্কি আঁকার পূর্বে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বলি দিয়ে পূজা করে। উল্কি যেন ভালোভাবে আঁকা হয়, ঘা যেন তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় আর অপদেবতাদের দৃষ্টি যেন কোনোভাবেই না পড়ে, সেটিই থাকে পূজার উদ্দেশ্য।
সাধারণত উল্কি আঁকার স্থান হাতের তালু, হাতের এপিঠ ওপিঠ, বুক, কপাল এমনকি গাল। উল্কি হিসেবে আঁকা হয় লতাপাতা, গোলচক্র, পশুপাখি, সূর্য, চন্দ্র, তারা প্রভৃতি।
ওরাঁওরা বিশ্বাস করে কোনো নারী বা পুরুষ যদি উল্কিবিহীন মারা যায় তবে যমরাজা তাকে মানবরূপে গ্রহণ করে না। ফলে অনন্তকাল তাকে নরকে পড়ে থাকতে হয়। আর এ কারণেই ওরাঁও সমাজে মৃত্যুর পরে দাহ করার আগে মৃতের শরীরে উল্কি এঁকে দেওয়া নিয়ম।
কিন্তু ওরাঁওদের এই আদি রীতিটি লুপ্ত হওয়ার পথে। এখনকার ওরাঁওরা শরীরে উল্কি আঁকে না। উল্কি নিয়ে এদের বিশ্বাসের কাহিনিগুলোও প্রভাবিত করে না এ প্রজন্মের ওরাঁওদের। ফলে উল্কির মতোই হারিয়ে যাচ্ছে ওরাঁওদের আদি সংস্কৃতি ও মৌখিক সাহিত্যগুলো।
অলঙ্করণ: সমর মজুমদার
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৩ নভেম্বর ২০০২
© 2020, https:.