ত্যাগের ইতিহাসটা প্রজন্মকে জানাতে হবে
১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে উত্তাল সংগ্রাম গড়ে তোলে বাংলাদেশের মানুষ। আসে ২৫ মার্চ। রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে নিরীহ-নিরাপরাধ বাঙালির ওপর।নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড চালায় তারা। অতঃপর সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়। বাংলার দামাল সন্তানরা মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হয়ে নিরীহ বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগে অংশ নেয় এদেশেরই কিছু মানুষ। রাজাকার, আল -বদর, আল -শামস নামে সংগঠন গড়ে তোলে তারা। ‘ধর্মরক্ষার’ ধোয়া তুলে এরাই লিপ্ত থাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে। তখন তারা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিবেকবান মেধাবী মানুষগুলোকেই আখ্যায়িত করে ‘ইসলামের শত্রু’।
যুদ্ধচলাকালে পাকিস্তানের এ দেশীয় দোসর আল -বদরের সাহায্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সংস্কৃতি কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার বরেণ্য ব্যক্তিদের অপহরণ করে এরা। পরে নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে রায়েরবাজার ও মিরপুরে তাদের হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে আল-বদর বাহিনী আরো অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আল -বদর ঘাঁটিতে নির্যাতনের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর কবরস্থানে নিয়ে হত্যা করে। এছাড়া ২৫ মার্চের কালরাত থেকেই সারাদেশের বুদ্ধিজীবীরা হত্যার শিকার হতে থাকে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা এ দেশের মানুষের ওপর যে গণহত্যা ও নৃশংসতা চালিয়েছে, তার নজির ইতিহাসে খুব বেশি নেই।
বিজয়ের প্রাক্কালে এরা হত্যা করে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী তাদের পরাজয় আসন্ন জেনেই বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী নিধনের এই পরিকল্পনা চলে। পরাজিত শক্তির দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ছিল এই হত্যাযজ্ঞে।
স্বাধীনতাসংগ্রামের সূচনা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিজয়ের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা হারিয়েছি অধ্যাপক জি সি দেব, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশীদুল হাসান, ড. আনোয়ার পাশা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, সেলিনা পারভীনসহ আরও অনেককে। তাঁরা সবাই ছিলেন চিন্তা ও মানবতার দিশারি। জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে সেই শূন্যতা আমরা আজও অনুভব করি। তাঁদের স্বজনেরাও বয়ে চলেছেন এক খণ্ডিত জীবনের ভার।
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা সেই মহান সন্তানদের স্মরণ করি। শ্রদ্ধাও জানাই। কিন্তু যাঁরা নিজেদের জ্ঞান-মনীষা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, আলোকিত করেছেন, তাঁদের শুধু বছরের একটি দিনে স্মরণ করলেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং তাঁদের শিক্ষাকে অন্তরে ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগের ইতিহাসটা।
সম্প্রতি সরকার সারাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকাকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি ভাল উদ্যোগ। তবে তা করতে হবে নির্মোহভাবে। তালিকাটি যেন বির্তকের উর্ধ্বে থাকে সে দিকে সংশ্লিষ্টদেরও আন্তরিক থাকতে হবে।
দেরিতে হলেও বুদ্ধিজীবী ও মানবতাবিরোধী হত্যায় জড়িত কয়েকজন শীর্ষ ঘাতকের বিচার ও শাস্তি কার্যকর হয়েছে। মানবতাবিরোধী হত্যা মামলায় দণ্ডিত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। জামায়াতের অপর নেতা মো. কামারুজ্জামান ও বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম হোতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ডও কার্যকর হয়েছে। কিন্তু আদালতের রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার হোতা শাস্তিপ্রাপ্ত চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের মতো আলবদর কমান্ডারদের দেশে ফিরিয়ে এনে সেই দণ্ড কার্যকর করা এখনও সম্ভব হয়নি। তাদেরকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে ও আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রয়েছে।
স্বাধীনতা লাভের পর চৌধুরী মঈনুদ্দীন পালিয়ে চলে যায় যুক্তরাজ্যে। এরপর থেকে ওখানেই বসবাস করছে এবং এই দীর্ঘ সময়ে নিজেকে একজন মুসলিম নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। গড়ে তুলেছে মুসলিম এইড নামক চ্যারেটি প্রতিষ্ঠান। ইস্ট লন্ডন মসজিদের পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল দীর্ঘ দিন। যুদ্ধ্বাপরাধী বিচার শুরু হওয়ার পর বিতর্কের মুখে মুসলিম এইড ও ইস্ট লন্ডন মসজিদের পরিচালনা পর্ষদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেও নেপথ্যে থেকে বিলেতের জামায়াতে ইসলামের কলকাঠি নাড়ছে এই কুখ্যাত নরপশু।
এই হত্যাকরীদের ফেরত আনার বিষয়ে সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তি পালন করবো আমরা। তার আগেই শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি সংরক্ষণ ও তাঁদের অনুসৃত পথেই চলার শপথ নিতে হবে সবাইকে।
আমরা এমন একটি সময়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করছি যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার মতো স্পর্ধা দেখিয়েছে ধর্মান্ধ একটি চক্র। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের মতো স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন ইসলামের শত্রু। আর আজ তাদেরই প্রেতাত্মারা জাতির জনকের ভাস্কর্যকে ইসলাম বিরোধী আখ্যা দিয়ে দেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বানানোর পায়তারা করছে। এই ধর্মান্ধদের কাছে রাষ্ট্র আপোস করলে সোনার বাংলা হবে না। তাই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের এই দিনে ধর্মের নামে অপব্যাখ্যাকারী ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শপথ নিতে হবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক জাগরণে, প্রকাশকাল: ১৪ ডিসেম্বর ২০২০
© 2021, https:.