বিপন্ন জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষা
বাঙালি ছাড়াও এদেশে রয়েছে নানা জাতির মানুষেরা। তাদের ভাষাগুলোর অবস্থা বাস্তবে কেমন সেটি জানাতে কয়েক বছর আগের একটি বেসরকারি গবেষণার তথ্য তুলে ধরছি। আন্তর্জাতিক সংগঠন সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকের বাংলাদেশ শাখা প্রায় ৩০টি ভাষার ওপর একটি জরিপ চালায়। জরিপ চলে ‘ফিশম্যান মানদন্ড’ মোতাবেক। একটি ভাষার অবস্থা কী, সেটি বোঝাতে এই মানদ-ের রয়েছে ৮টি স্তর। কোনো ভাষা চতুর্থ স্তরের পরের স্তরে চলে গেলেই ওই ভাষা বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তারা বলছে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাগুলোও আজ প্রায় বিপন্ন।
কীভাবে? ওই মানদ-ের প্রথম স্তরের বিবেচনার বিষয় ছিল, ভাষাটি ঊর্ধ্বতন সরকারি পর্যায়ে ব্যবহৃত হয় কি না। বিপন্নতার শুরু যে পঞ্চম স্তরে, সেখানে বিচার্য বিষয় হলো ভাষাটির মাধ্যমে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃৃৃতি এবং ওই ভাষায় সাহিত্য রয়েছে কি না। মানদ- মোতাবেক প্রায় অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষাগুলোই আছে বিপন্নের স্তরে। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা ছাড়া শিক্ষা বা কোনো কাজেই নিজ ভাষা ব্যবহার করতে পারে না তারা। এসব ভাষায় বাংলা ভাষার অনুপ্রবেশও ঘটেছে প্রবলভাবে। বয়সে প্রবীণ নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা নিজ ভাষায় কথা বলতে পারলেও নতুন প্রজন্ম তাদের ভাষাটির কোনো ব্যবহারই জানে না। দেশের সবচেয়ে বড় নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী চাকমাদের ভাষায় সাহিত্য আছে। কিন্তু ওই সাহিত্য খুব কম লোকের কাছেই পৌঁছায়। জরিপে অংশ নেওয়া চাকমাদের পঞ্চাশ ভাগ বলেছেন, তারা নিজ ভাষার নানা উপকরণ পড়েছেন, কিন্তু সেগুলো তাদের কঠিন মনে হয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ বলেছেন, কেবল প্রার্থনার সময় তারা মাতৃভাষা ব্যবহার করেন। প্রয়োজনীয়তার চাপে পড়ে নিজ মাতৃভাষা থেকে এখন বাংলাকেই তারা বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে এটি অধিক পরিমাণ লক্ষ করা গেছে সমতলের নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে। সাঁওতালদের ৪৯ শতাংশই মনে করে, নিজ মাতৃভাষার চেয়ে আজ বাংলাই বেশি প্রয়োজনীয়। উত্তরবঙ্গের কোদা ও কোল জাতির কেউই এখন আর নিজ ভাষায় পড়তে বা লিখতে পারে না। একই অবস্থা টাঙ্গাইলের কোচ ও দিনাজপুরের কড়া, ভুনজার, মুসহর আদিবাসীদের।
সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা এই প্রধান পাঁচটি নৃ-গোষ্ঠী ছাড়া অন্যদের ভাষা বিপন্নতার দ্বারপ্রান্তে। ঘরের মধ্যে ছাড়া তাদের মাতৃভাষা চর্চার সুযোগ নেই বললেই চলে। নতুন প্রজন্ম শিক্ষার সুযোগ এবং বাস্তবতার কারণে নিজের ভাষার চেয়ে বাংলা ও ইংরেজি চর্চাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ফলে এখন তাদের ভাষার উচ্চারণে শুধু পরিবর্তনই ঘটছে না; বরং তাদের শব্দভা-ারে অনেক বাংলা শব্দও স্থান করে নিয়েছে। আবার নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর যেসব মানুষ দীর্ঘদিন ধরে শহরে বসবাস করছে, পারিপার্শ্বিকতার নানা কারণে তাদের মাতৃভাষা আজ তারা প্রায় ভুলতে বসেছে। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারকেও মাতৃভাষার চর্চা ও ভাষা সুরক্ষায় উদ্যোগী হতে হবে। ভাষা রক্ষায় ওই জাতিসত্তার মানুষদেরই এগিয়ে আসতে হবে প্রথমে। ছোট ছোট উদ্যোগগুলোও ভাষা রক্ষায় উৎসাহিত করবে তাদের প্রজন্মকে। অন্যথায় ভাষার দেশেই হারিয়ে যাবে অন্য জাতির মাতৃভাষাগুলো। যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।
দেশ ও বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় ভাষা সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন-২০১০’ প্রণীত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর ভাষা সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ এবং যেসব জাতিগোষ্ঠীর ভাষা লেখ্যরূপ নেই, সেসব ভাষার লেখ্যরূপ প্রবর্তন করার কথা, সেখানে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সব নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর ভাষার যে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা জরিপ শুরু করেছিল তা এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে এদেশে কয়টি জাতি আছে, তাদের ভাষার সংখ্যা কত, এসব ভাষার অবস্থাই-বা কেমন তা নিয়ে সরকারিভাবে পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য এখনো আমরা পাইনি।
গবেষকরা বলছেন নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সুরক্ষার জন্য অন্তত দুটি কাজ শুরু করা প্রয়োজন অবিলম্বে। একটি হলো, প্রাথমিক স্তরে তাদের শিশুদের শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা পুরোপুরি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এর কোনো উদ্যোগই এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
এবার চোখ রাখি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অগ্রগতির দিকে। সব শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে সরকার প্রথম দফায় পাঁচটি
মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী নৃগোষ্ঠীর শিশুদের পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করে ২০১২ সালে। এর জন্য প্রথমে জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিকল্পনা নেওয়া হয়, প্রথম দফায় পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি ও গারো এই পাঁচটি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার। দ্বিতীয় পর্যায়ে ম্রো, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বমসহ ছয়টি ভাষায় এবং তৃতীয় পর্যায়ে কোচ, ওঁরাও (কুড়–ক), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষার পর অন্যান্য ভাষাতেও প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে। সে অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ের ৫টি ভাষায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতেই প্রাক-প্রাথমিকে আদিবাসী শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই তুলে দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হয় ২০১৭ সালে। গত বছরও ওই পাঁচটি মাতৃভাষায় পাঠদানের বই বিতরণ করা হয়। কিন্তু ওই ভাষার শিক্ষক বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি কাজে আসছে না। একইভাবে অন্যভাষীদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজও চলছে ঢিমেতালে। ফলে সার্বিকভাবে অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে।
এছাড়া বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছেবেসরকারি উদ্যোগে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত শিক্ষকদের মধ্যে শতকরা ৫১ ভাগ শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে ও ৪২ ভাগ এসএসসি পাস এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ জন। ফলে ভালো শিক্ষকের অভাবে অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর শিশুরা প্রকৃতপক্ষে ভালো রেজাল্ট করা থেকেও পিছিয়ে আছে।
সরকার সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ এদেশে মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর শিশু স্কুলে যাচ্ছে। যাদের মধ্যে বড় একটি অংশ ঝরে পড়ে মাতৃভাষার কারণে। তাই শুধু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় দায়সারা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করলেই হবে না। সেটি ক্লাসরুমে পঠন ও শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করার উদ্যোগও নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় পুস্তক প্রণয়নের সঙ্গে সমন্বয় রেখে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট ভাষার শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া প্রয়োজন। আর সেটি শুরু করতে হবে এখনই। এদেশে রক্ত দিয়ে আমরা নিজেদের মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছি। তাই অন্যান্য জাতিসত্তার মাতৃভাষাগুলো সুরক্ষা ও ভাষার বিপন্নতা ঠেকাতে রাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর উদ্যোগ নেবে এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১
© 2021, https:.