চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি: ৭১ প্রাণ হারিয়ে সচেতনতা কতটুকু
দুবছর আগের ঘটনা। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউনে সূত্রপাত হয় আগুনের। সেই আগুনে ওয়াহেদ ম্যানশনসহ পাঁচটি ভবন পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়। আগুনে নিহত হন ৭১ জন, আহত হয়েছেন অনেকে।
দিপুও ছিলেন সেখানে। চুড়িহাট্টা শাহি মসজিদ মার্কেটের নিচতলায় গামছাসহ বিভিন্ন জিনিসের দোকান ছিল তাদের। ভাতিজা আর ভাইকে রেখে আগুন লাগার ঠিক আগেই দোকান থেকে বেরিয়েছিলেন দিপু। নিজে বেঁচে গেলেও পুড়ে লাশ হন ভাই আর আদরের ভাতিজা। তাদের সঙ্গে হওয়া শেষ কথাগুলো মনে করে হাউমাউ করে কাঁদেন তিনি। বোন কাঁদছেন মৃত ভাইয়ের জন্য। যে ভাই প্রতি রাতে বাড়ি ফিরলেও সে রাতে বাড়ি ফেরেননি। মুঠোফোনে জানিয়েছিলেন একটু পরই ফিরে আসবেন। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী হাঁটতে পারবেন না। তাই তাকে সুরক্ষার জন্য ঘরের ভেতরেই ছিলেন এক স্বামী। স্ত্রীসহ কয়লা হয়ে গেছেন তিনিও। দুই অবুঝ শিশু তার আত্মীয়ের কোলে। তাদের বাবা আর ফিরে আসবেন না। নানা মানুষের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে শিশু দুটি। হয়তো বাবার কণ্ঠস্বর শোনার অপেক্ষাতেই আছে তারা। এক বন্ধু রাস্তার পাশের এক হোটেলে বসেই চা খাওয়ার জন্য ডেকেছেন তার বন্ধুকে। সেই বন্ধু এসে তার ঝলসানো লাশ পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া এক ছাত্র তার ভাইয়ের সঙ্গে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছেন। আগুনের তীব্রতা এতটাই ছিল, রিকশায় বসে থাকা অবস্থাতেই এক দম্পতি তার শিশুসন্তানসহ জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। আর প্রথম যে ভবনে আগুন লাগে, সেই ওয়াহেদ ম্যানশনের দোকানপাট ও গুদামে থাকা ক্রেতা-বিক্রেতার অধিকাংশই এমনভাবে পুড়েছে, তা শনাক্ত করার উপায় ছিল না। এসবই গণমাধ্যমের সংবাদ।
প্রায় প্রতিদিনই ঘটে নানা ঘটনা। ফলে আড়ালে চলে যায় পেছনের ঘটনাগুলো। আমরাও ভুলে যাই আগুনের ভয়াবহতা, পোড়া লাশের গন্ধ আর প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনায় আর্তনাদ করা মানুষের মুখগুলো। সেদিনের মৃত মানুষের আর্তনাদ কি আমরা শুনতে পাই? কতই না কষ্ট হয়েছে তাদের! ভাই ফেরেননি তার বোনের কাছে। অথচ তার ফেরার কথা ছিল। স্বামী-স্ত্রী তাদের অনাগত শিশুকে নিয়ে কতই না স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নগুলোও পুড়ে ছাই হয়েছে তাদের দেহের সঙ্গে। কিন্তু এসব মানুষের মৃত্যু রেখে গেছে অসংখ্য প্রশ্ন। গত দুবছরে আমরা কি পেরেছি সেই প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজে বের করতে। উত্তরটি অবশ্যই ‘না’। আগুনের ঘটনায় করা মামলায় বলা হয়েছে, ‘ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ তাদের চারতলা বাড়ির বিভিন্ন ফ্লোরে দাহ্যপদার্থ রাখতেন। মানুষের জীবনের ঝুঁকি জেনেও অবৈধভাবে রাসায়নিকের গুদাম করার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বাসাভাড়া দেন। আর ওই দাহ্যপদার্থ থেকেই আগুন লাগে।’ যদিও প্রথমে প্রচারের চেষ্টা হয়েছিল যে, রাস্তায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লাগে। বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের কাহিনীও ছড়ানোর চেষ্টা হয়। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি দুই ভাই হাসান ও সোহেল গ্রেপ্তার হলেও পরে উচ্চ আদালত থেকে তারা জামিন পান! গোডাউনের অন্য মালিকদের ঠিকানা নিশ্চিত হতে না পারায় বাকিরাও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে!
অবৈধ কেমিক্যাল কারখানার জন্য দায়ীদের এখনো আইনের আওতায় আনা যায়নি। আগুনের পর ওই এলাকায় অবৈধ প্লাস্টিক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। কিন্তু সেটি সফল হয়নি বাড়ির মালিকদের কারণে। ফলে সরেনি কেমিক্যাল গোডাউন ও প্লাস্টিক কারখানা। আগুনের সূত্রপাত যে ভবন থেকে, সেই ওয়াহেদ ম্যানশনে এখনো কিছুটা আগুনের ভয়াবহতার চিহ্ন থাকলেও বাকি ভবনগুলো মেরামত করে নেওয়া হয়েছে। সেখানে জীবনযাত্রা ও ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে স্বাভাবিক নিয়মেই। ফলে ওই এলাকায় আবারও আগুনের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আমরা ভুলে গেলেও আপনজনরা আজও ভুলতে পারেনি আগুনে মৃত্যু হওয়া প্রিয়জনদের স্মৃতিগুলো।
সেই রাতের আগুন কেড়ে নিয়েছিল দুই বান্ধবী ফাতেমাতুজ জোহরা বৃষ্টি ও রেহনুমা তারান্নুম দোলাকে। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে চাইল্ড কেয়ার বিভাগের শিক্ষার্থী বৃষ্টি এবং ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের আইনে পড়ুয়া দোলা দুজনেরই বাসা পুরান ঢাকায়। দুজনের বন্ধুত্ব শৈশব থেকে। শিল্পকলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন তারা। পরে চুড়িহাট্টায় অগ্নিকান্ডে নিহতদের পোড়া দেহের ডিএনএ পরীক্ষায় শনাক্ত হয় দুই বান্ধবীর লাশ। দোলার বাবা দলিলুর রহমান দুলাল গণমাধ্যমকে বলেন ঠিক এভাবে ‘বড় মেয়েকে এভাবে হারিয়েছি, শত বছরেও ভোলা সম্ভব নয়, একটা সময় চোখের পলক পড়ত না, এখন পলক পড়ছে কিন্তু অন্তরের কষ্ট কোনোভাবেই কমছে না।’ দোলার বোন কলেজপড়ুয়া নুশাও এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেন না বোনকে হারানোর সেই স্মৃতি। আর মা সামছুন্নাহার মেয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে ভাড়া বাসাটিও বদলাননি এখনো। বলেন ‘হাজি রহিম বক্স লেনের বাসায় এখনো থাকছি শুধু মেয়ের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে। এই বাসা থেকে ওর চলাফেরা, এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়া-আসা এখনো অনুভব করি।’ প্রিয় মানুষকে হারিয়ে বেদনায় কাতর মানুষের কান্না আমাদের হৃদয়কেও খামচে ধরে। তাদের মনের এমন ক্ষতগুলো কি ভুলিয়ে দিতে পারবে এ রাষ্ট্র?
এরও আগে পুরান ঢাকার নিমতলীতে আগুন লেগেছিল। সে সময় কয়েক পরিবারের মেয়ের দায়িত্বও নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ওই ঘটনার তদন্ত করে কি কোনো ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে? ২০১০ সালের ১৫ জুন তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ১৭টি সুপারিশ করে। যার মধ্যে প্রধান ছিল পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো সরানো। চুড়িহাট্টা এলাকায় আগুনের পর ওই এলাকার প্লাস্টিক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন নতুন জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কেরানীগঞ্জে আলাদা রাসায়নিক পল্লী করার পরিকল্পনার কথাও আমরা জেনেছি। কিন্তু সেই উদ্যোগের অগ্রগতি কতটুকু, তা আমাদের জানা নেই।
সিটি করপোরেশন বলছে ওই এলাকার ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমকে উন্নত করেছে তারা। দুর্ঘটনার পরের পরিস্থিতি সামলানোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বটে। কিন্তু কোনোভাবেই যেন আগুন লাগার ঝুঁকি না থাকে সেটি নিশ্চিত করা আরও জরুরি। শুধু পুরান ঢাকা নয়, কোনো জনবহুল এলাকায় যেন কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন না করা যায় সে বিষয়ে সরকারকেই কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা কোনো মৃত্যুকূপ নগরী চাই না। সরকার উন্নতির সোপানে পা রেখে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার পথে এগোচ্ছে। সেখানে নিশ্চিত করতে হবে মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু। এ দেশে মানুষের জীবন অতি তুচ্ছ হোক এমনটা প্রত্যাশিত নয়। তাই মানুষকে রক্ষার স্বার্থে যেকোনো ভালো উদ্যোগ সরকার বাস্তবায়ন করুক কঠিন হস্তে। আমরা আর চুড়িহাট্টা, নিমতলী বা চকবাজারের মতো মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি দেখতে চাই না। দুর্ঘটনা হয়তো ঘটবে। কিন্তু সরকারের নানা উদ্যোগের মাধ্যমে তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার চেষ্টার মধ্যেই নির্ভর করবে সরকারের প্রকৃত সফলতা।
ছবি: মাহমুদ হোসেন অপু
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১
© 2021, https:.