টিকাবান্ধব বাংলাদেশ
কয়েক সপ্তাহ আগেও করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে চলেছে নানা গুজব ও রাজনীতি। এখনো পুরোপুরি থেমে যায়নি সেটি। বরং ধরন পাল্টে জনমনে নানা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। গুজবের বেশির ভাগ বিস্তার ঘটেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রথমে বলা হচ্ছিল সরকার বিদেশ থেকে টিকা আনার সক্ষমতা রাখে না। আর কোনোভাবে সেটি আনলেও টিকা নিতে এ দেশের মানুষ আসবে না। ভারতীয় টিকা ক্ষতিকর বলেও প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বিপুলসংখ্যক লোক টিকা নিতে আসছে। বয়স্ক অনেকেই টিকাদান কেন্দ্রগুলোয় ভিড় করে টিকা নিচ্ছেন। মানুষের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। ফলে এ নিয়ে গুজব আর মিথ্যাচারগুলোও মিলিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে জনগণকে রক্ষায় সরকারের কার্যকর উদ্যোগ ও সক্ষমতার সত্য।
টিকা দেওয়া শুরু হলে চতুর্থ দিনেই নিজে টিকা নিই এবং এখন পর্যন্ত এর কোনো পাশ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করিনি। অনলাইনে সুরক্ষা অ্যাপে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করলেই এসএমএসের মাধ্যমে টিকার নির্ধারিত তারিখ জানিয়ে দেওয়া হয়। ওই তারিখে টিকাকেন্দ্রে গেলে সরকার বিনামূল্যেই দিচ্ছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের টিকা। বিশ্বে খুব কম দেশেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের নামও জায়গা করে নিয়েছে এটিও অন্যরকম ভালো লাগা তৈরি করে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধের টিকা নিলে লাভ কী? এ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ‘সংক্রমণ ছড়ানোকে বাধাগ্রস্ত করতে হলে ৬৫-৭০ শতাংশ মানুষের টিকা নিতে হবে।’ সহজভাবে বলা যায়, টিকাদান কর্মসূচি কোটি কোটি মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকিয়ে দিয়ে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের পথ তৈরি করবে। তাই টিকা গ্রহণে আগ্রহী যত বাড়বে বাংলাদেশের মানুষের তত দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথ তৈরি হবে। এতে দেশের অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াবে। তাই পরিবারে শুধু একজনই নয়, পর্যায়ক্রমে টিকা দিতে সক্ষম সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। শুরুর দিকে রোগী শনাক্তের হার বেশ কম ছিল। গত মে মাসের মাঝামাঝিতে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সেটি থাকে ২০ শতাংশের ওপরে। এরপর নতুন রোগীর পাশাপাশি শনাক্তের হারও কমতে থাকে। গত নভেম্বরের শুরুর দিকে নতুন রোগী ও শনাক্তের হার আবার বাড়লেও ডিসেম্বরে সংক্রমণ কমে যায়।
তাহলে করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাটি কেমন? গণমাধ্যমের খবর বলছে, করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণের পথেই রয়েছে বাংলাদেশ। কীভাবে? দেশে গত ১৯ জানুয়ারি পরীক্ষা অনুপাতে মোট শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর পরদিন থেকেই শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে। সর্বশেষ গত শুক্রবারও শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ৮২ শতাংশ বা ৩ শতাংশের ঘরে। অর্থাৎ গত ২৪ দিন বা তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দেশে করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহামারী নিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার টানা তিন থেকে চার সপ্তাহ ৫ শতাংশের নিচে থাকলে সে দেশে রোগটির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। সে হিসেবে আমাদের অবস্থা ভালোর পর্যায়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া এবং পৃথিবীর অনেক দেশেই সংক্রমণ কমছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে করোনাভাইরাস অনবরত পরিবর্তন হয়। যেহেতু বিশ্বব্যাপী যাতায়াত বেড়েছে, মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা কমলে, এটি যেকোনো সময় আবার বেড়ে যেতে পারে। আবার করোনাভাইরাসের সামান্যতম সংক্রমণও যদি কোনো দেশে হয় বা থাকে, তাহলে কেউই নিরাপদ নয়। আমাদের দেশে টিকা নেওয়ার প্রবণতা বাড়লে, মাস্ক পরিধান ও সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে একটা ভালো অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন তারা।
করোনার টিকা নিলে কি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়? এমন বিভ্রান্তি দূর করতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিডিসি বলছে ঠিক এভাবে ‘টিকা নেওয়ার কারণে কেউ কভিডে আক্রান্ত হবে না। কারণ এ পর্যন্ত যে টিকাগুলোকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তার কোনোটিতেই জীবন্ত ভাইরাস নেই। মূলত টিকা মানুষের দেহকে করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে এবং সেটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে শেখায়। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই সাময়িকভাবে অনেকের জ্বরের মতো উপসর্গ হতে পারে। এতে ভয়ের কিছু নেই। বরং ধরে নেওয়া যায় কভিড-১৯ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের বিরুদ্ধে দেহ সুরক্ষা গড়ে তুলতে শুরু করেছে।’ তাই মানুষের মনের এমন বিভ্রান্তি কাটাতে হবে। এ বিষয়ে অধিক পরিমাণ প্রচার কার্যক্রম হাতে নেওয়া প্রয়োজন।
ভারত থেকে আসা মানে কি টিকাটি ভারতের তৈরি? এমন প্রশ্নের উত্তরও জানা নেই অনেকের। সে সুযোগে ভারতবিরোধী প্রোপাগান্ডা ও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে একটি চক্র। মূলত ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা ‘কোভিশিল্ড’ উদ্ভাবন করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। এটি বানানোর জন্য অনুমতি বা এটির স্বত্ব দেওয়া হয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকাকে। সেরাম ইনস্টিটিউট এই টিকাটি উৎপাদনে অ্যাস্ট্রাজেনেকার সহযোগী প্রতিষ্ঠান। অনুমতি নিয়ে ভারতে তারাই এই টিকাটি উৎপাদন করছে। তাই ভারত থেকে আসা মানে এই নয় যে এটি ভারতের তৈরি টিকা। কোনোভাবেই মানবদেহের ক্ষতিও করে না সেটি।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, করোনা বা টিকা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও নানা ধরনের গুজব ছড়িয়েছে। ইতিমধ্যে গুজব প্রতিহত করতে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। তারা তথ্যপ্রযুক্তির বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানকে এই কাজে সঙ্গে নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকও এই কাজে তাদের সহায়তা করছে। টিকা নিয়ে গুজবের উৎস সন্ধান ও গুজব রটনাকারীকে শনাক্ত করার কাজে বাংলাদেশকেও আরও উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি কারা, কীভাবে টিকা নিতে পারবেন, টিকাকেন্দ্রগুলো কোথায় সে বিষয়েও ব্যাপক প্রচারণার প্রয়োজন রয়েছে। টিকাকেন্দ্রের তথ্য ও নির্দেশনাগুলো প্রচারে গণমাধ্যমও বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সারা দেশের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদেরও টিকা গ্রহণের বিষয়ে মানুষকে সচেতন ও উৎসাহিত করতে হবে। কিন্তু তার আগে জনপ্রতিনিধিদেরও টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশনাও জারি করা যেতে পারে। এগিয়ে আসতে পারে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও।
বিশ্বের কোথাও টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়নি। তবে কোনো ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা না থাকলে সবাইকেই এই টিকা নিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার থেকে সুরক্ষার পাশাপাশি অন্যকে সুরক্ষিত রাখতেও সহায়তা করে এই টিকা, যা মহামারী থেকে উত্তরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই গুজবকে প্রশ্রয় না দিয়ে টিকাকে গুরুত্ব দিতে হবে। করোনাকে প্রতিরোধ করতে টিকা নিতে হবে সবাইকে।
বাংলাদেশ কি পারবে সেই সুরক্ষার পথে এগিয়ে যেতে? চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার বিষয়ে বাংলাদেশের সফলতা ও অভিজ্ঞতা অনেক। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআইয়ের মাধ্যমে বহু বছর ধরে এ দেশের শিশুদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। সে টিকার সুফলও মানুষ পাচ্ছে। ফলে টিকা বিষয়ে মানুষের ভেতর পজিটিভ মানসিকতা তৈরি হয়ে আছে। এ নিয়ে সারা বিশ্বেই আমাদের সুনাম রয়েছে। তাই আমরা আশাবাদী, টিকা গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়বে এবং করোনা নিয়ন্ত্রণের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাব আমরা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১
© 2021, https:.