আদিবাসী

হাজংদের আদি উৎসব ‘প্যাক খেলা’

নেত্রকোনা জেলার একটি আদিবাসী গ্রাম লেংগুরা। নিজেদের আদি রীতিনীতি মেনে এখানেই বসবাস করছে প্রায় ৭০টি হাজং পরিবার।

আমরা পা রাখি নদী পাড়ের একটি হাজং বাড়িতে। বাড়ির ভেতর চলছে ধান মাড়াইয়ের কাজ। আবাল-বৃদ্ধ সবাই ব্যস্ত। কেটে আনা ধান শুকিয়ে তা থেকে ধান ছাড়িয়ে নিচ্ছেন কেউ কেউ। কেউ আবার ধান থেকে চাল তৈরি করে নিচ্ছেন।

কাজ থামিয়ে বাড়ির কর্তা দেবেন্দ্র হাজং আমাদের বসতে দেন। পরিচয় শেষে আলাপ জমাই হাজং আদিবাসীদের নানা বিষয়ে।

গারো ভাষায় ‘হা’ মানে মাটি, ‘জং’ মানে পোকা বা কীট। সূদূর অতীত থেকেই মাটির সঙ্গে সখ্য এদের। তাদের কৃষি কাজের কৌশল দেখেই গারোরা তাদের নাম দিয়েছিল ‘হাজং’। ধারণা করা হয় আগে হাজং নামে কোনো জাতি ছিল না। এ বিষয়ে হাজংরা বলেন, ‘গারো গিলা আমলা নাম থুছে হাজং’, অর্থাৎ গারোরা আমাদের নাম রেখেছে হাজং।

আবার অনেকেরই ধারণা প্রাচীন আসামের কামাখ্যা এলাকার কোচ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ‘হাজো’ বা ‘হাজু’ এর নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের হাজো নগরের বাসিন্দা ছিল বলেই কালক্রমে স্থানীয় লোকদের কাছে তারা ‘হাজং’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে হাজংদের ভাষ্যমতে, ‘হাজং’ শব্দের অর্থ প্রস্তুত হই, সজ্জিত হই, সংগঠিত হই। এরা মনে করেন, অতীতে তারা বারবার ছত্রভঙ্গ হয়ে পরে আবার সংগঠিত হয়েছে। আর এ অবস্থার কারণেই ‘হাজং’ নামের উৎপত্তি।

এ আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা আছে। পরিবার এবং নিজেদের মধ্যে তারা নিজ ভাষায় কথা বলে। তবে হাজং ভাষার কোন লিখিত বর্ণমালা নেই। বর্তমানে বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা থেকে অনেক শব্দ প্রবেশ করেছে হাজং ভাষাতে। দেবেন্দ্র আমাদের বুঝিয়ে দেন তাদের ভাষাটিকে। কারও নাম জানতে হাজং ভাষায় বলে- ‘তোলা কি নামে?’ ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ বাক্যটিকে হাজংরা বলেন- ‘ময় তগে ভালবাচে’, কোথায় বাঁশি বাজে- বাক্যটিকে বলে- ‘কুমায় বাঁশি বাজে’ প্রভৃতি। হাজংদের সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান, নান্দনিক রূপ এবং বিচিত্র ভাবনা প্রকাশ পায় তাদের ভাষাতে।

অন্যান্য আদিবাসীদের মতো হাজংরাও একেক জায়গায় পাড়া করে বাস করে। পাড়া প্রধানকে এরা বলে ‘গাওবুড়া’। তিনিই পাড়ার বিচার-সালিশসহ নানা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কয়েকটি পাড়া মিলে হাজংদের একটি গ্রাম হয়। গ্রাম প্রধানকে এরা বলে ‘মোড়ল’।

গাওবুড়াদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বিচক্ষণ তাকেই মোড়ল বানানো হয়। তিনিই গাওবুড়াদের সহযোগিতায় গ্রামের নানা সমস্যার সমাধান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এভাবে কয়েকটি গ্রাম মিলে হয় একটি চাকলা বা জোয়ার। এর প্রধানকে বলে চাকলাদার বা জোয়ারদার। মোড়লদের মধ্য থেকে একজনকে এ পদে মনোনীত করা হয়ে থাকে। আবার কয়েকটি চাকলা বা জোয়ারের সমন্বয়ে হয় একটি পরগণা। পরগণার সর্বময় কর্তা রাজা। হাজং সমাজে গাওবুড়া ও মোড়লের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদের মর্যাদা ও ক্ষমতাও বেশি। হাজং পাড়া বা  গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা গাওবুড়া ও মোড়লদের বিচক্ষণতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের উপর নির্ভর করে।

বড় একটি মাঠ পেরিয়ে নরেশ হাজংয়ের বাড়ি। নরেশের স্ত্রী স্বপ্না হাজং। নিজের কাজের অবসরে নরেশ গড়ে তুলেছেন একটি গানের দল। তাই হাজংদের উৎসবগুলোতে আশপাশ থেকে ডাক পড়ে তার। তিনি জানান তাদের একটি উৎসবের কথা।

হাজংরা এটিকে বলে ‘প্যাক খেলা’। সাধারণত  রোয়া (ধান গাছের চারা) লাগানোর সময় গ্রামের মোড়ল বা যাদের সামর্থ্য আছে তারা এ উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এটি হাজংদের একটি আদি উৎসব। এরা জমিতে রোয়া লাগায় ভাদ্র মাসে। একটি জমি ফাঁকা রেখে গ্রামের মোড়ল তার সব জমির রোয়া লাগানো শেষ করে। তারপর তিনি গ্রামের সবাইকে ডেকে আনতে নির্দেশ করেন চাকোরাকে (গ্রাম সমাজের একটি পদ)।

সবাই উপস্থিত হলে ঠিক হয় একটি তারিখ। মোড়ল সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, ‘আমার জমির শেষ রোয়া ওইদিন হবে। সবাই আসবেন।’ সাধারণত প্রতিঘর থেকে একজন নারীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কখনও কখনও পুরুষ ও শিশুরাও অংশ নেয় এ আনন্দ উৎসবে। পুরুষেরা জালা ভাঙ্গে (বীজতলা থেকে চারা তোলা) আর হাল বায়। আর মেয়েরা রোয়া লাগায়।

ওইদিন জমির একদিক রোয়া লাগালে অন্যপাশে সবাই গোল হয়ে নাচ-গানে মেতে উঠে। মহিলারা তখন গান গাইতে গাইতে একে অপরকে প্যাক মাখিয়ে দেয়। নরেশ থামতেই স্বপ্নার কণ্ঠে শুনি প্যাক খেলার গানটি।

প্যাক খেলার গানকে হাজংরা বলে ‘গুপনি গান’। এদের প্যাক খেলার নাচও অন্য উৎসব থেকে ভিন্ন। সকালে শুরু হয়ে প্যাক খেলা, শেষ হয় বিকেলে। এ সময় উলুধ্বনি দিয়ে হাজং নারীরা রোয়া লাগায় এবং সবাই সবার শরীরে প্যাক মেখে দেয়। এভাবে গ্রামের সবাই মিলে মোড়লের শেষ জমিটিতে রোয়া লাগানো শেষ করে।

খেলা শেষে দুটি হাড়িতে জমির প্যাক তোলা হয়। তারপর মোড়ল ও তার স্ত্রীকে বাড়ির উঠানে বসিয়ে সারা শরীরে প্যাক ঢেলে দেওয়া হয়। এরপরই মোড়ল সবাইকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে। গোসল সেরে সবাই খেতে আসে মোড়লের বাড়িতে। এ উৎসবে খাওয়ানো হয় বিন্নি ধানের ভাত, কাছিম (কাচ্ছোয়া) বা মাছ ও ডাল। আটা ও চাউলের গুড়া দিয়ে তৈরি কাসা মদ উৎসবের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

প্যাক খেলার নাচ-গানে হাজংরা খোল, ধাপা করতাল, জরি (মন্দিরা) প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও আনন্দ করাই এ উৎসবের মূল উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে হাজংদের দলবদ্ধতারও প্রমাণ মিলে। কয়েক বছর আগে এ গ্রামের মোড়ল লিলি হাজং প্যাক খেলার আয়োজন করলেও ধীরে ধীরে প্যাক খেলা হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসী সমাজ থেকে। হাজংদের জমি কমে যাওয়া, জমি বর্গা দিয়ে দেওয়া, নিমন্ত্রণ খরচ বেশি হওয়া ও আয় কম হওয়াই এর মূল কারণ।

দেবেন্দ্র আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘দাদার আমলে লেংগুরা গ্রামে জঙ্গল কেটে বসতি তৈরি করে হাজংরা। তখন এখানটায় ছিল না কোনো বাঙালি। হাজংদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, আচার ও সংস্কৃতি। টংক ও হাতিখেদাসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পূর্বপুরুষরা সরাসরি যুক্ত ছিলেন। অথচ স্বাধীন দেশে আমাদের পরিচয় হয়েছে ক্ষুদ্র জাতি হিসেবে। নানাভাবে আদিবাসীরা আজ হারিয়ে ফেলছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও আদি উৎসবগুলোকে।’

কোলাজে ব্যবহৃত অলঙ্করণ: সমর মজুমদার

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button