একাত্তরে আমরা দেশের জন্যই মরতে গিয়েছিলাম
‘আমাদের ভেতর বাঙালিত্বের চেতনাটা প্রবল ছিল। পাকিস্তানি সেনারা এসে মারবে, মেয়েদের তুলে নিয়ে অত্যাচার করবে–এটা সহ্য হচ্ছিল না। ইয়ং ছেলে হয়ে ঘরে বসে থাকব–হতেই পারে না। স্বাধীনতার জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য মরতেও প্রস্তুত ছিলাম। অত্যাচারীদের তাড়াব, এ দেশটাকে স্বাধীন করব– বুকের ভেতর এমন চেতনা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের জন্য ঘর ছাড়ার প্রস্তুতি নিই।
করুন মিয়া আমার চাচাতো ভাই। তাকে সঙ্গে নিয়ে সোনামুরা হয়ে চলে যাই ভারতের হাতিমারা ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখানে প্রতিদিন চলে লেফট-রাইট। ক্যাম্প চিফ ছিলেন আইয়ুব। মাসখানেক কেটে গেল। ক্যাম্পে তখন পাঁচশোর মতো যুবক। একদিন আসেন ভারতীয় কর্নেল বাগচি। ট্রেনিংয়ের জন্য যুবকদের বাছাই করেন তিনি।
আমি একটু বেটে, কিন্তু কথাবার্তায় পটু ছিলাম। বাগচি সাহেব সেটা খেয়াল করলেন। তিনি ইশারা করতেই কাছে এসে এক সেনা ধুপ করে আমার বুকে একটা ঘুষি দেয়। আমি তখনও সটান, একটুও হেলি নাই। তিনি বললেন– ‘ইয়েস হি ইজ দ্য ফিট পারসন।’ টিকে গেলাম। আমাকে সরিয়ে নেওয়া হয় অন্য লাইনে। এভাবেই ট্রেনিংয়ের জন্য রিক্রুট করা হয় ৫০ জনকে।
পরদিন সকালে চিড়া ও গুড়সহ আমাদের তুলে দেওয়া হয় ইন্ডিয়ান আর্মিদের বড় গাড়িতে। কোথায় যাচ্ছি জানা নেই। পাহাড়ি পথে একসময় এসে পৌঁছি আসামের শিলচর লোহারবনে।
ভিডিও:আমরা তো এই আশায় মুক্তিযুদ্ধে যাই নাই যে কিছু পাবো
ছিলাম চার নম্বর কোম্পানিতে। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর: ই-৬৩০৫। বেসিক ট্রেনিং হয় এক মাস। রাইফেল থেকে শুরু করে এসএমজি, এলএমজি, টু-ইঞ্চ, থ্রি-ইঞ্চ মর্টার চালানো শেখায়। সকালে উঠেই ফলিং করানো হতো। লোহারবন থেকে শিলচর পর্যন্ত চলে ডাবলমার্চ। ফিরে আসলে নাস্তা ছিল বুটের ডাল আর পুরি।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্রেনার হারবাজিং শিংয়ের কথা খুব মনে পড়ে। সুবেদার ছিলেন উনি। পুরো ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনসিং। উনাদের আন্তরিকতার কমতি ছিল না। উৎসাহ দিয়ে আমাদের বলতেন– ‘তোমরা দেশকে স্বাধীন করতে এসেছ। ভাল করে ট্রেনিং যদি না নাও পাকিস্তানিদের সঙ্গে টিকবে না। ট্রেনিং নিলেই পারবে দেশকে মুক্ত করতে।’
চানমারী (টার্গেটে গুলি লাগানো) ট্রেনিং যখন হয় তখন যে বেশি গুলি লাগাতে পারছে, তাদের নিয়ে আলাদা একটা গ্রুপ করা হয়। ওই গ্রুপকে ওরা বিশ দিন জে.এল.ডাব্লিউ (জুনিয়র লিডার উইং) ট্রেনিং দেয়। ওটা খুব কঠিন ট্রেনিং ছিল– মানকিং চাল, সেনেক চাল, একটা রশির ওপর দিয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাওয়া প্রভৃতি। কষ্ট যেমন জীবনের ঝুঁকিও ছিল তেমনই। তবুও দেশের জন্য সব কষ্টকে মেনে নিয়ে যুদ্ধের জন্য নিজেকে তৈরি করি আমরা। ওই দিনগুলোর কথা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না! আজও মনে হলে আনমনা হই। মূলত একাত্তরই আমাদের শক্তি আর বঙ্গবন্ধু প্রেরণা। এই দুয়ের অনুভূতি সরব আছে বলেই আজও মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি।’
একাত্তরের নানা ঘটনাপ্রবাহ এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত (হুইলচেয়ারধারী) বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ জানে আলম সাচন। তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয় যুদ্ধদিনের নানা বিষয় নিয়ে।
সৈয়দ জানে আলম সাচনের বাবার নাম সৈয়দ আশরাফ আলী ও মা সৈয়দা জাহানারা বেগম। দুই ভাইয়ের মধ্যে সচন ছোট। তাদের পৈত্রিক বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মৌচাগড়া গ্রামে। ব্রিটিশ আমলে বাবা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ডিস্ট্রিক্ট কানোনগো। পরে তিনি ভাওয়াল স্টেটের ল্যান্ড সুপারিন্টেড হন। সরকার যখন ভাওয়াল স্টেট নিয়ে নেয় তখন তারা কয়েকজনকে আড়াই বিঘার একটি করে প্লট দেয় ঢাকার নাখালপাড়ায়। সে সুবাধেই সাচনরা বসতি গড়েন নাখালপাড়াতে।
নাখালপাড়া প্রাইমারি ও নাখালপাড়া হাইস্কুলে লেখাপড়ার পর চলে যান ভগ্নিপতি আলী আজগর খানের কাছে, কিশোরগঞ্জে। মেট্রিক পাশ করেন রামানন্দ হাই স্কুল (বর্তমানে কিশোরগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল) থেকে। এরপর চলে আসেন ঢাকায়, ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে।
ভিডিও: আসামের শিলচর লোহারবন ট্রেনিং ক্যাম্পের স্মৃতি
৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন রেসকোর্স ময়দানে। খবর পেয়ে বন্ধু ডালিম, রফিকসহ অন্যদের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হন সাচনও। মনে তখন বৈষম্যের চাপা ক্ষোভ আর স্বাধীন হওয়ার তীব্র বাসনা। বাঙালির সেই বাসনাকে যেন উসকে দেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণে তিনি বললেন– ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না….তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব….এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম….।’ সাচনদের কাছে এই কথাগুলোই ছিল স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা।
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে পারিবারিক কাজে তারা চলে যান গ্রামে, কুমিল্লার মুরাদনগরে। ২৫ মার্চের পর ঢাকা থেকে সেখানে পালিয়ে আসতে থাকে শত শত লোক। তাদের মুখে মুখে গণহত্যার খবর। সে খবরে ঠিক থাকতে পারেন না সাচন। তাই ট্রেনিং নিতে ভারতের হাতিমারা ট্রানজিট ক্যাম্পে গিয়ে নাম লেখান।
ট্রেনিং শেষে তাদের পাঠানো হয় চার নম্বর সেক্টরে, কৈলাশ শহর সাবসেক্টরে। চাকলা ও রাঙাউটি বর্ডারে তারা ফ্রন্টফাইট করেন। কমান্ড করতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ফিল্ড মেজর জাং শিং। একপাশে পাকিস্তানি আর্মি আর ভারতীয় অংশে ছিলেন সাচনরা। বৃষ্টির মতো সারারাত গোলাগুলি চলত। প্রতিদিন মারা যেত সহযোদ্ধারা। তাদের লাশ কবর দেওয়া হতো পাহাড়ে। এভাবে প্রায় আড়াই মাস সম্মুখযুদ্ধ করেন তারা। মাঝেমধ্যে গেরিলার বেশে ভেতরে ঢুকে মনু নদীর ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া ও শমসের নগরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পেও হামলা করেন সাচনরা।
এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হন এই যোদ্ধা। বাঁ হাতের জয়েন্টের নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি দুই পাহাড়ের কুচিতে পরে যান। বর্তমানে তার হিপ জয়েন্টের হাড়ও একটার সঙ্গে আরেকটি লেগে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না। দুই লাঠি বা হুইলচেয়ারই তার সঙ্গী।
কী ঘটেছিল ওইদিনটিতে? জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা জানে আলম সাচন বলেন রক্তাক্ত ওই ঘটনার আদ্যোপান্ত। তার ভাষায়–
‘জুলাই বা অগাস্টের ঘটনা হবে। চার নম্বর সেক্টরে আমরা টিলাবাজার ক্যাম্পে। পাশেই বিএসএফ ক্যাম্প। ওখান থেকে মাঝেমধ্যে রাঙাউটি, শমসেরনগর এলাকায় যেতাম ফাইটে। একদিন রাঙাউটি বর্ডারে পাহাড়ের ওপর থেকে ফ্রন্টফাইট করছি। রাত হলেই ফাইট শুরু হতো। আমার অস্ত্র ছিল এলএমজি। টিলার মতো বড় পাহাড়ের ওপর থেকে ফায়ার করছি পশ্চিম দিকে। হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের একটা গুলি এসে বাঁ হাতের জয়েন্টের নিচ দিয়ে বাহুর মাংস ভেদ করে বেরিয়ে যায়। আমিও ছিটকে পড়ি দুই পাহাড়ের কুচিতে।
সহযোদ্ধারা তুলে নিয়ে যায় ভারতের কৈলাশ শহর হাসাপাতালে। আমার মেরুদন্ডের হাড় ডিসপ্লেস হয়ে গিয়েছিল। ওরা পা দুটো টানা দিয়ে রাখে প্রায় পনের দিন। এর পরই হাঁটতে পারতাম। ওখানকার ডাক্তার বলেছিলেন– এখন হাঁটতে পারলেও এটার রি-অ্যাক্ট হবে বয়স হওয়ার পর। তাই হয়েছে। এখন হিপজয়েন্ট ও র্যাম্বো ফিক্সড হয়ে গেছে। ফলে কুঁজো হয়ে গেছি। সারা বডিতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ডাক্তারি ভাষায় এটাকে বলে এনকোলোজিং স্পন্ডালাইসিস। ফলে দুটো লাঠি বা হুইলচেয়ার ছাড়া এখন চলতে পারি না। শরীরের সঙ্গে এমন যুদ্ধ চলবে মৃত্যু অবধি। তবুও আফসোস নেই। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা তো এনেছি। পেয়েছি একটি ভাষা, একটি পতাকা ও লাল-সবুজের একটি মানচিত্র। এটা ভেবেই তৃপ্ত হই।’
সুস্থ হয়ে কি আবার রনাঙ্গণে ফেরেন?
‘জ্বি, তখন তো যুদ্ধ করতে না পারলেই কষ্ট হতো। শুধু ভাবতাম কবে পাকিস্তানিগো এ দেশ থেকে তাড়ামু। কিন্তু চার নম্বর সেক্টরে অপারেশন করতে গিয়ে প্রায়ই বিপদের মুখোমুখি হতাম। সিলেটের রাস্তাঘাট ছিল অচেনা। ওটা ছিল অপরিচিত এলাকা। ফলে রাজাকারদের নজরে পড়ে যেতাম। সিলেটে ওদের নারী ইনফর্মারও ছিল। তারা দ্রুত পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে খবর দিয়ে আসত। এমন সমস্যার কথা জানাতেই আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় দুই নম্বর সেক্টরের মেলাঘরে, এ টি এম হায়দারের কাছে।
তিনি একটি গ্রুপ করে যারা যার থানায় পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। আমি চলে আসি নিজ এলাকায়, মুরাদনগর থানায়। কমান্ডার ছিলেন কামরুল হাসান ভূঁইয়া। তিনি তখন ক্যাডেট কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। এছাড়া আমাদের গ্রুপে ছিল বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশের লোকেরা।’
ভিডিও: গুলি খেয়ে পড়ে যাই পাহাড় থেকে
দুই নম্বর সেক্টরে একটি অপারেশনের কথা শুনি এই বীরের মুখে। তার ভাষায়– ‘প্রায় আড়াইশো মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কাশিমপুরে থাকতাম। ওটা ছিল মুক্তাঞ্চল। পরে আমরা রাজা চাপিতলা নামক জায়গায় ডিফেন্স করি। ওখান থেকে খুব সহজেই সবদিকে অপারেশন করা যেত। পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প ছিল মাত্র দুই-তিন মাইল দূরে, কোম্পানিগঞ্জে।
তখন ভাল ভাল অস্ত্র ছিল আমাদের কাছে। আর যুদ্ধ করে মনোবলটাও সুদৃঢ় হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাদের আমরা চ্যালেঞ্জ করলাম– ‘এখানে আছি। তোমরা পারলে আসো।’
দুই দিন চলে যায়। ওরা আসে না। তবুও কামরুল হাসান ভূঁইয়া পজিশনে থাকার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। রাত গিয়ে ভোর হয় হয়। তখন দেখলাম ওরা সামনে ও ডান সাইড দিয়ে ক্রলিং করে আসছে। দেখা যায় স্পষ্ট। সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডারের নির্দেশ–‘ফায়ার’। আমাদের সবগুলো অস্ত্র তখন গর্জে উঠে।
ট্রেন্স ও বাংকারে ছিলাম। ফলে আমাদের অবস্থানটা পোক্ত ছিল। দেখে দেখে গুলি করতে থাকলাম। ওরাও প্রত্যুত্তর দেয়। তুমুল গোলাগুলি চলে দিনভর। রাতেও ফাইট চলে। এক সময় আমাদের অ্যামুনেশন শেষ হয়ে আসে। নতুনভাবে অ্যামুনেশন সার্পোটও নাই। তখন কামরুল হাসান ভূঁইয়া বললেন–‘উইড্রো’। আমরা তখন নৌকায় চলে যাই রামচন্দ্রপুরে।
ওই অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনারা একটি গাড়িতে ওদের ৫০ জন সেনার লাশ তুলে নেয়। রাজাকাররাও মারা যায় ৩০ জনের মতো। ওদের লাশ পাকিস্তানিরা ফেলে দেয় খালে। অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন তিনজন আর আহত হয়েছিল চারজনের মতো। এরপর মুরাদনগর থানাসহ আরও কয়েকটি অপারেশনেও অংশ নিই।’
একাত্তরে চোখের সামনে সহযোদ্ধাদের মৃত্যযন্ত্রণা দেখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জানে আলম সাচন। সেসব স্মৃতি আজও তাকে ব্যথিত করে আনমনা করে দেয়।
তার ভাষায়– ‘চাকলা বর্ডারে এক রাতে ট্রেন্সে বসে গুলি করতেছি। বৃষ্টির মতো চু চু করে গুলি আসছে। পাশেই ছিল হুমায়ুন কবির। হঠাৎ ‘আলম ভাই’ বলে চিৎকার দিয়েই সে ছিটকে পড়ে। এলএমজি চালাচ্ছিলাম। ছুটে গিয়ে তাকে ধরি। তার সারা শরীর কাঁপছিল। কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু সে সুযোগ আর হয় না। বুকে ও পেটে গুলি লেগে তার কলিজাটা বেরিয়ে এসেছে। যন্ত্রণা আর কষ্টে খুব ছটফট করে সে। কাঁদতে কাঁদতে আমিও তাকে জড়িয়ে ধরি। বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে রাখি তার শরীরটাকে। কিছুক্ষণ ধরফর করে তার শরীর আমার বুকের মাঝেই নিথর হয়ে যায়। সহযোদ্ধা হারানো কি যে কষ্ট! ওইদিন চিৎকার করে খুব কেঁদেছিলাম। কষ্ট হলেও ভয় হতো না। যুদ্ধ ছেড়ে দিলে তো আমিও মারা যাব। তাই একাত্তরে সহযোদ্ধার মৃত্যুতে ভেতরে প্রতিশোধের আগুন শক্তিটাকেই বাড়িয়ে দিত।
মতলবের মজনুর কথাও মনে পড়ে খুব। মনু নদীর ব্রিজ উড়িয়ে রাতের অন্ধকারে দ্রুত ফিরে আসছিলাম আমরা। সে দলছুট হয়ে ইন্ডিয়াতে আসার রাস্তা ভুল করে অন্য রাস্তায় চলে যায়। ফলে সকালে ধরা পড়ে রাজাকারদের হাতে। তাকে ওরা পাঞ্জাবিদের ক্যাম্পে নিয়ে টর্চার করে। ওদের অমানবিক টর্চারে মারা যায় মজনু। লাশটা ওরা মনু নদীতে ফেলে দিয়েছে– লোকমুখে এমন খবর পেয়ে কয়েক রাত নদীতে সহযোদ্ধার লাশ খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। মজনুর মুখটা এখনো চোখে ভাসে। একাত্তরে আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশিকিছু ছিল সহযোদ্ধারা। একজন আরেকজনের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলাম। কে কৃষকের ছেলে, কে দিনমজুর, কে কোন ধর্মের– এসব তখন মুখ্য ছিল না। একটাই লক্ষ্য ছিল সকলে মিলে দেশকে মুক্ত করবো।’
অনেকেই তো মুক্তিযুদ্ধে যায়নি, আপনিও সেটা করলেন না কেন?
মুক্তিযোদ্ধা জানে আলম সাচনের উত্তর– ‘বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুধু দেশকে স্বাধীন করতেই যুদ্ধে গিয়েছি। নির্যাতিত জাতি থেকে মুক্তি পাব, একটা মুক্ত স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে বাঁচব– তখন এই চেতনা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি। কিছু চাওয়া-পাওয়ার আশায় তো মুক্তিযুদ্ধে যাইনি। একাত্তরে আমরা দেশের জন্যই তো মরতে গিয়েছিলাম। বেঁচে আছি এটাই ভাগ্য।’
যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?
আনমনা হয়ে এই যুদ্ধাহত বলেন–‘যে প্রশ্ন করেছেন সেটি বেশ পেইনফুল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন সোনার বাংলার কথা। ওটাই ছিল আমাদের স্বপ্ন। একটা উন্নত জাতি হব আমরা, দেশ হবে উন্নত। পৃথিবীর বুকে আমাদের পতাকাকে সবাই শ্রদ্ধা করবে। বলবে, ওরা বীরের জাতি, মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। সেই দেশ তো হয়নি। এখনও এদেশে রাজাকার আছে, এখনও আলবদর আছে, এখনও ধর্মীয় গোড়ামি আছে। আমার তো বাঙালি জাতি। এটাই তো বড় পরিচয় হওয়ার কথা। স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি থাকবে– এটা তো কামনাও করিনি। একাত্তরে পাকিস্তানিরা ধর্মের দোহাই দিয়েই তো ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল। তাহলে স্বাধীন এ দেশে কেন ধর্মীয় গোড়ামি থাকবে!’
ভিডিও: মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই ভারতীয় ট্রেনিংপ্রাপ্তদের দিয়ে করানো উচিত ছিল
এর কারণ কি বলে মনে করেন?
‘জাতির জনককে হত্যার পর দেশ আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরে যেতে থাকে। ফলে একাত্তরে যারা স্বাধীনতাবিরোধী ও গণহত্যায় সহযোগিতা করেছিল সেই আলবদর, আলশামস ও রাজাকারেরা জিয়ার হাত ধরেই নতুন জীবন পায়। ফলে ধর্মীয় গোড়ামি ও মৌলবাদের বীজ রোপিত হয় তখন থেকেই। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে গেলেও তার ভেতরে ছিল পাকিস্তানি মনোভাব। যার প্রতিফলন তিনি ঘটিয়েছেন রাজাকারদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করে। জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর নাম তখন মুখেই আনা যেত না। ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে জিয়া। তার দল নাকি এবার সাত মার্চ পালন করবে! শুনে হাসলাম। ভাই, কয়লা ধুইলেই কি ময়লা যায়?
তখনকার রাজনৈতিক নেতা আর এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের মূল্যায়ন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জানে আলম সাচন। তার ভাষায়–‘আগে সত্যিকারের রাজনীতিটা ছিল। রাজনৈতিক নেতারাও সত্যিকারের নেতা ছিলেন। এখন রাজনীতি নাই। পেটনীতির আর টাকার জন্যই রাজনীতি হয়। তবে কিছু ভাল নেতাও আছে। তখন ছাত্রনেতাদের টাকা ছিল না। এখন খোঁজ নেন কোটি কোটি টাকা তাদের। রাজনীতিবিদদের অবৈধ টাকার লাগাম টেনে ধরতে না পারলে দুর্নীতিও বন্ধ হবে না। এখন দুর্নীতিবাজদের জন্যই দেশের উন্নতি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ সঠিক পথে থাকুক। বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা শেখ হাসিনার মতো সৎ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটুক। তাহলেই দেশটা সোনার বাংলা হবে।’
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটাকে সামনে রেখে প্রজন্মই দেশটাকে এগিয়ে নিবে। দেশটাকে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবে। এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ জানে আলম সাচনের। তাই প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বললেন শেষ কথাগুলো। তার ভাষায়– ‘তোমরাই বীর জাতির সন্তান। আগে তোমাদের শিক্ষিত হতে হবে। দেশটা মায়ের মতো। তাই নিজের দেশকে ভালবেস। দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, যারা রক্ত দিয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন–তাদের ত্যাগের ইতিহাসটাও তোমরা জেনে নিও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে নিয়ে তোমরা দেশটাকে এগিয়ে নিও।’
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম: যুদ্ধাহত (হুইলচেয়ারধারী) বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ জানে আলম সাচন।
ট্রেনিং: আসামের লোহারবন ট্রেনিং ক্যাম্পে ত্রিশ দিনের বেসিক ট্রেনিং এবং জে.এল.ডাব্লিউ (জুনিয়র লিডার উইং) নামক বিশ দিনের বিশেষ ট্রেনিং নেন। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর: ই-৬৩০৫।
মুক্তিযুদ্ধ করেছেন: প্রথমে চার নম্বর সেক্টরের কৈলাশ শহর সাব-সেক্টরের অধীনে সিলেটের চাকলা ও রাঙাউটি বর্ডার ও শমসেরনগরের বিভিন্ন এলাকায়। পরে চলে যান দুই নম্বর সেক্টরে। অপারেশন করেন কুমিল্লার মুরাদনগর থানা, রাজা চাপিতলাসহ বিভিন্ন স্থানে।
যুদ্ধাহত: জুলাই বা অগাস্টের ঘটনা। চার নম্বর সেক্টরের রাঙাউটি বর্ডারে পাহাড়ের ওপর থেকে ফ্রন্টফাইটের সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটা গুলি এসে তার বাঁ হাতের জয়েন্টের নিচ দিয়ে বাহুর মাংস ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তিনি ছিটকে পড়েন দুই পাহাড়ের কুচিতে। তার হিপজয়েন্ট ও র্যাম্বো ফিক্সড হয়ে গেছে এখন। ফলে দুটো লাঠি বা হুইলচেয়ার ছাড়া চলতে পারেন না।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৮ মার্চ ২০২১
© 2021, https:.