মুক্তিযুদ্ধ

ইতিহাসের আকর-৭১: আমার বাবায় মরে নাই

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আলিউজ্জামান। ইয়াকুব আলী শেখ ও সাহেরা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান। বাড়ি গোপালগঞ্জের (সাবেক ফরিদপুর জেলা) কোটালিপাড়া উপজেলার ধরাল গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ধরাল প্রাইমারি স্কুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন একুশ বা বাইশ বছরের যুবক। যুদ্ধ করেছেন আট নম্বর সেক্টরে, হেমায়েত বাহিনীতে। অপারেশন করেন ঘাগোর, কালকিনি, কালিন্দি, কোটালীপাড়া ও বাঁশবাইরা প্রভৃতি এলাকায়। ঘাগোরে এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া গুলিতে তিনি রক্তাক্ত হন। গুলিটি তার ঘাড় দিয়ে ঢুকে ডান চোখের রগ ছিঁড়ে দুটি দাঁত ও চোয়াল ভেঙে বেরিয়ে যায়। ফলে ডান চোখটি সারা জীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারায়।

আলিউজ্জামানের বাবা কৃষিকাজ করতেন। জমিজমা ছিল খুব কম। তাদের বিলের জমি। সে জমিতে ফসল হতো না। বন্যার পানিতে তলিয়ে যেত জমির ধান। ফলে জীবন চালানো কষ্টকর ছিল। দুপুরে খেলে বিকেলে খাবার মিলত না। মা মারা যাওয়ার পর আলিউজ্জামানের বাবা আবার বিয়ে করেন। তখন তার লেখাপড়ায় মন বসে না। স্কুল কামাই দিয়ে ডেংবাড়ি (ডাংগুটি) খেলতেন। বাবা রাগ করতেন। ফলে ক্লাস ফাইভের পরই বন্ধ হয় তার স্কুলে যাওয়া। বাবার সঙ্গেই কাজে যেতেন তিনি। কাজ ছিল জমিতে ধান নিড়ানি, বন বাছা, ঝরা বাছা প্রভৃতি। এভাবে কষ্ট করেই কেটে যাচ্ছিল আলিউজ্জামানের জীবন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পাওয়ার পর পাল্টে যেতে থাকে তার জীবনপ্রবাহ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখার প্রথম ঘটনাটি আলিউজ্জামান বলেন ঠিক এভাবে “আমাদের ওখানে এক লোক ছিল খালেক জাইরা নাম। তাগো খুব ক্ষমতা। তারা মুসলিম লীগ করত। গ্রামে আমগো পছন্দের মানুষ ছিল শেখ আবদুল আজিজ। উনি এক দিন বললেন ‘এক নেতা আসতে লাগছে। শেখ মুজিবুর রহমান কইত তহন। কত মাইসে কয় মুজিবর। আওয়ামী লীগের। তোরা আওয়ামী লীগ করবি।’ আমরা বললাম করমু। উনি তহন বলেন ‘এতো সুন্দর ভাষণ দেয় তা বলার মতো না।’ আমি কই ‘তায় আমগো কোটালীপাড়া আইসবে।’ ‘হ্যাঁ আইসবে।’ শেখ মুজিব একবার খবর পাঠায় আসবে। উনি স্পিডবোটে আসছে। ঘাগোর বাজারের ঘাটলায় আমরা অপেক্ষায়। ছিলেন শেখ আবদুল আজিজ, গফুর, মুজিবুল হকসহ মেলা নেতারা। কোটালীপাড়ার কাছে কুরপাড়া, পুনাতি, গোপালপুর এলাকা। ওই দিককার মানুষ ছিল মুসলিম লীগের পক্ষে। তারা বলতেছে ‘না, আমাগো ওতো বড় নেতা লাগবো না। মুসলিম লীগই ভালো।’ শেখ মুজিব ওইদিকে গেলেন না।

আমি খুব শয়তানি করতাম। দূর থিকাই চেঁচাইয়া বলি ‘আপনি আইসেন। আপনি আমাগো বাবা, আইসেন। আমরা থাকতে কেউ বগলে আইতে পারবো না।’ স্পিডবোট থাইকাই আমারে দেখছেন। উনি আইসা ফাস্টেই আমার মাথায় হাতটা দিছে। এরপর থিকাই শেখ মুজিবরে বাবা ডাকতাম। ঘাগোর ডাকবাংলায় উনি বসলেন। ওইখানেই মিটিং করা হইল। উনি এরপর মাঝেমধ্যে আসতেন। মিটিং করতেন। উনি আসলেই আজিজ সাহেব, মুজিবুল ও গফুরদের বলতো মানুষকে মিষ্টি খাওয়াইতে।

একজনের নাম ছিল সেকেন্দার। বাবার খুব ভক্ত। বাবায় (শেখ মুজিব) মরার পরে উনি শোকে পাগল হইয়া যায়। পাগল অবস্থায় দু-তিন বছর ছিল। এরপরই মারা গেছে। বাবার জন্য পাগল এ রকম কিছু লোক নিয়া ঘাগোর থেকে কোটালীপড়ায় যাইতাম মিটিং করতে। বাবায় যতডা মিটিং করছে একটা মিটিংয়েও আমি বাদ নাই। প্রত্যেকটা মিটিংয়ে থাকতাম। আব্বা কিছু কইত না। উনিও মুজিবের পক্ষে। মাইনষের কাছে কইত ‘শেখ মুজিব যদি আইসে তয় আমার আলিউজ্জামান সেখানে আছেই। ও কেমবায় জানে আল্লাহই জানে।’ আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া আছিল না। ওটাই ছিল আমার রাজনীতি।”

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক দিনের ঘটনা তুলে ধরেন আলিউজ্জামান। তার ভাষায় “বাবায় (শেখ মুজিব) একটা পাইপে সিগরেট খাইত। খুব ঘ্রাণ হইত। উনি ডাকবাংলায় একটা খাটে শুইত। আইসো বলে আমারে ডাকত। আমি খাটের কান্দায় গিয়া বসতাম। এক দিন উনি পরসাবখানায় গেছে। উনার পাইক থাইকা খুব ঘ্রাণ আইছে। আমি ওইটা হাতে নিয়া ঘ্রাণ শুকি। উনি বাইরে এসেই তাকান। আমি বলি ‘জন্মের মতো ঘ্রাণ আইছে বাবা।’ শুনে বাবায় খুব হাসেন। আমাদের উনি অন্যরকম ভালোবাসতেন।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আনসার ট্রেনিং নেন আলিউজ্জামান। তিনি এক দিন ডেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন ‘বাবারে তোমরা আমার যে যে আছো আনসার ট্রেনিংয়ে যাও। এই দেশে বাঁচতে হলে আনসার ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন আছে।’

১৯৭০ সালের শেষ দিকের কথা। গোপালপুরের নায়েক, পশ্চিমপাড়া থেকে ট্রেনিংয়ে যায় আরও কয়জন। তখন গোপালগঞ্জ স্টেডিয়ামে হতো ট্রেনিং। বেয়াল্লিশ দিন ট্রেনিং চলে। একবার ফায়ারে ফাস্ট হন আলিউজ্জামান। ওই ট্রেনিংই পরে কাজে লাগে মুক্তিযুদ্ধে। আনসার ট্রেনিং তখনো শেষ হয়নি। নির্দেশ আসে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পোড়াতে যেতে হবে আনসারদের। আলিউজ্জামান তখন কৌশলে লুকিয়ে থাকে। ওইদিনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন ‘ট্রেনিংয়ের ভেতরেই ঘটনা। পাকিস্তানিগো নির্দেশ, আনসার গো যাইতে হবে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পোড়াইতে, গোপালগঞ্জ। এ কথা শোনাই বুকটা কামড়ায়া ধরে। আমরা দুজন লোক যাই নাই। লাকড়ির পেছনে লুকায়া থাকি। ছোটো সাহেব তখন অ্যাডজুট্যান্ট। নাম আনোয়ার কাজী। বরিশাল বাড়ি। উনি বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়। আমরা তো আর চিনি না। উনি বুঝতে পারলেন। ডেকে বলেন ‘ওই তোরা বঙ্গবন্ধুর লোক?’ পরে উনিই আমগো লুকায়া রাখেন। এরপরই তো যুদ্ধ শুরু হইয়া যায়।

স্বাধীনতা লাভের পর ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলিউজ্জামান এসেছিলেন ঢাকায়, বঙ্গবন্ধুর কাছে। তখনো তার মুখ ফোলা। এক চোখ নষ্ট। চেনার উপায় নেই। সহযোদ্ধারা তাকে সামনে রেখে বলে ‘নেতা দেখেন, গুলি কোথা দিয়ে ঢুকে কোথা দিয়ে বের হইছে।’ বঙ্গবন্ধু তাকিয়ে তার সামনে যান। চিনে ফেলেন তাকে। চোখের জলে জড়িয়ে ধরে বলেন ‘ধরালের আলিউজ্জামান না তুই।’

একটা ভিজিটিং কার্ড হাতে দিয়ে বলেছিলেন ‘মনা, এই কার্ড কেউ পায় নাই। তুই কোটালীপাড়ায় আগে পাইছস। পরে দেখা করিস।’ নানা কষ্টে পরিবার চললেও বাবার (শেখ মুজিব) কাছে আর যাওয়া হয় না আলিউজ্জামান। কেটে যায় কয়েক বছর। একবার নায়েক আর আজিজুলের সঙ্গে দিনক্ষণ ঠিক করেন। ওই কার্ড নিয়া দেখা করবেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। কিন্তু আগের দিন বিকেল বেলায় রাজাকার মকবুল আসে বাড়িতে। তামাশা করে বলে ‘তোমাগো মুজিব, ফুট্টুস। কুখ্যাত মুজিব।’ শুনে আলিমুজ্জামান মুষড়ে পড়েন। প্রতিবাদ করে বলেন ‘আমার বাবা কুখ্যাত না। তুমি অন্য শেখ মুজিবের কথা শুনছো। আমার বাবায় মরে নাই।’ উনি দৌড়ে যান আজিজের বাড়িতে। গিয়ে দেখেন সেও কাঁদছে। পরে নায়েকের বাড়িতে গিয়েই আলিউজ্জামান বাবার জন্য বেহুঁশ হয়ে পড়েন।”

মুক্তিযোদ্ধা আলিউজ্জামানের বয়স এখন সত্তর ছুঁইছুঁই। নানা রোগে ভুগছেন তিনি। তবু বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তার কাছে আজও জীবন্ত হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, পেয়েছেন তার সান্নিধ্যও। বঙ্গবন্ধুর আলিঙ্গন, তার দেওয়া ভাষণ, তার নির্দেশনা ও স্বপ্নগুলোই আলিউজ্জামানের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আজও অনিবার্য প্রেরণা হয়ে আছে।

লাখো মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমেই আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। সে দেশে আলিউজ্জামানের মতো বীর যোদ্ধারা হয়তো খুব বেশি দিন বেঁচে থাকবেন না। কিন্তু স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা পাবে, সেখানে অনিবার্য হয়ে উঠবে মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলা এমনটাই চান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১ মার্চ ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button