‘তখন আন্দোলন-সংগ্রামগুলো গ্রামপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। ছাত্রদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বটাও খুব বেশি ছিল। মানুষকে আমরা মোটিভেট করতাম। ছয় দফা ও এগারো দফা নিয়েও কাজ করেছি। বৈষম্যগুলো ছাত্র-যুবকদের মনে প্রবলভাবে ঝড় তোলে। এরপর তো নির্বাচন এলো। সত্তরের নির্বাচনে কুষ্টিয়ার মিরপুরে এমপি পদে আওয়ামী লীগের রউফ চৌধুরীর পক্ষে কাজ করেছি। তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দিলে সারা দেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ওই সময় আমরাও মিরপুরে মিছিল বের করতাম। রউফ চৌধুরী ছাড়াও আবদুল জলিল নেতৃত্ব দিতেন। তখনকার দিনগুলো ছিল মিছিলের দিন। এরপর খবর এলো বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন ৭ মার্চে। বুঝে ফেললাম কিছু ঘটবে। রেডিওতে শুনি সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি। বঙ্গবন্ধু বললেন ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি… তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে…।’ ওই ভাষণেই নেতা স্পষ্ট করে বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতার ঘোষণা এরপর আর লাগেনি।
একাত্তর-পূর্ববর্তী নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সোহরাব গণি দুলাল। আজাহার আলী শেখ ও ছুরাতন বেগমের বড় সন্তান দুলাল। বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুরের সুলতানপুর গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন বিএসসি ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র। ২৫ মার্চের পর সারা দেশে শুরু হয় গণহত্যা। মিরপুরে এসে থানা কাউন্সিলে ক্যাম্প করে পাকিস্তানি সেনারা। এরপরই গ্রামগুলোয় হানা দিয়ে তারা বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে থাকে। দুলালদের বাড়িও পুড়িয়ে দেয় ওরা। তার ভাষায় ‘আমরা দুই ভাই আর বাবা লুকিয়ে ছিলাম বাড়ির পেছনে, কুষ্টা (পাট) খেতের আড়ালে। দেখলাম দাউ দাউ করে বাড়িটা পুড়ছে। মিরপুরে পাকিস্তানি আর্মিদের সহযোগী ছিল নুর মোহাম্মদ বাটলার, ইউসুফ আলী মুন্সি, মাহবুব বিহারী ও মুসলিম লীগের নেতা মোজাম্মেল হক খান চৌধুরী, চুনু চৌধুরী প্রমুখ। ওরা আর্মিদের পথ দেখাত। কে আন্দোলন করছে, কারা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তাদের বাড়িঘর দেখিয়ে দিত। মোল্লা-মৌলভিদের একটা বড় অংশ ওই সময় জামায়াতের রাজনীতি করত। ওরা পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছে সবচেয়ে বেশি। গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত তারা। মিরপুর ও খন্দকবাড়িয়া, চিতলিয়ায়, দৌলতপুর থানার পাহাড়পুরে, আমলা সদরপুর এলাকায় একাত্তরে ঘটেছে এসব গণহত্যা।’
এরপরই দুলাল পরিবারসহ চলে যান ভারতে। একুশ দিনের ট্রেনিং নেন বিহারের চাকুলিয়ায়। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নম্বর ছিল ৮১৭৬। ট্রেনিং শেষে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিজ এলাকায়। ১২-১৩ জনের দল ছিল তাদের। গেরিলা ছিলেন। রাতের বেলা অপারেশন করতেন। দিনের বেলায় সমমনা মানুষের বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতেন। সাধারণ মানুষ খবর দিত, পথ দেখাত, খাবার দিয়ে সহযোগিতা করত। এমন সহযোগিতা না থাকলে অপারেশনগুলোয় গেরিলারা সহজে জয় লাভ করতে পারত না বলে মনে করেন এই মুক্তিযোদ্ধা। আট নম্বর সেক্টরের অধীনে তিনি যুদ্ধ করেছেন দৌলতপুর, মিরপুর, আমলা সদরপুর, চিতলিয়া, মশাল বলদিপাড়া প্রভৃতি এলাকায়।
এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন তিনি। কী ঘটেছিল ওইদিন? সোহরাব গণি দুলালের ভাষায় “নভেম্বরের শেষ দিকের ঘটনা। দৌলতপুর থানার তালবাড়িয়া গ্রামে মিলিশিয়া ও রাজাকাররা খুব অত্যাচার করত। বিকেলের দিকে প্রায়ই ওরা আসে। কারও গরু, কারও ছাগল ধরে নিয়ে যায়। এ খবরটা পাই লোকমুখে। কাছাকাছি একটা গ্রামে ছিলাম আমরা। তখনই প্ল্যান করি অ্যাটাকের। নিচু জায়গায় ও ক্ষেতের মধ্যে পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় থাকি। ওরা আসতেই শুরু হয় গোলাগুলি। মিনিট-ত্রিশেক চলে সেটা। কথা ছিল একটা রুমাল বা কাপড় উঁচু করে ইশারা দিলেই সহযোদ্ধারা পজিশন চেঞ্জ করবে। সন্ধ্যার ঠিক আগের ঘটনা। গোলাগুলি চলছে। আমি বাঁ হাত উঁচু করে রুমাল তুলতেই ওরা দেখে ফেলে। চু করে কয়েকটা গুলি এসে আমার বাঁ হাতের চারটি আঙুল স্পর্শ করে চলে যায়। রক্তাক্ত হয় হাতটা। চিৎকার করতেই ছুটে আসে সহযোদ্ধারা। প্রথমে নেওয়া হয় করিমপুর হাসপাতালে। আঙুলের হাড় কুচিকুচি হয়ে গিয়েছিল। ওখানকার ডাক্তাররা বললেন ‘আঙুলগুলো কেটে ফেলতে হবে।’ রাজি হলাম না। তখন উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের কৃষ্ণনগরে, শক্তিনগর হাসপাতালে। আঙুলগুলো টিকে গেলেও বাঁ হাতের আঙুল পুরোপুরি আর নড়াচড়া করতে পারি না। ফলে মুঠো করতে পারি না। শীতের সময় যন্ত্রণাও হয় খুব। ওই হাতে শক্তি পাই কম। এই কষ্টটা চলবে মৃত্যুর আগ পর্যন্তই। আফসোস নেই কোনো। স্বাধীনতার জন্য রক্ত দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি ভাবলেই গর্বিত হই।”
মুক্তিযুদ্ধে রক্তাক্ত হওয়া, আহতকালীন ছবি, হাসপাতালে চিকিৎসার প্রামাণ্য সব দলিল থাকা সত্ত্বেও এই মুক্তিযোদ্ধার নাম লিপিবদ্ধ হয়নি সরকারের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেলেও তিনি পান না যুদ্ধাহত ভাতা। পাননি যুদ্ধাহতের স্বীকৃতিও।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার দিনটি স্মরণীয় হয়ে আছে সোহরাব গণি দুলালের কাছে। তার ভাষায় “যার ডাকে যুদ্ধ করলাম, রক্ত দিলাম, দেশ স্বাধীন করলাম, তাকেই তো সরাসরি দেখলাম না কথাটা শামসুল আলম দুদু ও আনোয়ার আলী ভাইকে বলতেই তারা নিয়ে যান ঢাকায়, তৎকালীন খাদ্য প্রতিমন্ত্রী ও কুষ্টিয়া সদরের এমপি ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের কাছে। তিনিসহ সবাই যাই বঙ্গবন্ধুর কাছে। তিনি তখন বসতেন রমনা পার্কের উল্টোপাশে, সুগন্ধায়। তার স্পর্শ পাওয়ার ইচ্ছায় ছবি তোলার সময় আমি বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে গিয়ে বসি। ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পারলেন। দুই হাতে ঘাড় স্পর্শ করে বঙ্গবন্ধু বললেন এই তোর নাম কিরে? বলি ‘বঙ্গবন্ধু, আমার নাম সোহরাব গণি দুলাল।’ শুনেই তিনি আমার ঘাড়ে আবার থাবা দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন ‘ও তুই আলালের ঘরের দুলাল’। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই স্মৃতিটা থাকবে। বঙ্গবন্ধু মহাচুম্বক। উনার সংস্পর্শে একবার যদি কেউ আসছে সে বঙ্গবন্ধুকে কখনো ভুলবে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মা ভয়ে ছবিগুলো বালিশের ভেতর লুকিয়ে রাখতেন। তখন তো তার কথা মুখেই আনা যেত না। প্রকাশ্যে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় ও জয় বাংলা বলতেও পারিনি আমরা।”
রক্ত দিয়ে একটা মানচিত্র আর পতাকা পেয়েছেন তাতেই তৃপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুকন্যার সরকার কভিড-১৯ ভ্যাকসিন আনতে পেরেছে, মানুষ উপকার পাচ্ছে এটা ভেবেই আনন্দে মন ভরে যায় তার। পৃথিবীর কোনো দেশেই স্বাধীনতাবিরোধীদের নাগরিকত্ব থাকে না। কিন্তু এ দেশে তাদের নাগরিকত্ব ও ভোটাদিকারও আছে। বিষয়টি প্রবলভাবে পীড়া দেয় তাকে। তাই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানান তিনি। ধারণা করেন, ছদ্মবেশে তাদের লোকও সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে আছে। নতুন প্রজন্মই পারবে দেশকে এগিয়ে নিতে। এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সোহরাব গণি দুলালের। তাই প্রজন্মের উদ্দেশেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো ‘তোমরা যেখানে যে কর্মেই থাকো না কেন সৎ থেকো। দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসো। একাত্তরের বীরত্বের ইতিহাসটা জেনে নিও। তাহলেই স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা লাভ করবে।’
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১০ মার্চ ২০২১
© 2021, https:.