কলামমুক্তিযুদ্ধ

স্বাধীনতার ৫০ বছর: মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

একাত্তরে ছেলেকে বাঁচানোর অপরাধে শহীদ হন এক বাবা৷ সেই ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ কমান্ডো মো. শাহজাহান কবির (বীর প্রতীক) ক্ষোভের সঙ্গে কয়েকটি প্রশ্ন তুলে ধরেছেন৷ রাষ্ট্র কি শহীদদের তালিকা করেছে? শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস তুলে এনে কি প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পেরেছে?

একাত্তরের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মো. শাহজাহান কবির বলেন, ‘‘আমার বাবা মো. ইব্রাহীম বিএবিটি, চাঁদপুরের সফরমালি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন৷ অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় চাঁদপুর নদীবন্দরে নৌ অপারেশনের আগে প্রথম উঠেছিলাম নিজ বাড়িতে, চাঁদপুরের দাশাদিতে৷ অপারেশন শেষে বাড়িতেই আত্মগোপনে থাকি৷ এ খবর রাজাকারদের মাধ্যমে পেয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা৷ একাত্তরে স্কুল খোলা রাখার সরকারি নির্দেশ অমান্য করে বাবা সফরমালি স্কুল বন্ধ রেখেছিলেন৷ এ নিয়েও ক্ষিপ্ত ছিল ওরা৷’’

‘‘১৭ আগস্ট ১৯৭১, সকালবেলা৷ চার পাঁচটা নৌকায় বাড়ির চারপাশ ঘেরাও দেয় ওরা৷ অতঃপর আমার সঙ্গে বাবাকেও বেঁধে পিটাতে থাকে৷ বুটের লাথিতে  যন্ত্রণায় তিনি বাঁকা হয়ে যান৷ বাবাকে ওরা জিজ্ঞেস করে– ‘নৌ কমান্ডোরা কোথায়?’

মার খেয়েও তিনি মুখ খোলেন না৷ বাড়ি সার্চ করে কোনো অস্ত্র পায় না৷ ফলে আমাদের বেঁধে নৌকায় তুলে নেয়৷

আমার হাত ও পা বাঁধা৷ নৌকায় বাবাকে পাশেই ফেলে রাখছে৷ ব্যাথায় উনি গোঙ্গাচ্ছেন৷ জুটমিলের লেবার সর্দার ছিল বাচ্চু রাজাকার৷ সেও নৌকায়৷ বুড়ো মানুষ দেখে আরেক রাজাকার বাবার হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে দেয়৷ পাকিস্তানিদের বুটের আঘাতে তার সারা শরীর ফুলে গিয়েছিল৷

নৌকায় ওরা ব্যস্ত থাকে লুট করে আনা টাকা ও সোনা-রুপা নিয়ে৷ সে সুযোগে বাবা কানে কানে বলেন– ‘তুই এখান থেকে পালা৷’ কৌশলে আমার হাত ও পায়ের বাঁধনও খুলে দেন৷ অস্ত্র হাতে নৌকার দুই পাশে দুজন পাকিস্তান সেনা দাঁড়ানো৷ এক সাইডে একটারে পা ধরে পানিতে ফেলে দিই৷ এরপরই ঝাপ দিই৷ ওরা ব্রাশ ফায়ার করে৷ কিন্তু তার আগেই চলে যাই দূরে৷

খানিক পরেই কানে আসে কয়েকটি গুলির শব্দ৷ বুকের ভেতরটা তখন খামচে ধরে৷ ছেলেকে বাঁচানোর অপরাধে শহীদ হয়েছেন বাবা৷ বাবার দেওয়া জীবন নিয়েই বেঁচে আছি ভাই৷ একাত্তরে এমন হাজারো পিতা শহীদ হয়েছেন৷ স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা কি মনে রেখেছি তাঁদের? রাষ্ট্র কি একাত্তরের শহীদদের তালিকা করেছে? শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস তুলে এনে প্রজন্মের কাছে কি তুলে ধরতে পেরেছে?

একাত্তরে বাবার শহীদ হওয়ার ইতিহাস তুলে ধরে ক্ষোভের সঙ্গেই প্রশ্নগুলো তোলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নৌ কমান্ডো মো. শাহজাহান কবির (বীর প্রতীক)৷

যুদ্ধ করেই দেশ ও স্বাধীনতা এনেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা৷ শহীদ ও যুদ্ধাহতদের রক্ত দিয়ে স্বাধীন দেশের মানচিত্র তৈরি করেছেন তারা৷ তাই আমাদের দেশের মানচিত্র রক্তের মানচিত্র, ৩০ লাখ শহীদের মানচিত্র, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ের মানচিত্র৷ এটাই পরম পাওয়া, তৃপ্তির জায়গা৷ ফলে এটাও জরুরী জাতির বীর সন্তানেরা কোন দেশের স্বপ্ন দেখেছেন, সেই স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে তা জানা৷

স্বাধীনতা লাভের পর একটা বড় সময় ধরে ক্ষমতায় ছিল স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী দল ও সামরিক সরকার৷ তখন রাজাকাররা পুর্নবাসিত হয়েছে, স্বাধীন দেশের লাল-সবুজের পতাকাও উড়েছে তাদের গাড়িতে৷ এটি যেমন ইতিহাসের কলন্কজনক অধ্যায় তেমনি ওইসময়ে ইতিহাস বিকৃতিও ঘটেছে নগ্নভাবে৷ জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর কথা মুখেই আনাই যায়নি৷ ফলে কয়েক প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাস জেনেই বড় হয়েছে৷ ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আজও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা চলে৷ যার বেশির ভাগ ঘটছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায়৷ তার সময়ে সম্মানিত হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা৷ ভাতা বৃদ্ধি, আবাসনসহ নানা সুবিধা পাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলো৷ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচার করে চিহ্নিতদের ফাঁসির রায়ও কার্যকর করা হয়েছে, বিচার এখনও চলমান ৷ এতে মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্টের পাহাড় অনেকটাই নেমে গেছে৷ এটি সরকারের সাহসী উদ্যোগ যা জাতির জনকের কন্যা ক্ষমতায় না থাকলে সম্ভব হতো না বলে মনে করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা৷  তাদের ভাষায়-‘কষ্টের সময়টা মুছে দিছে শেখের মাইয়া’৷

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন৷ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিদ্ধার্থ শংকর রায়কে বলেছিলেন– ‘আমি বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার একটা বীজ পুতে রেখে গেলাম৷ এই বীজ যেদিন উৎপাটন করা হবে, সেদিন বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে৷’ কিন্তু আমরা কি বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের পথে এগোচ্ছি?

একাত্তরে সাধারণ মানুষ, আদিবাসীসহ সকল ধর্মের লোক এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য৷ মুক্তিযোদ্ধারাও চেয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ৷ কিন্তু এখন তা ধর্মান্ধতার দিকে এগোচ্ছে বলেন মনে করেন অনেকেই৷ কেননা জাতির জনকের ভাস্কর্য ভাঙার মতো ঘটনাও ঘটেছে এ সময়ে৷ থেমে নেই হিন্দু বাড়িতে হামলা, প্রতিমা ভাঙা, ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনাও৷ ধর্মনিরপেক্ষতা মানে যে ধর্মহীনতা নয়, এটি পরিস্কারভাবে বলেন গেছেন জাতির জনক৷ এসব বিষয়ে সরকার এখনই জিরো টলারেন্স না দেখালে ভবিষ্যতে সমস্যার মুখে পড়বে বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধারা৷ তাদের অকপট বক্তব্য- ‘তুমি হিন্দু কি মুসলমান- দেখতে চাই না৷ দেখতে চাই তুমি বাংলাদেশকে ভালবাস কিনা৷ তুমি বাঙালি কিনা৷’

স্বাধীনতার এতো বছরেও আমরা রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রণয়ন করতে পারিনি৷ যা করা দরকার ছিল প্রথমেই৷ তৈরি হয়নি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল তালিকাও৷ এ জন্য নিশ্চয়ই বীর মুক্তিযোদ্ধারা দায়ী নন৷ কিন্তু এখন নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ, মানসিক ও সামাজিক চাপের মুখে পড়ছেন তারাই৷ সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে বাতিল তালিকায় নিজের নাম দেখতে পেয়ে স্ট্রোক করে মারা গেছেন নওগাঁর ধামইরহাটের বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহার উদ্দীন৷ অথচ সেখানকার যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফরমুদ হোসেন বলছেন- উনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন৷ তাহলে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর দায় কি রাষ্ট্র এড়াতে পারে?

যাচাই-বাছাই কমিটিতে যেসকল মুক্তিযোদ্ধারা থাকেন৷ তারা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বা স্বার্থের উধ্বে কতটুকু থাকতে পারছেন তা নিয়েও প্রশ্নে উঠেছে৷ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বিষয়টিও যাচাই-বাছাইয়ে সামনে আনা হচ্ছে৷ আবার এ নিয়ে অর্থ লেনদেনের বিষয়ও উঠে আসছে গণমাধ্যমে৷ যা কেনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়৷

অনেক মুক্তিযোদ্ধাই এখন সরকারের কাছে জানতে চান, এটাই শেষ যাচাই-বাছাই কিনা৷ প্রায় ৭০ বছর বয়সী এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন- ‘মুক্তিযুদ্ধ করে কি ভুল করেছি? একাত্তরে যুদ্ধ করার অপরাধে আর কতবার যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হতে হবে৷ সম্মানের প্রয়োজন নেই৷ বরং এমন অপমান করা বন্ধ করেন৷’

মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পরও সরকারের ছয় সচিবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ বরং তাদের সনদ বাতিল করে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে মাত্র৷ সনদ বাতিল তো কোনো শাস্তি নয়৷ বরং এর সঙ্গে যুক্ত সকলকেই আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন ছিল৷ ফলে এটি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে৷ পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা কোটা  সংশোধনের পরিবর্তে বাতিল করাতে হতাশ হয়েছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারও৷

একেকজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গদ্যই মুক্তিযুদ্ধের একেকটি ইতিহাস৷ অথচ তৃণমূল থেকে সে ইতিহাস তুলে আনার কাজটি হয়নি খুব বেশি৷ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশের বয়স এখন ষাটের ঊর্ধ্বে৷ অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন৷ ফলে তাদের মৃত্যুর সঙ্গেসঙ্গেই মৃত্যু ঘটছে একটি ইতিহাসের৷ সারা দেশের বধ্যভূমি ও গণহত্যার স্থানগুলো সংরক্ষণ এবং তার ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কার্যকরী উদ্যোগও নিতে হবে সরকারকে৷

একাত্তরে জঘন্যতম গণহত্যার জন্য পাকিস্তান আজও ক্ষমা চায়নি, বিচার করেনি তৎকালীন একজন জেনারেলেরও৷ তাই স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের এই সময়ে একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়াসহ পাকিস্তানকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই হতে পারে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা৷

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ডয়চে ভেলেতে, প্রকাশকাল: ৩১ মার্চ ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button