মাস্ক ম্যাজিস্ট্রেসি
করোনায় নতুন এক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে পুরো বিশ্বকে। টিকা নিয়েও চলছে নানা রাজনীতি। আবার ভাইরাসের কোন ভ্যারিয়েন্ট কতটা ক্ষতিকর তা নিয়ে গবেষণাও চলছে বিস্তর। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে তুলে ধরছেন দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা। যখন লিখছি তখন করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত ভারতে দৈনিক মৃত্যু নতুন উচ্চতায় উঠেছে। শনাক্ত নতুন রোগীর সংখ্যা কমলেও সংক্রমণ আড়াই কোটি ছাড়িয়েছে।
ভারত আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতিম দেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে প্রায় তিনদিকেই সীমান্ত রয়েছে দেশটির। সেই সীমান্ত পেরিয়ে করোনাভাইরাসের ক্ষতিকর ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ করলে কী অবস্থা হবে আমাদের? আমরা কি পারব সেই মহামারী ঠেকাতে? করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর মতো কৌশল বা সচেতনতাবোধ সাধারণ মানুষের মধ্যে কি যথেষ্ট তৈরি হয়েছে?
ভারত থেকে সীমান্ত পথে যারা দেশে প্রবেশ করছেন তাদের সঠিক নিয়মে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। এ ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে সীমান্তের দুর্বলতা বা উদাসীনতা যেন কোনোভাবেই আমাদের ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। সীমান্ত পথে ভারত থেকে আগতদের মধ্যে কে কোন মন্ত্রী, এমপি, আমলার ভাই, বোন বা নিকট আত্মীয় সেই পরিচয়ে যেন মুখ্য হয়ে না ওঠে। মূলত ভারত থেকে আগতদের নিয়ন্ত্রণের ওপরই এখন নির্ভর করবে সরকারের দক্ষতা।
ঈদ শেষে আবারও ঢাকা মহানগরে ফিরতে শুরু করেছে লাখো মানুষ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা এই দুই সপ্তাহ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবারও বাড়বে। বলা যায় একরকম সরকারি নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই বিপুলসংখ্যক মানুষ এবার ঈদ করতে ঢাকার বাইরে গিয়েছে। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেরিতে গাদাগাদি করা মানুষের ছবি উঠে এসেছে বেশি। কিন্তু ব্যক্তিগত ও ভাড়া করা গাড়িতে এবং বিমানে যাতায়াতকারীর সংখ্যাও কম ছিল না। এর অর্থ দাঁড়ায় সরকার নির্দেশনা বাস্তবায়নে তেমন কঠোর ছিল না। প্রায় নিরুপায় হয়ে রুটিন দায়িত্বপালন করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ঈদযাত্রায় মাস্ক ছাড়া চলাচল করতে দেখা গেছে বহু মানুষকে। তরুণ ও যুবক বয়সী অনেকেই মনে করেন মাস্ক না পরলেও তার কিছু হবে না। আবার নিম্ন আয়ের মানুষের ভাষ্য করোনাভাইরাস বড়লোকদের রোগ। ফলে তারা আক্রান্তই হবেন না। সারা দেশের পেশাজীবী বহু মানুষ গরমের অজুহাতে মাস্ক পরেন না। তাদের মাস্ক থাকে পকেটে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখানোর প্রয়োজনে।
গণমাধ্যমে সরকারের দায়িত্বশীলরা এর কারণ হিসেবে শুধু মানুষের ব্যক্তিগত সচেতনতাবোধের অভাবকেই বারবার তুলে ধরেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে নাগরিকদের সচেতনতাবোধ তৈরি এবং এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা কঠোরভাবে মানানোর দায়িত্বও রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়।
আবার ঈদে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকারি নির্দেশনা অনেকটা লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছে বলে মনে করে অনেকেই। সেখানে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষিত হয়েছে প্রবলভাবে। ফলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সরকারি সিদ্ধান্তও অনেক ক্ষেত্রে দায়ী।
তাহলে কি সরকার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আন্তরিক নয়? অবশ্যই আন্তরিক। টিকা বিষয়ে আমাদের অগ্রগতি এবং গত বছরের করোনাভাইরাস মোকাবিলার দক্ষতাই তা স্পষ্ট করে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারি সিদ্ধান্তগুলো আরও সুচিন্তিত হবে- এমনটাই আমাদের আশা।
এবার আসি ব্যক্তিগত সচেতনতাবোধ তৈরি প্রসঙ্গে। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সচেতনতাবোধ তৈরির উদ্যোগ কি আমরা নিয়েছি? কেউ মাস্ক না পরলে সম্মিলিতভাবে তার কাছে কি আমরা জানতে চেয়েছি কেন তিনি মাস্ক পরলেন না। ফেরিতে মাস্কবিহীন গাদাগাদি করে যাওয়া, শপিংয়ে আসা মানুষগুলোকে কি মাস্ক না পরায় সামাজিকভাবে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে? উত্তরটি অবশ্যই না। আমরা যদি করোনার সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে রেখে অর্থনীতিকে সচল রাখতে চাই তবে সামাজিক সচেতনতাবোধ তৈরি ও তা ধরে রাখতে হবে সবার প্রথমে। মনে রাখতে হবে মাস্ক পরানোর দায়িত্ব শুধু সরকার বা প্রশাসনের নয়? নিজেকে বাঁচাতে, পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে, নিজের উপার্জনকে সচল রাখতে নিজ উদ্যোগেই মাস্ক পরতে হবে এবং অন্যকেও মাস্ক পরার কথা বলতে হবে।
এ বিষয়ে সারা দেশে পাড়া-মহল্লায় সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে ছোট ছোট নাগরিক কমিটি করা প্রয়োজন। যারা ওই এলাকার মানুষকে মাস্ক পরা বা হাত ধোয়ার বিষয়ে সচেতন করতে কাজ করবে। কেউ মাস্ক না পরলেও সবাই মিলে তাকে বোঝানোরও দায়িত্ব নিতে পারে। সেটিও ব্যর্থ হলে প্রশাসন তার বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। এই কমিটিগুলোতে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধি ছাড়াও শিক্ষক ও বিশ^বিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। প্রতিটি কমিটির তালিকা থাকবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে। কমিটিগুলোর নানা কার্যক্রমে প্রশাসন সহযোগিতা করবে। এভাবে সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে মানুষের মধ্যে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় অভ্যস্ততা অনেক বাড়বে। এতে অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াবে।
কিন্তু উল্লিখিত সামাজিক উদ্যোগের দিকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলকের সরকারি নির্দেশনা নিশ্চিত করতে পুলিশকে ‘ম্যাজিস্ট্রেসি’ ক্ষমতা দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। ঘরের বাইরে ও কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক হলেও মাস্ক ‘ব্যবহারে শিথিলতার’ কারণকে এমন পদক্ষেপের পেছনে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। যদিও কী ধরনের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হবে সেটি এখনো জানা যায়নি।
পুলিশ হচ্ছে আদেশ বাস্তবায়নকারী সংস্থা। তাদের যদি বিচারক দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সরকারের যে ভারসাম্য আছে, সেটা নষ্ট হবে এবং বিচারিক ক্ষমতার অপব্যবহার বেশি হবে বলেই মনে করেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা। এতে সরকারের ভেতর নতুন ধরনের সংকট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। যা সরকারের জন্য বিবৃতকর হতে পারে। বিদ্যমান অবস্থাতেই সরকারকে কঠোর ঘোষণা দিতে হবে যে, যাদের মাস্কবিহীন দেখা যাবে, তাদের অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড দেওয়া হবে। বিভিন্ন জায়গায় ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে জরিমানা ও তাৎক্ষণিক বিচারের ব্যবস্থা যদি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে জনগণ মানতে বাধ্য হবে। একেক সময় একেক ঘোষণা না দিয়ে, সরকার যদি সুনির্দিষ্টভাবে কঠোর বার্তাটা মানুষকে দিতে পারে, তাহলে অবশ্যই সরকারি আদেশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে একেবারেই ফ্রন্টলাইনে থেকে কাজ করছে পুলিশ বিভাগ। তারাও নানা উদ্যোগ নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, যা পুলিশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে। কিন্তু সংক্রমণ ঠেকানোর অংশ হিসেবে তাদের হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি তুলে দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে কি না, সেটি বাস্তব ভিত্তিতে যাচাই করা বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। তাই মাস্ক ম্যাজিস্ট্রেসি নয়, সামাজিক সচেতনতাবোধ তৈরিতে উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২০ মে ২০২১
© 2021, https:.