কত কষ্টে স্বাধীনতা পেয়েছি- ছবিগুলো দেখে প্রজন্ম ভাবুক
- যুদ্ধ-আলোকচিত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ রায়হান
“তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। হঠাৎ একদিন বাবা অসুস্থ হন। তার ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ওই উপার্জনেই পরিবার চলত। ব্যবসায় তখন ধস নামে। সেই টেনশনেই অসুস্থ হন তিনি। ফলে পরিবারেও নেমে আসে চরম বিপর্যয়। বড় ছেলে আমি। সংসারের হাল ধরতে হবে। তাই লেখাপড়া বাদ দিয়েই কাজে নামি। তামাক পাতার ব্যবসা শুরু করি প্রথম। কিন্তু সেটি নিয়ে খুব বেশি এগোতে পারি না। পরে ম্যানেজার পদে চাকরি নিই কুতুবউদ্দিন অ্যান্ড সন্স টোবাকোতে। ওরা ছিল পাকিস্তান টোবাকোর ডিস্ট্রিবিউটর। ওখানেই কাজ করেছি মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত।
রাজনীতিতেও যুক্ত থাকতাম। ভাষা আন্দোলন করেছি। কুষ্টিয়াতে আমিসহ পাঁচজনকে ভাষা সংগ্রামী হিসেবে এখনও সম্মাননা দেওয়া হয়। যুক্ত ছিলাম প্রায় সব আন্দোলন সংগ্রামেই।
ফটো তোলার ঝোঁক ছিল আগে থেকেই। একটা কম দামি ক্যামেরা ছিল, লুবিডর ক্যামেরা। ওটা দিয়েই ফটো তুলতাম। ইয়াসিকা ক্যামেরা পোস্টালে অর্ডার করা যেত তখন। টাকা জমিয়ে ৫০০ টাকায় ইয়াসিকা সিক্স-থাট্টিফাইভ ক্যামেরা করাচি থেকে আনাই পোস্টালের মাধ্যমে। ওই ক্যামেরাটাই ইউজ করেছি একাত্তরে।
ফটোগ্রাফি শিখেছি নিজে নিজে। আগ্রহ ছিল খুব। স্টুডিওতে গিয়ে দেখতাম কীভাবে ওরা এনলার্জ করে। তখন কৌতুহলও বেড়ে যায়। খুব বেশি টাকা ছিল না। তাই লেদমেশিনে নিজের মতো করে যন্ত্রাংশ তৈরি করি। করাচি থেকে দেড়শ টাকায় আনাই একটা লেন্সও। রেলগেইটের লাইটে যে কাঁচ লাগানো থাকে, ওরকম দুটো কাঁচও জোগাড় করি। এগুলো দিয়েই বানাই এনলার্জ। অথচ ওটা বানানোর কথা তখন চিন্তাও করা যেতো না। ফটো তোলার নেশা থেকেই সেটি সম্ভব হয়েছিল।
সন্ধ্যায় অফিস বন্ধ হয়ে যেত। নানাভাবে কাজ করে অফিসের ভেতর একটা রুমকে স্টুডিও বানিয়ে ফেললাম। নিজেই সব করতাম। ওভাবেই ফটোগ্রাফির আগ্রহটাকে জীবন্ত করে রাখি।
তারপর এলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা এবং রাজনীতিতে জড়ানোর প্রসঙ্গে। ক্যামেরা হাতে বলতে গেলে সারাজীবনই কাটিয়ে দেওয়া রায়হান বলেন, “বাল্যবন্ধু ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। ১৯৭০ সালের মার্চের ঘটনা। তখন আমি কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট। নির্বাচনী জনসভা হবে, শেখ মুজিব আসবেন কুষ্টিয়াতে। ব্যারিস্টারকে তিনি বললেন, ‘তুই যশোরে আয়, আমি রাতে নামবো ওখানে।’ ব্যারিস্টারসহ একটা গাড়ি নিয়ে আমরা যাই যশোরে। কিন্তু ওইদিন ফ্লাইট লেইট হয়। বেশি রাত হওয়ায় বঙ্গবন্ধুকে ঝিনাইদহেই রাখলাম। সকালে নিয়ে আসি কুষ্টিয়াতে, উনি ওঠেন ডাকবাংলোতে।
বঙ্গবন্ধুকে খাওয়ানোর দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। বাড়ির গরুর দুধ পর্যন্ত তাকে খাইয়েছি। মায়ের বয়স তখন অনেক। বঙ্গবন্ধুকে উনি খুব পছন্দ করতেন। তাই ওইদিন অসুস্থ শরীর নিয়েই ভাষণ শুনতে হাজির হয়েছিলেন কুষ্টিয়া ইউনাইটেড হাইস্কুল মাঠে। পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধুর যে ভূমিকা দেখেছি, তখনই বুঝেছি, নেতা একটাও যদি হয় তিনিই হবেন। বাঙালিকে ভালোবাসেন এমন জোরদার নেতা তখন তেমন ছিল না। ফলে বঙ্গবন্ধুই হয়ে ওঠেন বাঙালির প্রাণের নেতা। কুষ্টিয়াতে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি পোট্রেট ও জনসভার ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছিলাম। ওই ছবিগুলোই আজ কথা বলছে। একাত্তরের আন্দোলন, প্রতিবাদ, আত্মত্যাগ ও বীরত্বের ইতিহাসটাও ছবির মাধ্যমেই জীবন্ত হয়ে আছে।”
বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে যাওয়া ও ছবি তোলার আগ্রহের কথাগুলো এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধ-আলোকচিত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ রায়হান।
এক সকালে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।
চয়েন উদ্দিন ও মা জোবেদা খাতুনের বড় সন্তান হামিদ রায়হান। পৈতৃক বাড়ি হারিপুরের গড়াই নদীর ওপারে, শালদা গ্রামে। পরে তারা চলে আসেন কুষ্টিয়া শহরে, ৫২ মসজিদ বাড়ি লেইনে (বর্তমানে সেটি ১১ নম্বর খলিলুর রহমান সড়ক)। হামিদ রায়হানের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি আলোপাড়া প্রাইমারি স্কুলে। এর পর তিনি নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন কুষ্টিয়া মুসলিম হাই স্কুলে।
৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরেই সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। কুষ্টিয়াও উত্তপ্ত হতে থাকে। ২৩ মার্চ ইসলামিয়া কলেজ মাঠে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে শোডাউন করে ছাত্র-মজুর-জনতা। ২৫ মার্চ কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠে ছাত্র নেতারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন গোলাম কিবরিয়া, আব্দুর রউফ চৌধুরী, নূরে আলম জিকো প্রমুখ। ওইদিন সাধারণ মানুষ ও ছাত্ররা লাঠিসোটা, তীর-ধনুক, দা ও ড্যামি রাইফেল নিয়ে সমাবেশও করে। ওই আন্দোলনে হামিদ রায়হান নিজে শুধু যুক্তই থাকেননি,বরং ক্যামেরায় ছবিও তুলে রেখেছেন।
২৫ মার্চ ১৯৭১। রাতেই সারাদেশে শুরু হয় গণহত্যা।
তখন কী করলেন হামিদ রায়হান?
তার ভাষায়, “যুদ্ধ তো তখন শুরু হয়ে গেছে। আমার খেয়াল হলো ছবিগুলোর প্রত্যেকটা নেগেটিভ রাখবো। ওগুলো অফিসেই ছিল। কারফিউ শেষ হলে নেগেটিভগুলো নিয়ে পরিবারসহ চলে যাই ভায়রার বাড়িতে, দৌলতপুরের কামালপুরে। ওটা ছিল বর্ডার এলাকা। ফলে আর্মিরা তখনও যায়নি। পরে সেখান থেকে যাই ভারতের করিমপুরে। থাকি জামশেদপুরের এক ভাড়া বাড়িতে। একদিন শুনলাম কুমারখালির এমপি গোলাম কিবরিয়া সাহেবসহ নেতৃবৃন্দরা একটা রিক্রুটিং ক্যাম্প খোলার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন সেখানে। কিবরিয়া সাহেব পূর্বপরিচিত। ফলে তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করি। মেইন দায়িত্বে ছিলেন আব্দুর রউফ চৌধুরী। করিমপুর রিক্রুটিং ক্যাম্পটি চালু হলে ধীরে ধীরে দেশ থেকে যুবকরা আসতে থাকে। অধিকাংশ দৌলতপুর, কুষ্টিয়া, মিরপুর, ভেড়ামারা, বাগমারা, কুমারখালি, খোকসা প্রভৃতি এলাকার। সেখানে থেকেই তাদের বাছাই করে ট্রেনিংয়ে পাঠানো হতো।”
ভিডিও: ১৯৭১: ক্যামেরাই ছিল যার হাতিয়ার
তখন কী ধরনের ছবি তুলতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “না, ওই সময়টায় ছবি তোলায় বেশ ভাটা পড়ে যায়। মনে তখন দেশকে মুক্ত করার চিন্তা। ২৪ ঘন্টাই ক্যাম্পে থাকতাম। যুবকদের সংগঠিত করা, তাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করাসহ মাস্টাররোল তৈরি করতে হতো প্রতিদিনই। বেলাল, গায়েক সর্দারসহ কয়েকজন ছিলেন রান্নার দায়িত্বে। প্রায় দুই হাজারের মতো যুবক ছিল ক্যাম্পে। ফলে এত লোকের খাবার আয়োজন করা খুব সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু ক্যাম্প থেকে যখন হায়ার ট্রেনিংয়ে যুবকদের পাঠানো হতো তখন খুব আনন্দ লাগতো।”
যুদ্ধ-আলোকচিত্রী হিসেবে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে হামিদ রায়হান বলেন, “ট্রেনিং থেকে ফিরে মুক্তিযোদ্ধারা তখন বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন শুরু করেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলছিল পুরোদমে। ওই সময় ক্যাম্প থেকে হায়ার ট্রেনিংয়ে লোক নেওয়াও কমে যাচ্ছিলো। তখনই মনে হলো, তাহলে ফটোগ্রাফিটাকে কাজে লাগাই।”
তখন বাংলাদেশ ভলেন্টিয়ার সার্ভিস কোর (বিভিএসসি) কাজ করছিল বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে। ওরা ভলান্টিয়ার নিয়োগ দিতো। শরণার্থী ক্যাম্পের যুবক-যুবতীদের সংগঠিত করে লেফট-রাইট করানোসহ নানা কাজে যুক্ত রাখতো ভলান্টিয়াররা, যাতে তারা বিপথগামী হয়ে না যায়। ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের উদ্যোক্তা ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। তাদের অফিস ছিল কলকাতার দশ নম্বর সদর স্টিটে। লন্ডনের ওয়ার অন ওয়ান্ট তাদের ফান্ড দিতো। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ ছিলেন ওয়ার অন ওয়ান্ট-এর চেয়ারম্যান।”
“একদিন ব্যারিস্টারকে (আমীর-উল-ইসলাম) বললাম, ‘তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। আমি ফটোগ্রাফিটা করি।’ তাদেরও প্রয়োজন ছিল ডকুমেন্টেশনের জন্য একজন লোক। ফলে তার মাধ্যমেই ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের ফটোগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ পাই। বেতন ছিল চারশ টাকা। এর পরই ক্যামেরাবন্দি করা শুরু করি যুদ্ধদিনের নানা অধ্যায় ও ঘটনাপ্রবাহ।”
বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর-এর দল যখন যে জায়গায় যেত, তাদের সঙ্গেই যেতে হতো হামিদ রায়হানকে। বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়েও ছবি তুলতেন তিনি। পাটগ্রামের মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করতে এসেছিলেন ওয়ার অন ওয়ান্ট এর চেয়ারম্যান ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ। ১৯৭১ সালের পহেলা অক্টোবর তারিখে ডোনাল্ড চেসওয়ার্থসহ পাটগ্রামের কোট-কাচারি, হাসপাতাল ও বিভিন্ন জায়গায় ছবি তোলেন হামিদ রায়হান। এছাড়া তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্প, শরণার্থী ক্যাম্প ও মুক্তাঞ্চলগুলোতে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ধ্বংস করা ব্রিজ, কালভার্ট ও ভবনের ছবিও উঠে এসেছে তার ক্যামেরায়, যা স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শিকারপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ছবি, ১১ ডিসেম্বর যশোরের পিকনিক কর্নার এলাকায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ফেলে যাওয়া তাজা রকেট বোমার পাশে দুই শিশুর ছবি, ঝিকরগাছায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিজ, ২২ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জ বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়া রাজাকারের ছবিও ক্যামেরাবন্দি করেন এ আলোকচিত্রী।
পাকিস্তান সেনারা বেওনেটের টর্চারে আহত এক মুক্তিযোদ্ধাকে বিভি এস বি হাসাপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার ছবি, ২ ডিসেম্বর মুক্ত কালিগঞ্জে (সাতক্ষীরা) পরিদর্শনে আসা এ এইচ এম কামরুজ্জামান, মেজর জলিল, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, মেজর হায়দারসহ প্রমুখের ছবি তোলেন হামিদ রায়হান। ১১ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জনসভা হয় যশোর টাউন হল ময়দানে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। রায়হানের তোলা সেদিনের ছবিতে দেখা যায় এম আর আক্তার মুকুল, উপেন তরফদার, জহির রায়হান ও যশোরের রওশনসহ অনেককে।
কুষ্টিয়াতে রাজাকারদের ধরে আনার ছবি, খুলনায় এক বদ্ধভূমিতে মানুষের হাড়গোড় ও মাথার খুলির ছবি এবং ৬ ডিসেম্বর ভারতের স্বীকৃতির দিন কলকাতায় একটা মিছিলে প্ল্যাকার্ড হাতে একটা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কবি নির্মলেন্দু গুণের ছবিও উঠে আসে তার ক্যামেরায়। এ ছবিগুলোই ইতিহাসের মূল্যবান দলিল। একাত্তরে হামিদ রায়হানের তোলা ছবিগুলো বিশ্ব গণমাধ্যমে পাঠানো হতো। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়তে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
আলাপচারিতায় যুদ্ধদিনের স্মরণীয় কয়েকটি ঘটনার কথাও তুলে ধরেন আলেকচিত্রী আব্দুল হামিদ রায়হান। তার ভাষায়- “খুব কাছ থেকে দেখেছি কীভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। অভুক্ত অবস্থায় মানুষ আসছে দেশ থেকে। তিন-চারদিন পর খাবার পেল। আবার কলেরা শুরু হয়ে গেল। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে চোখের একটা অসুখ দেখা দেয় তখন। চোখের ওই রোগ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল সব ক্যাম্পে। ফলে পশ্চিম বাংলার লোকেরা ওই রোগের নামই দেয় ‘জয় বাংলা রোগ’। এক শরণার্থী ক্যাম্পে দেখেছি মা মরে গেছে, বাচ্চা গিয়ে তার দুধ খাচ্ছে। এই ছবিটা তুলতে না পারায় খুব আফসোস হয়েছিল। হাজার হাজার লোক মরেছে ক্যাম্পে আসার আগেই, খাবারের অভাবে। খুলনার গল্লামারি বদ্ধভূমিতে মানুষের হাড়গোড় ও মাথার খুলির স্তুপ ছিল। অধিকাংশকেই বিহারী ও রাজাকাররা হত্যা করেছিল। সেখানে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম বিশ ডিসেম্বর। সঙ্গে ছিলেন মৈত্রী দেবি, দিরেশ চক্রবর্তী।”
তিনি আরো বলেন, “একাত্তরে ভারতীয় জনগণের সহযোগিতার কথা না বললেই নয়। শুধু খাওয়া নয়, থাকার জায়গা দিয়েও সহযোগিতা করেছে। কলকাতার কাছে এক শরণার্থী ক্যাম্পেই ছিল প্রায় লাখের মতো লোক। ভারতীয়রা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বাদ দিয়ে স্কুলগুলো দেয় শরণার্থীদের থাকার জন্য। ভারত যে সহযোগিতা করেছে তা না হলে প্রায় অসম্ভব ছিল না দেশ স্বাধীন করা। সাড়ে সাত কোটির ভেতর এক কোটি লোককেই তারা জায়গা দিয়েছে। ওই সময়ের শরণার্থী ক্যাম্পগুলো না দেখলে ঠিক বুঝতে পারবেন না একাত্তরের কী হয়েছিল!”
“শরণার্থী ক্যাম্প ছাড়াও ছবি তুলেছি বর্ডার এলাকার অ্যাকশন ক্যাম্পগুলোতে। আমার ক্যামেরায় তুলে আনি একাত্তরে মোট ৫৪০টির ওপর ছবি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে ২৯২টি, দৃককে ১০০টি ও সামরিক জাদুঘর ‘বিজয় কেতন’-এ দিয়েছি আরো বেশ কিছু ছবি।”
ছবি নিয়ে ভালোলাগার অনুভূতিও জানান এ আলোকচিত্রী, “একাত্তরে সাতক্ষীরার দেবহাটায় এক মুক্তিযোদ্ধার বন্দুক তাক করা একটা ছবি তুলেছিলাম। কয়েকবছর আগে দৃক গ্যালারিতে সে ছবিটি প্রদর্শিত হয়। ওরা প্রদর্শনীর প্রচারণা চালায় ওই ছবিটি দিয়েই। তা দেখে ওই মুক্তিযোদ্ধার নিকটাত্মীয় আমাকে খবর দেন। তারপর নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে একাত্তরে নিজের ছবি দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরেন ওই মুক্তিযোদ্ধা। তখনই জানি, তার নাম মোসলেহ উদ্দিন।”
“এভাবে অনেক মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত মানুষ তাদের বা তাদের স্বজনদের খুঁজে পেয়েছেন আমার তোলা ছবি থেকে। ওই ছবি সরকারের উচ্চপর্যায়ে জমা দিয়ে তারা বা তার পরিবার সম্মানিতও হয়েছেন। এটাই ভালো লাগে। ছবি তুলেছিলাম বলেই তো আজ এত ছবি আপনারা দেখতে পারছেন। একাত্তরে ক্যামেরাটাই ছিল আমার অস্ত্র।”
যুদ্ধ-আলোকচিত্রী আবদুল হামিদ রায়হানের বয়স এখন আটাশি। একাত্তরে রিক্রুটিং ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনের জন্য মুক্তিযোদ্ধার সম্মান লাভ করেছেন তিনি। কিন্তু অদ্যাবধি তাকে মুক্তিযুদ্ধ-আলোকচিত্রী হিসেবে সরকার কোনও স্বীকৃতি বা পুরস্কার দেয়নি। এ নিয়ে কোনো আফসোসও নেই তার। অকপটে বললেন, ‘কর্তব্য ছিল, করেছি। নিজের কোনো চাওয়া-পাওয়া, আফসোস বা মন খারাপ নেই। দেশটা তো স্বাধীন হয়েছে। প্রাপ্তি বড় ব্যাপার না। মানুষ দেখলে সম্মান করে এটাও কম প্রাপ্তি নয়।”
বঙ্গবন্ধু ছবি তুলতে পছন্দ করতেন। এ নিয়ে একটি ঘটনার কথা তুলে ধরেন হামিদ রায়হান।
তার ভাষায়, ‘১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন কুষ্টিয়াতে। ওঠেন সার্কিট হাউজে। রাতে ছবি তুলতে গিয়েছি। তখন তো ফ্ল্যাশ ছিল না। উনি শুয়ে আছেন। একটা ছবি তুলতেই ফিল্ম শেষ। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আরেকটা তোলো।’ আমি খুব লজ্জিত হয়ে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু সরি ফিল্ম শেষ।’ উনি মুচকি হাসলেন। তার ওই হাফ ছবিটা কিন্তু ইউনিক ছবি। ছবি তুলতে বঙ্গবন্ধু কখনো না করতেন না।”
দেশ নিয়ে খুবই আশাবাদী এই যোদ্ধা। বললেন- “স্বপ্নের দেশ আমরা ঠিকই পাইছি। আজকে মানুষতো অভুক্ত থাকছে না। হাসিনা সরকার যেভাবে খাদ্য দিচ্ছে, বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা দিচ্ছে। যাদের ঘর নেই ঘর করে দিচ্ছে। এটা তো বিশাল ব্যাপার। আরেকটা জিনিস খেয়াল করে দেখবেন, গ্রামে এখন আর কুঁড়েঘর পাবেন না। প্রতিটি বাড়িতেই স্যানিটারি ল্যাট্রিন হয়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় ভারতকেও পেছনে ফেলেছে। আর পদ্মাব্রিজ ও মেট্রোরেল চালু হলে তো যোগাযোগের আমূল পরিবর্তন ঘটবে। খুব বড় আকারে দেশ আগাচ্ছে। শুধু সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে হাসিনাকে শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে।”
কথা ওঠে প্রজন্মকে নিয়ে। তিনি বলেন, “আমার তো মনে হয় যে শিক্ষা তারা পাচ্ছে। পরিবর্তনটা যারা দেখছে। তারা তৈরি হচ্ছে ভেতর থেকে। তাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর বাঙালির যে মানসিকতা সেটাতে মৌলবাদীরা ঢুকতে পারবে না। তারা চেষ্টা করে যাবে, কিন্তু বিশ্বাস করি পারবে না। এই দেশটা একদিন পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবেই। একুশে ফেব্রুয়ারি দেখেন, স্মৃতিসৌধ দেখেন। লাখো লোক শহীদ হয়েছে- সেটা তো ফেল করার জন্য নয়।”
১৯৭৩ সালের ১৩ মার্চ কুষ্টিয়া শহরে রূপান্তর নামে একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন আলোকচিত্রী আবদুল হামিদ রায়হান। সেখান থেকে একাত্তরের ছবিগুলো সামান্য মূল্যে প্রিন্ট করা যায়। এছাড়া প্রজন্মের কাছে আলোকচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে টাঙানো রয়েছে বেশ কিছু ছবি। পরিসর ছোট হলেও রূপান্তর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার এক জীবন্ত মিউজিয়াম।
কেন এমন উদ্যোগ?
হামিদ রায়হানের ভাষায়- “ভাবলাম যদি ছবিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে স্টুডিও করতে হবে। তাই আর চাকরি করলাম না। বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর আমাকে প্রায় চার হাজার ২০০ টাকা দেয়। একাত্তরের ছবিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে ওটা দিয়েই রূপান্তর স্টুডিও দিয়েছি। নিজের কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। দেশটা জেন সঠিক পথে চলে। প্রজন্ম যেন একাত্তরের সঠিক ইতিহাসটা জানতে পারে।”
একাত্তরে হামিদ রায়হানের ছবিগুলোই আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধে অকাট্য দলিল। শেখ হাসিনা সরকার একাত্তরে অবদানের জন্য বিদেশি সাংবাদিক, আলোকচিত্রী ও ব্যক্তিত্বকে এনে সম্মাননা দিয়েছে। এটিও ভাল উদ্যোগ। কিন্তু দেশের একজন যুদ্ধ-আলোকচিত্রী হিসেবে আব্দুল হামিদ রায়হানকে কেন কোনও জাতীয় পুরস্কার বা সম্মাননা দেওয়া হলো না আমাদের জানা নেই!
মুক্তিযোদ্ধা ও আলোকচিত্রী আব্দুল হামিদ রায়হান চান তার তোলা একাত্তরের ছবিগুলোই প্রজন্মের কাছে বেঁচে থাকুক। প্রজন্মের উদ্দেশেই তিনি বলেছেন শেষ কথাগুলো- “ছবিগুলো প্রজন্ম দেখুক। ভাবুক তারা, কত কষ্টে আমার স্বাধীনতা পেয়েছি!”
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২১ মে ২০২১
© 2021, https:.