প্রয়োজন সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ
করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিশ্ব যখন তটস্থ, তখন স্বাভাবিক জীবনে ফেরার স্বপ্ন দেখছে ইসরায়েল। গত সপ্তাহে ৫২ লাখ রোগী শনাক্তের রেকর্ড হয়েছে গোটা বিশ্বে। অথচ ইসরায়েলে এখন দিনে ১০০ এরও কম রোগী শনাক্ত হচ্ছে। ফলে ইসরায়েলে দৈনন্দিন জীবনযাপন এখন প্রায় স্বাভাবিক। স্কুলগুলো পুরোদমে চলছে। অর্থনীতি সচল করার কেন্দ্রগুলো খুলেছে। রেস্তোরাঁগুলোতে ভিড় এতটাই যে অনেক রেস্তোরাঁয় জায়গা পাওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে সেখানে বিধিনিষেধের কিছু বেড়াজাল এখনো রয়েছে। বদ্ধ ঘরে কোনো অনুষ্ঠানে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। যে কোনো অনুষ্ঠানে অতিথির সংখ্যা এখনো সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হলে টিকার সনদ অথবা গ্রিন পাস দেখাতে হয়। কারও কখনো সংক্রমণ ঘটার প্রমাণই গ্রিন পাস। যা দেখালে বোঝা যাবে তার দেহে অ্যান্টিবডি আছে।
কীভাবে ইসরায়েল এমন স্বাভাবিক জীবনে ফিরল?
শুরুতেই বাইরে থেকে কারও ইসরায়েলে ঢোকা মানা ছিল। সেটি এখনো কঠোরভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে। ঘর থেকে বাইরে বেরুলে সবার মুখই মাস্কে ঢাকা থাকে। এছাড়া ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী দাবি করছেন, টিকাদানের মধ্য দিয়েই তারা পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। সেদেশে টিকা নেওয়ার যোগ্য নাগরিকদের চার ভাগের তিন ভাগই অন্তত প্রথম ডোজ নিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, ইসরায়েল এই পর্যন্ত তার দেশের ৫৭ শতাংশ নাগরিককে টিকার দুটি ডোজই দিতে পেরেছে। ফলে টিকাই তাদের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার ক্ষেত্রে এগিয়ে নিচ্ছে বলে মনে করেন দেশটির কভিড-১৯ বিশেষজ্ঞরা। হার্ড ইমিউনিটি তৈরির মাধ্যমে প্রতিরোধের যে উচ্চ পর্যায়ে তারা পৌঁছেছে তাতে নতুন করে পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম, টিকা কার্যকর হবে না, করোনাভাইরাসের এমন ভ্যারিয়েন্ট যদি ইসরায়েলে না ঢোকে। সেদিকেও তারা সর্তক রয়েছে। ফলে কভিড মহামারী পেরিয়ে জীবন কেমন হতে পারে, তা বিশ্বে তারাই প্রথম স্বাদ নিচ্ছে।
ইসরায়েলের নেওয়া পদক্ষেপগুলো আমরা কতটা অনুসরণ করতে পেরেছি? প্রথমত এবারও আমরা সঠিক সময়ে বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। কঠোরভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীদের হোম কোয়ারেন্টাইনও নিশ্চিত করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে এখনো চাইলে সরকার সেনাবাহিনীকে কাজে লাগাতে পারে।
করোনার সংক্রমণের বিস্তার রোধে কঠোর লকডাউন (সরকারি ভাষায় কঠোর বিধিনিষেধ) চলছে। কঠোর বিধিনিষেধের ভেতরও মুভমেন্ট পাসের নামে আড়াই লাখের ওপরে মানুষকে মুভ করতে পাস দেওয়া হয়েছে। ফলে সরকারি বিধিনিষেধের ভেতরই শত শত গাড়ি চলতে দেখা গেছে রাস্তায়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকার পরেও পুলিশ বাহিনী এমন পাস দেওয়ার আইনত অধিকার রাখে কি না সে বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। এ বিষয়ে সরকারের বক্তব্যও স্পষ্ট করা উচিত ছিল বলে মনে করেন অনেকেই।
সরকার ঘরের বাইরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করলেও এ নিয়ে মানুষের ব্যক্তিগত সচেতনতাবোধ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। প্রত্যেক পরিবারকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে। কেননা বর্তমানে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু মানুষের ভেতর সচেতনতাবোধ শতভাগ তৈরি না হলে মার্কেট-বাজার ও জনসমাগমস্থল থেকে সংক্রমণ বাড়বেই।
ঢাকার বাজারগুলোতে এখনো মাস্ক ছাড়া কেনাবেচা করতে দেখা যায় বহু মানুষকে। তরুণ ও যুবক বয়সী অনেকেই মনে করেন মাস্ক না পরলেও তার কিছু হবে না। আবার নিম্ন আয়ের মানুষের ভাষ্য, করোনাভাইরাস বড়লোকদের রোগ! ফলে তারা আক্রান্তই হবেন না। সারা দেশের পেশাজীবী বহু মানুষ গরমের অজুহাতে মাস্ক পরেন না। তাদের মাস্ক থাকে পকেটে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখানোর প্রয়োজনে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মাস্ক পরলে ‘জীবাণু বহনকারী ড্রপলেট’ থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব। তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণ থামাতে পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরা উচিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ফেইস মাস্ক পরলে শরীরের ভেতর অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ করোনাভাইরাস ঢুকতে পারে। সে ক্ষেত্রে হয়তো তার উপসর্গ হবে খুবই মৃদু বা আদৌ কোনো উপসর্গ দেখা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একজন মানুষের সংক্রমণ কতটা গুরুতর তা জানার ক্ষেত্রে তার দেহে কী পরিমাণ ভাইরাস ঢুকেছে তা গুরুত্বপূর্ণ। তাই মাস্ক পরলে তা যে শুধু অন্যদেরই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে, তা শুধু নয়, যিনি মাস্ক পরছেন তিনিও সুরক্ষিত থাকেন। তাই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক পরার কোনো বিকল্প নেই।
তাই বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে বড় অংকের জরিমানা ও জেল দিয়ে হলেও এটি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে জনগণকেও সচেতন হতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিতে হবে।
করোনা সংক্রমণে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কমলেই আমাদের ভেতর এক ধরনের আত্মতুষ্টি ও উদাসীনতা দেখা দেয়। ফলে আমরা করোনার পরবর্তী ঢেউ মোকাবিলার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবি না। অথচ বর্তমান পরিস্থিতি খুব জটিল। নভেল করোনাভাইরাস আক্রমণের ধারাও পাল্টাচ্ছে। তাই এর থেকে খুব সহজে বের হওয়ার সুনির্দিষ্ট পথ নেই। এখন চলমান দ্বিতীয় ঢেউয়ে যে অবস্থা, তৃতীয় ঢেউ এলে ভয়াবহতা আরও বাড়বে। এরই মধ্যে কোনো কোনো দেশে চলছে চার নম্বর ঢেউ।
কীভাবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে?
এ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন এলাকাবাসী যদি এ বিষয়ে সতর্ক ও সংগঠিত না হয় তাহলে শুধু প্রশাসনিক আদেশ দিয়ে খুব বেশি কিছু হবে না। জনগণ, সরকার এবং প্রশাসনকে নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। যেখানে জনগণের কাজ হবে, শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পরা, সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করা এবং করোনার ভ্যাকসিন নেওয়া। প্রশাসনের কাজ হবে যারা স্বাস্থ্যবিধি মানবে না, তাদের মানতে বাধ্য করার জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া। তবে এই প্রক্রিয়ায় পাড়া বা মহল্লার গণ্যমান্য ব্যক্তি যেমন শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, ছাত্র ও পেশাজীবীদের নিয়ে কমিটি তৈরি করা যেতে পারে। যাদের কাজ জনগণকে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে বোঝানো ও সতর্ক করা। জনগণকে এ কাজে সম্পৃক্ত করতে পারলেই করোনার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব।
নিজের সুরক্ষা নিজের হাতে। আবার নিজেকেই শুধু সুরক্ষিত রাখলে হবে না, পরিবার-প্রতিবেশীদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে। কেননা একজন অরক্ষিত থাকলে বাকিরাও তার মাধ্যমে করোনায় আক্রান্ত হতে পারে। তাই করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে প্রয়োজন সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগের। আর সেটি শুরু করতে হবে এখনই।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৮ এপ্রিল ২০২১
© 2021, https:.