কারমা উৎসব ও বনভূমির বিপন্নতা
মানুষের কাছে গাছের গুরুত্ব কতটুকু? সেটি জানাতেই কড়াদের একটি উৎসবের কথা তুলে ধরছি। কড়াসহ সমতলের বেশ কয়েকটি জাতির বড় উৎসবের নাম কারমা বা কারাম। উৎসবে এরা বিরল প্রজাতির ‘খিল কদম’ গাছের ডাল কেটে এনে বিশেষ আচারের সঙ্গে পূজা করে। এ বৃক্ষটি তাদের কাছে অতি পবিত্র। দিনাজপুরের ঝিনাইকুড়ি গ্রামে পরপর তিন বছর কড়াদের কারমা উৎসব দেখেছি খুব কাছ থেকে, তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে।
ভাদ্র মাসের চাঁদের পূর্ণিমায় ‘কারমা’ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এ উৎসবে মাহাতো বা গ্রামপ্রধান আগে থেকেই অবিবাহিত কোনো যুবককে খিল কদমের ডাল কেটে আনা ও তা বিসর্জনের জন্য মনোনীত করে দেন। কড়ারা দিনাজপুরের ধর্মপুর শালবনের গহিনের ‘খিল কদম’ গাছ থেকে ডাল সংগ্রহ করে। এ গাছের ডাল কেটে আনার জন্য রয়েছে বিশেষ নিয়ম। সাধারণত বিকেলের দিকে ডাল কাটতে বের হয় এরা। ফিরে আসে সন্ধ্যার পরপরই।
ডালসহ গ্রামের কাছাকাছি আসতেই ঢোল বাজিয়ে বিশেষ ভক্তি দিয়ে দেবতারূপী গাছের ডালটিকে কড়ারা নিয়ে আসে পূজাস্থলে। সেখানে আগে থেকেই বাঁশ দিয়ে মাড়োয়া তৈরি করে রাখা হয়। শাপলা ফুল দিয়ে সাজানো হয় মাড়োয়াটিকে।
সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। প্রতিটি বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে আঙিনা পরিপাটি করে সাজানো হয়। সবার ঘরেই এ সময় তেলের পিঠা ভাজার শোঁ শোঁ শব্দ পাওয়া যায়।
কারমা উৎসবে কড়ারা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সবাইকে দাওয়াত করে। বলি পর্বের পরেই শুরু হয় পৌরাণিক কাহিনী বলার আসর। এ পর্বে খিল কদম বা কারাম ডালটিকে ঘিরে বসে নারীরা। সেজেগুজে ঘোমটা টেনে বসে তারা। সামনে কাঁসার পেয়ালায় রাখা হয় প্রদীপ, তেলের পিঠা, ছোলা, দূর্বাঘাস ও জুঁইফুল। গোত্রপ্রধান মাঝেমাঝে উচ্চৈঃস্বরে বলেন ‘ফুল ফেকিয়ে।’ ঠিক তখনই সবাই একমুঠো জুঁইফুল বা ঘাস ছুড়ে দেয় ডালটির দিকে। কাহিনী শেষে মনের নানা ইচ্ছা নিয়ে সবাই তাদের বানানো তেলের পিঠা বেঁধে দেয় কারমা ডালটির সঙ্গে। কারমা উৎসবে এরা অভাবমুক্তির মিনতি জানায় গাছরূপী দেবতার কাছে।
কিন্তু কবে থেকে কড়ারা এ উৎসবটি পালন করছে? সেটি নিয়ে রয়েছে একটি পৌরাণিক কাহিনী। কাহিনীটির ভাবার্থ: ‘কারাম আর ধারাম দুই ভাই। কারাম বড়। ধারাম ছোট। পারাবেতী তাদের একমাত্র বোন। ভাদ্র মাসে একবার গ্রামের এক ধনী ব্যক্তি ঢোল পিটিয়ে তার জমিতে হাউলি’র (ধান গাড়ার) ডাক দেয়। অন্যদের সঙ্গে কারাম-ধারামও যায় সেখানে। কাজ শুরু হয় খুব ভোরে। কিছু চারা লাগানোর পরেই সকালের নাস্তা বা পান্তার ডাক পড়ে। দু’ভাই তখন কলাপাতা বিছিয়ে বসে যায় লাইনে। কিন্তু তাদের কাছে এসেই তা শেষ হয়ে যায়। পান্তা না পেয়ে বড়ই দুঃখ পায় তারা। নিজেকে সামলে নিয়ে দুপুরে খাবারের আশায় তারা আবার কাজে ফিরে। কিন্তু এবারও ঘটে একই ঘটনা। তাদের কাছাকাছি এসেই খাবার শেষ! ব্যথিত হয় দুই ভাই-ই। রাগে-কষ্টে তারা তাদের হাতে লাগানো রোয়া তুলে ফেলতে রওনা দেয়।
পথেই ছিল একটি বটগাছ। দুঃখের কারণ জানতে চাইলে দুই ভাই বটগাছকে সব খুলে বলে। সব শুনে বটগাছ বলে ‘তোদের কারমা কপাল জেড় গেলে’ (তোদের কর্মভাগ্য পুড়ে গেছে)। সাত সমুদ্র লংকা পার হয়ে আনতে হবে কর্মভাগ্যকে।’ বটগাছের কথায় কারাম-ধারাম রওনা হয় কর্মভাগ্য ফিরিয়ে আনতে। পথেই তাদের সঙ্গে দেখা একটি কুল গাছের। কারাম-ধারাম এর কথা শুনে সেও জানায় তার দুঃখের কথাটি। তার ফল পেকে মাটিতে পড়ে থাকে কিন্তু কেউ সে ফল খায় না। তার ভাগ্যটিও জেনে আসতে দুই ভাইকে সে অনুরোধ করে। যেতে যেতেই কারাম-ধারামের দেখা হয় একটি ডুমুর গাছের সঙ্গে। তাদের লংকা পার হওয়ার কথা শুনে সে আফসোস করে বলে ‘আমার এমন সুদৃশ্য ফল পেকে থাকে কিন্তু মানুষ ও পাখি সেদিকে ফিরেও তাকায় না।’ তাদের সে অনুরোধ করে তার ভাগ্যটিও জেনে আসার। কিছুদূর যেতেই কারাম আর ধারামের সামনে পড়ে একটি নদী। নদীর তীরে দুটি হাতি নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল। তাদের পুরো শরীর কাদায় ঢাকা। কারাম-ধারামের কথা শুনে তারা দুঃখ করে বলে, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আর কত কাল কাদায় ঢাকা থাকব? আমাদের কি কেউ গোসল করিয়ে পরিষ্কার করে রাখবে না?’ তোমরা আমাদের ভাগ্যটিও জেনে এসো।
নদী পার হয়ে কিছুদূর যেতেই পড়ে লংকা সমুদ্র। কিন্তু বিশাল এ সমুদ্র কারাম-ধারাম কীভাবে পার হবে?
সমুদ্রে ছিল বড় একটি কুমির। সাতদিন আগে তার গলায় বিঁধেছে আইড় মাছের কাঁটা। যন্ত্রণায় তার ঘুম হারাম। সে কারাম-ধারামের সাহায্য চাইল। সমুদ্র পার করা ও নিয়ে আসার শর্তে দুই ভাই কুমিরের গলার কাঁটা বের করে দিল। অতঃপর কুমিরের পিঠে চড়ে লংকা সমুদ্র পার হতেই তারা দেখা পায় তাদের কর্মভাগ্যের। সারা শরীর তার পোকায় খাচ্ছিল। কারাম-ধারাম স্পর্শ করতেই সেটি গাছ হয়ে গেল। দুই ভাইয়ের মনে তখন অন্যরকম শক্তির সঞ্চার হলো। তারা সেই গাছ ঘাড়ে নিয়ে আবার বাড়ির দিকে রওনা দিল।
ফেরার পথে হাতি দুটো তাদের ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে, কারাম-ধারাম বলে এমন একজন লাগবে যে তোমাদের শরীর পরিষ্কার করে দেবে। হাতি দুটি মিনতি করে তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। দুই ভাই তখন দুই হাতির পিঠে চড়ে বসে। এরপর ডুমুর গাছ তার ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে, তারা বলে তোমার গোড়ার মাটির নিচে সাত কলসি ধন আছে। সেটি সরালেই তোমার ফল সবাই খাবে। ডুমুর গাছ কারাম-ধারামকে তা তুলে নেওয়ার অনুরোধ করে। তারা তখন সাত কলস ধন হাতির পিঠে তুলে নেয়। কুলগাছের সঙ্গে দেখা হতেই কারাম-ধারাম তাকেও একই কথা বলে। সেও মাটির নিচের সাত কলস ধন তুলে নেওয়ার মিনতি করে।
এভাবে দুই ভাই কর্মভাগ্য নিয়ে আসে ওই বটগাছটির কাছে। বটগাছ কর্মভাগ্যরূপী ওই গাছটিকে মাটিতে গেড়ে তাদের বোন পারাবেতীকে দিয়ে পূজা করার নির্দেশ দেয়। তারা তাই করে। কড়াদের বিশ্বাস সে সময় থেকেই পৃথিবীতে কারমা উৎসবের আয়োজন হয়ে আসছে। আর তাদের কাছে গাছ ও বনভূমি ধ্বংস করা পাপের সমতুল্য।
এ দেশে বসবাসরত নৃগোষ্ঠীর মানুষ ও সচেতন সমাজ মনে করে উন্নয়নের নামে ক্রমেই আমরা বন ও গাছ ধ্বংস করছি। ফলে পাহাড় ও সমতলে বনের আলিঙ্গনে বেড়ে ওঠা প্রকৃতজনদের জীবন আজ বিপন্ন প্রায়। মধুপুরের যে বনাঞ্চল মান্দিদের কাছে তা আবিমা বা মায়ের মাটি। সেটিও আজ বিপন্নের পথে। গাছ কেটে ও স্থাপনা গড়ে ধ্বংস করা হচ্ছে বনাঞ্চল। দখল হচ্ছে মান্দিদের মায়ের মাটিও। এটি এখনই বন্ধ করা না হলে কারমা ও ধারমার মতোই আমাদের কর্মভাগ্য রহিত হবে এমনটাই বিশ্বাস প্রকৃতজনদের। আমরা কি সেই পথেই চলব?
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৩ জুন ২০২১
© 2021, https:.