আদিবাসী

সাঁওতাল উৎসব ‘সোহরাই’

বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সাঁওতালরা দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি। এরা নিজেদের ‘সানতাল’ বলতেই অধিক পছন্দ করে।

একে অপরকে এরা ডাকে ‘হর’ বলে। হর অর্থ মানুষ। এ আদিবাসীদের আদি নিবাস ভারতের ছোট নাগপুরের এবং আসামের পাহাড় ও বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এদেশে এদের বসবাস উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার রাজশাহী, নাটোর, নওগা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা প্রভৃতি এলাকায়।

সাঁওতালদের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম সোহরাই বা সহরায়। শাহার শব্দ থেকে এসেছে সোহরাই বা সহরায় শব্দটি। যার অর্থ বৃদ্ধি হওয়া। এ উৎসবে মূলত ধনসম্পত্তি ও গরু-বাছুর বৃদ্ধির জন্য বিশেষ আচারের মাধ্যমে বোঙ্গাদের (দেবতা) নিকট আবেদন জানানো হয়। প্রতি পৌষে সাঁওতাল গ্রামগুলোতে ধুমধামের সঙ্গে আয়োজন চলে উৎসবটির।

এ উপলক্ষে বিবাহিতা নারীরা বাবার বাড়ি আসার সুযোগ পায়। তাই সারাবছর তারা প্রতীক্ষায় থাকে উৎসবটির জন্য। এসময় তারা গান গায়:

বাহারেদ সহরায় রেদ

নেওতাঞ মেসে মারাং দাদা

ইঞদ দাদা একা বুহিন গে

বৗঞ খজা সনের সাংখা

বৗঞ খজা লুমাং শাড়ি

গেল মকা সাসাং গাবাও শাড়ীঞ বাঁদিয়া।

ভাবার্থ: বাহা সহরায় পরবে আমায়/ নিমন্ত্রণ কর দাদা/ আমি দাদা একা বোনরে/ চাই না আমার সোনার চুড়ি/ চাই না আমার রেশম শাড়ি/ হলুদ মাখানো দশ হাত শাড়িই/ আমার পক্ষে যথেষ্ট।

সোহরাই উৎসবের কোন নির্ধারিত দিন নেই। পৌষ মাসে গোত্রের সবাই মহতের (গোত্র প্রধান) উপস্থিতিতে নির্ধারণ করে উৎসবের দিনটি। সোহরাই উৎসবে মহতকে আগের দিন উপোস থাকতে হয়। তিনি উপোস ভাঙ্গেন উৎসবের দিনে। সাতদিন ধরে চলে উৎসবটি।

প্রথম দিনের আনুষ্ঠানিকতাকে সাঁওতালদের ভাষায় বলে ‘উম’। ওইদিন গ্রামের পুরুষেরা জমায়েত হয় একটি মাঠের মধ্যে। সেখানে একটি জায়গায় আতপ চাউল দিয়ে ঘেরাও বা বাউন্ডারি তৈরি করা হয়। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে রাখা হয় সিঁদুর ও পাতার ঠোঙ্গায় সামান্য হাড়িয়া বা চুয়ানি। হাড়িয়া ও চুয়ানি তাদের প্রিয় পানীয়।

অতঃপর মহত সেখানে মুরগি বলি দেন জাহের এরা, মারাঙ্গবুরু, মড়ৈকো, তুরুই কো, গোসাই এরা, পারগানা বোঙ্গা ও অন্যান্য বোঙ্গার উদ্দেশ্যে। প্রতিঘর থেকে দেওয়া হয় মুরগিগুলো। বলির পরে মাঠ থেকে সবাই নেচে গেয়ে চলে আসে মহতের বাড়িতে। সেখানে মুরগি দিয়ে রান্না করা হয় খিচুড়ি। খাওয়া চলে হাড়িয়া আর চুয়ানি। মূলত মহতের বাড়িতে রান্নার মধ্য দিয়েই সাঁওতালদের সোহরাই উৎসবের শুভ সূচনা ঘটে।

সোহরাইয়ের দ্বিতীয় দিনকে বলে ‘ডাকা’। ওইদিন প্রত্যেক পরিবার তাদের নিকট আত্মীয় ও মেয়ের জামাইকে দাওয়াত করে। ফলে সবার বাড়িতে থাকে ভালো ভালো খাবার। উৎসবের তৃতীয় দিনটি চলে হাস্যরস আর আনন্দের মাঝে। এ দিনটিকে বলে ‘খুনটাও’। ওইদিন একটি বাড়ির উঠানে গোল দাগ দিয়ে দাগের ভেতরে খুঁটিতে বেঁধে দেওয়া হয় একটি ষাঁড় গরু। ষাঁড়ের শিং আর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তেলের পিঠা বা পাকওয়াল।

অতঃপর প্রচণ্ড শব্দে মাদল বা ঢোল বাজানো হয়। মাদলের শব্দে ছটফট করতে থাকে ষাঁড়টি। এরকম অবস্থাতেই দাগের বাইরে থেকে আদিবাসী যুবকেরা হুড়োহুড়ি করে ষাঁড়ের শিং ও গলা থেকে তেলের পিঠা নেওয়ার চেষ্টা করে। এভাবে তেলের পিঠা ছিনিয়ে নেওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে গোটা গ্রাম। আনন্দের সঙ্গে এরা নাচে আর গান গায়:

হাটিঞে দাঁড়ান মানাঞ মেরে

পাতাঞ দাঁড়ান মানাঞ মেঃ

সহরায়ওে কুল হি দাঁড়ান আলাম মানাঞা।

ভাবার্থ: হাটে যেতে মানা করো। মেলা দেখতে বাধা দিও। কিন্তু সহরায়ের নাচ-গান করতে মানা করো না।

উৎসবের চতুর্থ দিনে মাছ বা কাকড়া ধরতে সাঁওতালরা দলবেঁধে জাল আর পলো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এটিকে এরা বলে ‘হাকু কাটকোম’। পঞ্চম দিনে পূর্বের চারদিনের ভুলক্রুটি সংশোধন ও পরের দিনগুলোর পরিকল্পনা করা হয়। এটিকে সাঁওতালরা ‘ঝালি’ বলে।

সোহরাই উৎসবের ষষ্ঠ দিনটি মূলত শিকারকেন্দ্রিক। সাঁওতালদের ভাষায় এটি ‘সেন্দ্ররা’। ওইদিন সকালে একদল সাঁওতাল তীর ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিকারে। আর গোত্রের অন্যরা মহতসহ গ্রাম পরিষদের পাঁচ সদস্যের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ-গান ও বিভিন্ন খেলা দেখিয়ে চাল তুলে তা জমা রাখে মহতের বাড়িতে। দিনশেষে শিকার থেকে ফেরা শিকারীদের নিয়ে চলে নানা প্রতিযোগিতা।

কী সেটি? মাঠে একটি কলাগাছ দাঁড় করিয়ে তার ওপর রাখা হয় মহতের স্ত্রীর হাতের তৈরি তিনটি তেলের পিঠা। দূর থেকে তীর ধনুক দিয়ে যে কলাগাছ লাগাতে পারে সেই হয় বিজয়ী। বিজয়ীকে আবার পালন করতে হয় বেশকিছু নিয়ম। ৫টি ধনুক মাটিতে লম্বালম্বি সাজিয়ে বিজয়ীকে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে এর চারদিক ঘুরে মাটিতে থাকা ধনুক একটি একটি করে তুলতে হয় এবং একই নিয়মে আবার মাটিতে সাজাতে হয়। অতঃপর কলাগাছটি গোত্র পরিষদের ৫ সদস্যের জন্য ৫ টুকরো করে বিজয়ী কাঁধে তুলে নেয়।

ওই অবস্থায় বিজয়ীকে সবাই কাঁধে তুলে হৈ-হুল্লড় করে নিয়ে আসে মহতের বাড়িতে। এসময় এখানে সকলকে আপ্যায়ন করা হয় মুড়ি আর হাড়িয়া দিয়ে। আর শিকারগুলো দিয়ে চলে খিচুড়ি রান্না। খিচুড়ি আর হাড়িয়ায় ভাসতে থাকে গোটা গ্রাম। সোহরাইয়ের সপ্তম দিনটিতে প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভালমন্দ খাবার খায়। এভাবে নানা আয়োজন আর ধুমধামের সঙ্গে শেষ হয় সাঁওতালদের সোহরাই উৎসব।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ২৩জুন ২০২১

© 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button