ভুনজারদের মনসা বিশ্বাস
বাঙালি ছাড়াও এদেশে বসবাস করছে নানা জাতির মানুষ, যারা আদিবাসী নামে অধিক পরিচিত। ভুনজার তেমনই একটি আদিবাসী জাতির নাম।এ আদিবাসী জাতিটি নিজস্ব ধারার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লালন করে গড়ে তুলেছে বৈচিত্র্যময় জীবন প্রণালী। ইংরেজ আমলে এ অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বসেছে রেললাইন। পাহাড় কেটে, মাটি খুঁড়ে সেই রেললাইন বসানোর কাজে ঘাম ঝরিয়েছে ভুনজারসহ অন্যান্য আদিবাসীরা। মূলত রেললাইনের কাজের সূত্র ধরেই ভারতের ঝাড়খন্ড থেকে এদের আগমন ঘটে।
দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার বহবলদিঘী ও পিপল্লা গ্রামে ভুনজারদের বসবাস। এছাড়া রাজশাহী ও নাটোরেও কিছু সংখ্যক ভুনজার রয়েছে। এ আদিবাসীদের কাছে সাপ প্রজনন শক্তির প্রতীক। আদিম সমাজে মানুষ বৃদ্ধির জন্যই সাপ পূজা করা হতো। সাঁওতাল, ওরাও, ভুনজারদের কাছে সাপ হলো মনসা, বিষহরি বা জিন্দাদেবতা।
দিনাজপুরের বহবলদীঘির ভুনজার আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে মনসার আর্বিভাবের একটি গল্প বা কাহিনি। গোত্রপ্রধান বা মহত লবানু সিংয়ের মুখে শোনা ওই কাহিনিটি অনেকটা এরকম-
অনেক কাল আগের কথা। সওদাগর বাড়ির ছোট বউ ছিল অন্তঃসত্ত্বা। একবার সে স্নান করতে যায় পুকুরপাড়ে। সেখানে অনেকগুলো ছোট ছোট মাছ মনের আনন্দে খেলা করছিল। তা দেখে ছোট বউ আনন্দিত হয়। এরপর একটা গামছা ছাঁকা দিয়ে মাছগুলো ধরে ফেলে। ওই মাছ নিয়েই সে বাড়ি ফিরে আসে।
বাড়িতে এসে একটা মাটির হাড়িতে মাছগুলো জিইয়ে রাখে ছোট বউ। দিন কেটে রাত আসে। রাত কেটে সকাল হয়। ঘুম থেকে উঠে মাছগুলোকে কুটতে যায় সে। হাড়ি খুলে ভেতরে তাকাতেই তার চোখ কপালে ওঠে। একি! মাছ কোথায়। মাছগুলো সব সাপ হয়ে গেছে। ছোট ছোট সাপ দেখে ছোট বউ তো অবাক!
সাপগুলোকে সে মারল না। কেন যেন তার মায়া হলো। অবহেলাও করল না। বরং কাউকে কিছু না জানিয়ে সে সাপগুলোকে দুধ-কলা দিয়ে পুষতে থাকল।
ছোট বউয়ের আদরে সাপেরা খুশি হয়। তারা তাদের মা মনসার কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলে এবং আবদার করে ছোট বউকে যেন তাদের দেশে নিয়ে আসে। মনসা বাচ্চাদের কথা ফেলতে পারলেন না।
একদিন তিনি ছোট বউয়ের মাসি সেজে সওদাগরের বাড়িতে গেলেন। বাড়িতে ঢুকতেই সাওদাগরের গিন্নি বললেন, ‘কে গো তুমি?’। শাঁখা, সিঁদুর, চুপড়ী, নোয়া, নথাদিপরা মাসি রূপিনী মনসাদেবী বললেন, ‘বেয়ান ঠাকুরুন, আমাকে চিনবেন না, আমি আপনার ছোট বউয়ের মাসি। বোনঝিকে যত্ন-আত্তি করতে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।
অনুমতি পেয়ে মাসি বোনঝিকে রথে চড়ালেন এবং চোখ বন্ধ রাখতে বললেন। ছোট বউ তাই করল। এক সময় সে চোখ খুলে স্থির হয়ে গেল। মস্তবড় এক বাড়ি আর চমৎকার সব আসবাব। সে বাড়িতে খেলা করছে ওই সাপগুলো, যেগুলোকে সে দুধ-কলা খাইয়েছিল।
তাদের সঙ্গে ছোট বউয়ের কয়েকটা দিন ভালোভাবেই কেটে গেল। একদিন কোন এক কারণে সাপেরা রেগে গেল তার ওপর। তারা তাকে কামড়াবার জন্য ধাওয়া করলো। সে সময় মনসাদেবী এসে ছোট বউকে বাঁচালো। তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় মনসা বলল, ‘আমি তোর মাসি নই। আমি মনসা। থাকি ফনীমনসা গাছে। তুই পৃথিবীতে গিয়ে আমার পূজার কথা বলবি। শ্রাবণ মাসের পুরো সময়টা আমার মঙ্গল কাহিনি গাইবি, পূজা দিবি। তাহলে আর সাপের ভয় থাকবে না। সন্তানের জন্যও কষ্ট পেতে হবে না। কেউ কখনও বন্ধ্যা হবে না। এই ব্রত যে করবে সে পরম সুখে থাকবে।
মনসার কথায় ছোট বউ খুশি হয়। ফিরে এসে সে পুরো কাহিনি সবাইকে খুলে বলে এবং নিজেই প্রথম মনসা পূজা শুরু করে। মনসার আর্শিবাদে যথাসময়ে তার সুন্দর একটি পুত্রসন্তান হয়। ফলে সন্তান নিয়ে পরম সুখে দিন কাটে তার। ভুনজাররা বিশ্বাস করে কালক্রমে এভাবেই সারা পৃথিবীব্যাপী মনসার পূজা ও ব্রত অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
কোলাজে ব্যবহৃত অলঙ্করণ: সমর মজুমদার
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৪ জুলাই ২০২১
© 2021, https:.