নারীবান্ধব রাষ্ট্র কত দূরে
“সাল ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। একবার নির্দেশ আসে সিলেটের বড়লেখায় সাতমা ছড়া ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার। রেকি করা হলো। ছোট্ট দুটি নদী পার হয়ে যেতে হবে ওখানে। গাইড জানাল দুই নদীর ঘাটেই নৌকা রাখা থাকবে। আমরা চৌদ্দজন। ক্যাম্প থেকে মুভ করি রাতে। প্রথম নদীটির পাড়ে এসে নৌকা পেলাম। কিন্তু দ্বিতীয় নদীর কাছে কোনো নৌকা ছিল না। রাত তখন দুটো। নৌকার খোঁজে সহযোদ্ধারা আশপাশে ছোটে। কিন্তু না, কোনো নৌকা নেই। কী করব ভাবছি। হঠাৎ আমাদের পেছনে একটা ঝোপে কি যেন নড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক তাক করি।
কে ওখানে?
কাঁপতে কাঁপতে একটা মেয়ে বেরিয়ে আসে। বয়স তার পনেরো বা ষোলো। পরনে শাড়ি। সিলেটি ভাষায় বলে‘মুক্তি নি? আমি জানতাম আপনারা আইবা’। সে জানাল গ্রামে মুক্তিবাহিনী আসছেএমন খবর পেলে পাকিস্তানি আর্মি এসে গোটা গ্রামটা জ্বালিয়ে দেবে। সেই ভয়েই গ্রামবাসী ঘাটের সব নৌকা ডুবিয়ে রেখেছে। ‘আও আমার লগে আও’ বলেই মেয়েটা নদীর এক পাশে ডোবানো নৌকাগুলো দেখিয়ে তুলে নিতে বলে।
নিজেই খুঁজে আনে লগি। সহযোদ্ধারা পানি সেচে নৌকা দুটি নদীতে ভাসায়। মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়েই ওপারে যাই। একটি নৌকা ঘাটে রাখি। আরেকটি নৌকা নিয়ে সে নদীর জলের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ব্রিজটা উড়িয়ে ভোরের দিকে আমরা ক্যাম্পে ফিরি। গ্রামবাসীর চোখ এড়িয়ে, জীবনের ঝুঁকি জেনেও ওই রাতে মেয়েটি এসেছিল শুধুই মুক্তিযোদ্ধাদের পার করিয়ে দিতে। এর চেয়ে বড় যুদ্ধ আর কি হতে পারে! তার নামটা জানা হয়নি, ধন্যবাদ পর্যন্ত দিতে পারিনি। সহযোদ্ধাদের কাছে মেয়েটি ছিল পরী বা ফেরেশতা। কিন্তু আমার কাছে সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু ওই মেয়েটি কি এখনো বেঁচে আছে? নাকি সে ধরা পড়ে গিয়েছিল? বেঁচে থাকলে ওর কি বিয়ে হয়েছে? তার ছেলেমেয়েরা কি জানে তার মা একজন ফ্রিডম ফাইটার?”
মেয়েটিকে নিয়ে এমন হাজারো প্রশ্ন আজও ঘুরপাক খায় মনের অতলে। একাত্তরে এমন নারীরা পাশে ছিল বলেই মাত্র ৯ মাসে আমরা স্বাধীনতা পেরেছি। বুকের ভেতর দাগ কেটে থাকা যুদ্ধদিনের ঘটনাটি এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আহম্মদ বাবু।
ইতিহাস তুলে আনার কাজ করতে গিয়ে একাত্তরে নারীদের বীরত্বের এমন অসংখ্য অজানা ঘটনার কথা শুনেছি মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে। একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়াসহ রাতভর রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়ে, শুকনো খাবার দিয়ে তাদের পালানোর পথ দেখিয়ে দিতেন মা-বোনরা। তখন সবাই যুদ্ধে চলে গেছে। কিন্তু মায়েরা, বোনেরা এই অবরুদ্ধ বাংলায় চরম নিরাশ্রয় অবস্থায় ছিলেন। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির হায়েনাদের কাছ থেকে নিজেদের ও শিশুদের বাঁচানোটাই ছিল তখন আরেকটা যুদ্ধ। সেই যুদ্ধটিই নিঃশব্দে করেছেন বাংলার মায়েরা-বোনেরা-মেয়েরা। দেশের জন্য তারা অত্যাচারিত হয়েছেন, ধর্ষিত হয়েছেন। তারা একেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীন করা বাংলাদেশে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। চলছে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীও। এ বাঙালি জাতির জন্য অপার আনন্দের। কিন্তু এ সময়েই আমাদের সবচেয়ে গর্বের ঘটনা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অসম্মান দেখাল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর গার্ড অব অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী ইউএনওর বিকল্প চেয়ে প্রস্তাব করেছে কমিটি, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের ২৮-এর (১) ও (২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে ‘সরকারি নিয়োগ লাভে সমতা’ শিরোনামে (২) ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী পুরুষভেদে… কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হবে না, কিংবা সে ক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।
গার্ড অব অনার কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। এটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জাতির বীর সন্তানদের শেষ যাত্রায় সম্মান জানানোর রাষ্ট্রীয় আয়োজন। যেখানে নিয়মমাফিক উপজেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। নারীদের জানাজায় অংশ নেওয়ার বিষয়ে ‘ধর্মীয় বিধিনিষেধের’ কথা উল্লেখ করে এমন সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানানো হয় গণমাধ্যমকে। যেখানে অন্য ধর্মাবলম্বী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়কেও বিবেচনায় আনা হয়নি। দেশে বর্তমানে শতাধিক উপজেলায় ইউএনও হিসেবে নারীরা কাজ করছেন। সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে নিয়মমাফিক গার্ড অব অনার প্রদান করায় নেতৃত্ব দিলেও ধর্মীয় নিয়ম মেনে জানাজায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন নারী কর্মকর্তারা। ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের নারী সদস্যরাও তাই করেন। কেননা জানাজা আদায়ের বিধান নারীর জন্য প্রযোজ্যই নয়। তাহলে এই স্বাভাবিক বিষয়টি সংসদীয় কমিটির কাছে কেন ‘দৃষ্টিকটু’ ও ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ মনে হলো? এমন উদ্ভট সুপারিশ করে তারা যে শুধু এ দেশে নারীর অগ্রযাত্রাকে অবজ্ঞা করলেন তা শুধু নয়, একাত্তরে বীর নারীর অবদান ও আত্মত্যাগকেও অসম্মান করেছেন। এমন সুপারিশ নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোঁড়ামিকেও উসকে দেয়। দেশের আইনপ্রণেতাদের কাছ থেকে যা প্রত্যাশিত ছিল না।
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন নারী। তার সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের ফলে নারী উন্নয়ন আজ সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, কূটনীতি, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শান্তিরক্ষা মিশনসহ সর্বক্ষেত্রে নারীর সফল অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। লিঙ্গীয় সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণও বাড়ছে। এখন দেশের আনুষ্ঠানিক খাতের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখই নারী। জাতীয় উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তাই এ সরকারকে বলা হয় নারীবান্ধব সরকার, যা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে গর্বের।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির উদ্ভট সুপারিশে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সরকার। জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামসহ জঙ্গি মৌলবাদী দলগুলো নারী নেতৃত্ব হারাম বলে প্রায়শই ফতোয়া দিয়ে থাকে। তাহলে সংসদীয় কমিটির সম্মানিত সাংসদরা কি তাদের সেই পথটিকেই মসৃণ করার কাজে নেমেছেন! তারা কি সত্যিকার অর্থে শেখ হাসিনার নারী নেতৃত্বকে মন থেকে মেনে নিতে পেরেছেন? এমন প্রশ্নগুলোই এখন উচ্চারিত হচ্ছে সচেতন নাগরিকদের মুখে। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী হলেও সংসদ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আইন-আদালত প্রভৃতি এখনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। পুরোপুরি বদলায়নি নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও। যা স্পষ্ট হয়েছে সংসদীয় কমিটির প্রস্তাব সুপারিশের মাধ্যমে। সরকার যেখানে সব ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে আনায় কাজ করছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে নারী-পুরুষ বৈষম্য করা হলে তা সমাজে নারীর অগ্রগতির পথে একটি ভুল বার্তা দেবে। এটি বোঝার সক্ষমতা কি কমিটির সদস্যদের ছিল না!
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায়। অথচ এ সময়েই কীভাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় কমিটি ধর্মের অজুহাত দেখিয়ে নারীবিদ্বেষী, সংবিধানবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সুপারিশ করতে পারে আমাদের জানা নেই! বিশ্বাস করি সরকার সংসদীয় কমিটির এমন উদ্ভট প্রস্তাব বিবেচনায় নেবে না। কিন্তু সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থেকে নারীর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত ও বিতর্কিত করাসহ মৌলবাদীদের ইস্যু বাস্তবায়নে কারা কাজ করছে সেটিরও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সম্মানিত সাংসদেরও উচিত এমন প্রস্তাবনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা। আমরা আশা করব, নারীর অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করে এমন যেকোনো সিদ্ধান্ত রুখে দিয়ে বর্তমান নারীবান্ধব সরকার দেশে নারীবান্ধব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ ত্বরান্বিত করবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২১জুন ২০২১
© 2021, https:.