আমাদের কাছে আজও বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন চৌধুরী
‘তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। স্কুলে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত গাওয়া হতো। `পাক সার জমিন সাদ বাদ…’ শেষ হলেই উচ্চ কন্ঠে বলতে হতো পাকিস্তান জিন্দাবাদ। কেন জানি ওটা বলতে ইচ্ছে হতো না। পাকিস্তান জিন্দাবাদের স্থলে বলতাম ‘চিনসা বাঁশ’। মুখে ওটাই আসত। চট্টগ্রামে ‘চিনসা বাঁশ’ হলো উদ্ভট গন্ধওয়ালা একটি বাঁশ। যা মানুষের কাছে অসহ্য লাগে। এ খবর চলে যায় মওলানা শামসুল হকের কানে। উনি পাকিস্তানের ভক্ত, পরে রাজাকার হয়েছিলেন। পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতকে অপমান করায় ডেকে নিয়ে আমাকে খুব মারলেন। ফলে পাকিস্তানের প্রতি মন আরও বিগড়ে যায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বীজটি হয়তো তখনই রোপিত হয়েছিল।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বড়দের সঙ্গে আমরাও শহরে ঘুরে ঘুরে ফান্ড সংগ্রহ করি। কতটা নাজুক অবস্থা হলে একটা দেশের প্রতিরক্ষা ফান্ডের জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলতে হয়! অথচ দেখেন এখনও অনেকের কাছেই ওই পাকিস্তান যেন একটা রসগোল্লা।
চাচা মোক্তার হোসেন ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। এ কারণেই প্রফেসর আসহাব উদ্দিন আহমেদ প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আত্মগোপন করতেন। উনি ছিলেন যুক্তফ্রন্টে। গ্রামে হাট বসত। ওই হাটে ওনাদের মিটিংয়ের পাবলিসিটি করতাম। উনি লিখে দিতেন, মুখে টিনের চোঙা লাগিয়ে চিৎকার করে সেটা পড়তাম। আমার কাছে তখন ওটাই ছিল রাজনীতি।
ফতেয়াবাদ স্কুলে গ্রুপ করে বসতাম ছাত্র নেতাদের সঙ্গে। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন আবু তাহের মাসুদ ও বকতিয়ার নূর সিদ্দিকী। আওয়ামী লীগের মহিউদ্দিন ও এম এ মান্নানরাও দেশের নানা বিষয় বোঝাতেন। মূলত দেশপ্রেমটা তখনই তৈরি হয়। এরপর চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ভর্তি হয়ে যুক্ত হই ছাত্রলীগের সঙ্গে। সুলতানুল কবির চৌধুরী ছিলেন তখন ভিপি। রাতভর পোস্টারিং করতাম, মিটিং-মিছিল করাও ছিল বড় কাজ। কাউকে তেমন ডাকাডাকি করতে হতো না তখন। সবাই মনের টানেই মিটিং-মিছিলে চলে আসত। পকেটের টাকা খরচ করেই রাজনীতি করতে হয়েছে। নিজের উন্নয়নের জন্য নয়, তখন দেশের জন্য রাজনীতি করেছি। বলতে খারাপ লাগে, এখন নিজের উন্নয়ন করাটাই যেন রাজনীতি, দেশ জাহান্নামে যাক। অথচ এখনও দেশ ও পতাকা নিয়ে কেউ কিছু বললেই ভেতরটা জ্বলে যায়। ঠিক থাকতে পারি না তখন।’
শৈশব ও কৈশোরের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন চৌধুরী। এক সকালে তার বাড়িতে বসেই চলে যুদ্ধদিনের নানা আলাপচারিতা। এম সৈয়দ হোসাইন চৌধুরী ও মাহমুদা খাতুন চৌধুরানীর তৃতীয় সন্তান ও একমাত্র পুত্র সরওয়ার। বাবা শিক্ষকতা করতেন। তিনি হাতী কোম্পানির ক্যাশিয়ার হিসেবেও চাকুরি করেছেন। তাদের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালি উপজেলার পূর্ব রায়ছটা গ্রামে। সরওয়ারের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি পূর্ব রায়ছটা প্রি প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৭০ সালে ম্যাট্রিক পাশের পর তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।
১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়লাভ করলেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ফলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারাদেশে চলে অসহোযোগ আন্দোলন। বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে সবাই। নেতা সেই নির্দেশই দেন ৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে, ঢাকার রেসকোর্স মাঠে। সরওয়ারের ভাষায়, “নেতার ভাষণ শুনেছি একদিন পর, রেডিওতে। সবার মুখে তখন স্বাধীনতার কথা। বঙ্গবন্ধু বললেন, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে…তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো….।’ আমরা যা চাচ্ছি, বঙ্গবন্ধু সে কথাগুলোই যেন উচ্চারণ করলেন। নেতার কথাগুলোই ছিল প্রেরণা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠই ছিল বুলেট।”
বাঁশখালিতে পাকিস্তানি আর্মি আসে কোন তারিখে?
সরওয়ারের উত্তর: ‘মে মাসের ১৯ তারিখে। ওরা এসেই বালিগ্রামে মানুষের ওপর অত্যাচার করা শুরু করে। নাপোড়াসহ কয়েকটা হিন্দু এলাকায় প্রায় ৯২ জনকে হত্যা করে এবং গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়। আমাদের ওখানে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল সিদ্দিক আহমদ সওদাগর। পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছে মৌলভী হাসানসহ অনেকেই। ওদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা গণহারে মানুষ হত্যা করার সুযোগ পায়।’
ভিডিও: এখন পর্যন্ত কোনো রাজাকার বলেছে আমি রাজাকার ছিলাম, কেন বলে না?
বাঁশখালিতে আর্মি ঢুকলে সরওয়াররা গোপনে সংগঠিত হতে থাকেন। নেতৃত্ব দেন ডা. আবু ইউসুফ চৌধুরী। বানিগ্রামের পাহাড়ি এলাকা ও বিভিন্ন বাড়িতে গোপনে চলে নানা পরিকল্পনা। পাকিস্তানিদের রেভিনিউ ইনকাম বন্ধ করতে তারা প্রথমে গুনাগরি খাসমাহাল আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। দলে ছিলেন হাজি আহমদ মিয়া, খন্দকার সমিউদ্দিন, সরওয়ার, শহীদ মমতাজ, ফরিদুল আলম মানিক, ইসহাক, আবু সোলায়মান চৌধুরী প্রমুখ। তখন কোনো ট্রেনিং ছিল না। দেশপ্রেমটাই ছিল সাহস। তবে দলে মানিক, মমতাজসহ কয়েকজন ছিলেন বিভিন্ন বাহিনী থেকে আসা বাঙালি সদস্য। রাত নয়টার দিকে তারা গুনাগরি খাসমাহাল আক্রমণ করে মূলবান রেকর্ড কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে দেন।
এরপরই এক বিকেলে শাহজাহানপুর ফরেস্ট বিটে আক্রমণ করে বেশ কয়েকটি বন্দুক সংগ্রহ করেন। ফলে তাদের সাহস যায় বেড়ে। এক রাতে বাঁশখালি সিও অফিসেও হামলা করে সাইক্লোস্টেন মেশিন নিয়ে এসে পুরো অফিসটি পুড়িয়ে দেন। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সবাই বুঝে যায় মুক্তিবাহিনী বাঁশখালিতেও ঢুকে গেছে। তখন এমন জানান দেওয়াটাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এভাবে তো বেশিদিন টিকে থাকা যাবে না। তাই সরওয়াররা ট্রেনিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।
কীভাবে?
তার ভাষায়– ‘মে মাসের শেষে বা জুনের প্রথম দিকের কথা। মিরেরসরাই হয়ে ইন্ডিয়ায় ঢুকি। সঙ্গে ছিলেন রশিদ ভাই, মান্নান, আবু সোলায়মান চৌধুরী, ডা. ইউসুফ প্রমুখ। আমরা যাব হারিনায়। সাবরুম যেতেই নামের লিস্ট করা হয়। এর পরই কাকরের পথ পেরোই। পায়ে তো জুতা নেই, ওই পথে চলতে মনে হয়েছে জানটা বেরিয়ে যাচ্ছে।
হরিনায় এম এ আজিজ ইয়ুথ ক্যাম্পে দেখা হয় হাশেম, মোক্তার ও আবু ছালেহ ভাইয়ের সঙ্গে। আমিসহ ছাত্রলীগ যারা করতাম ওখানে তাদের একটা আলাদা তালিকা করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আগরতলায়। সেখানে প্রথমে ব্রিফ করেন আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব প্রমুখ। তখনও জানি না কোন বাহিনী গড়া হচ্ছে। নেতারা শুধু বোঝালেন, দেশ যদি স্বাধীন না হয় বঙ্গবন্ধুকে আমরা পাব না। বাঙালির হৃদয়জুড়ে তখন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু না হলে বাংলাদেশ হতো না। আমাদের কাছে আজও বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ।’
এরপর কার্গো প্লেনে সরওয়ারদের প্রথম পাঠানো হয় আসাম এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে নেওয়া হয় দেরাদুনের তান্দুয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে। ছয় সপ্তাহের বিএলএফ ট্রেনিং হয় ওখানেই। ট্রেনিংয়ের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল সুজন সিং উবান। উনি বিশ্বের নামকরা একজন গেরিলা। ক্যাম্পে ছিলেন মেজর মালহোত্রাও। একেক দিন একেক অস্ত্রের ট্রেনিং হতো। রাতে চলে পলিটিক্যাল ক্লাস। ওয়্যারলেসের ব্যবহার বিষয়ক ক্লাস নিতেন মালায় আলম। ওই ক্যাম্পের ইনস্ট্রাকটর চিফ ছিলেন হাসানুল হক ইনু। ফাহিম উদ্দিন আহমেদ ছিলেন ইনস্ট্রাকটর ।
ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ওই ক্যাম্পেই এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর মেজ ছেলে শেখ জামাল। তাকে নিয়ে একটি অজানা ঘটনার কথা জানান মুক্তিযোদ্ধা সরওয়ার। সে ইতিহাস বলতে গিয়ে তার চোখ দুটো বারবার ভিজে যাচ্ছিল। আমরা তখন নীরব থাকি। এই বীর বলেন, “শেখ মুজিবের ছেলে আসছে– এ খবরটা ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে। আমিও তাকে দেখতে যাই। শেখ জামালকে প্রথম দেখে বলেই ফেললাম, ধুর, এটা বঙ্গবন্ধুর ছেলে নাকি! মনে হচ্ছে না। কথাটা কীভাবে যেন তার কানে চলে যায়। ওভাবে বলা আমার ঠিক হয়নি, উনি কী ভাবলেন? এমন চিন্তায় মনটাও ছটফট করছিল। পরদিনের ঘটনা। দুপুরে রেস্ট নিচ্ছি। শেখ জামাল আসলেন। তাকে দেখেই খুব লজ্জিত হই। ওই কথাটির জন্য তার কাছে ক্ষমাও চাইলাম। উনি আমার মনের অবস্থা বুঝে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমরা ভাই ভাই। শেখ মুজিবের ছেলে হিসেবে এখানে আসিনি। আমি আপনাদেরই ভাই। আপনাদের মতোই দেশের জন্য যুদ্ধ করতে আসছি।’ মুজিবের রক্তে যে কী উদারতা তা ওইদিনই বুঝেছি! কয়েকদিন পরেই তোফায়েল ভাই আর মনি ভাই এসে শেখ জামালকে অন্যত্র নিয়ে যান।”
ট্রেনিংয়ের পর তাদের পাঠানো হয় আগরতলায়, উদয়নগর হোল্ডিং ক্যাম্পে। সেখান থেকে রামগড় হয়ে বিভিন্ন গ্রুপে প্রায় দুই থেকে আড়াইশ মুক্তিযোদ্ধার সাথে ঢোকেন দেশের ভেতরে। কিন্তু গন্তব্যে যাওয়ার আগেই তারা বাধার মুখে পড়েন। এক অপারেশনে রক্তাক্তও হন।
কী ঘটেছিল ওইদিন?
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মোহাম্মদ সরওয়ার বলেন, ওই রুট দিয়েই ভেতরে আসতে হতো। আমরা আসি ফটিকছড়ির যোগ্যাছোলা নামক জায়গায়। ওখানে একটা মাদ্রাসায় আশ্রয় নিই। গ্রামের লোকেরা তখন খাবার দিয়ে সাহায্য করত। ভিখারিরাও খাবার দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। একাত্তরে খুব কম ধনী মানুষই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। করেছে কারা? সাধারণ মানুষই সাহায্য করেছে। যাদের কিছু ছিল না, তারাই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি।
নভেম্বরের ১৩-১৫ তারিখের ঘটনা। যোগ্যাছোলা বাজারে হাটের দিন পাঞ্জাবিরা আসে রাজাকারদের নিয়ে। ওরা এসে লুটপাট করত। জানলাম পরদিন ওরা আসতে পারে, তাই হলো। সকালের দিকেই ওরা এসেই বাজারে আগুন দেয়। লোকজন সব পালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমরা তো সরতে পারছি না। কারণ, তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মানুষের আস্থা থাকবে না।
আমাদের সঙ্গে সাতকানিয়া, বোয়ালখালি ও রাঙ্গুনিয়ার গ্রুপও ছিল। আর পাকিস্তানি মিলিটারিসহ ওরা ছিল শতাধিক। পাহাড়ের টিলার বিভিন্ন জায়গায় আমরা লুকিয়ে পজিশন নিয়ে থাকি। ওরা দূর পাহাড়ের ওপর থেকে সেটা খেয়াল করে। এরপর আস্তে আস্তে এসে ঘিরে ফেলে। ওরা প্রচুর গোলাগুলি করে, কিন্তু আমাদের এখানে এসে তা পৌঁছায় না। দু-একটা প্রতুত্তর দি-ই শুধু আমরা।
ডান পাশে এলএমজি নিয়ে রশিদ, এসএমজি নিয়ে ছিল নুরুন্নবী, ডান দিকে ছিল আবুল কালাম, জসিম, আক্তার আহমদ সিকদার, ফিরোজ, রাজেন্দ্র। গোলাগুলি চলছে। পাকিস্তানিরা আস্তে আস্তে কাছাকাছি চলে আসে। আমি একটু উগ্র, বদ মেজাজিও। রশিদ ভাইকে বললাম, ‘সবাইরে তো পাকিস্তানিরা মাইরা ফেলব। মারতে তো পারলাম না ভাই, না মেরেই মরে যাব?’ বলেই দাঁড়িয়ে এসএলআর চালাই। ওরা কয়েকটা লুটিয়ে পড়ে। ‘কি করতেছিস’ বলেই হঠাৎ পেছন থেকে আবুল কালাম আমার লুঙ্গি টেনে ধরে। তখন মাথা নিচু করে বসে যাই। ঠিক তখনই বাঁ কানের পেছনের দিকে মর্টারের একটি স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়ে বেড়িয়ে যায়। ওদের টার্গেট ছিল আমার নাভি বরাবর, বসে পড়াতে সেটা হয়নি। কিন্তু আমি ছিটকে পড়ি। ফলে একটা গাছের সাথে লেগে আমার বাঁ দিকের কলার বোন ভেঙে যায়। ব্যথায় ছটফট করতে থাকি। বেশ খানিকক্ষণ পর পাকিস্তানিরা পিছু হটে। সহযোদ্ধারা তখন আমায় তুলে আনে।
একাত্তরে সহযোদ্ধারাই ছিল সবচেয়ে আপন। একজন আরেকজনকে বলত, তুই মারা গেলে দেশ স্বাধীন করবে কে! আমার চেয়ে তোকেই বেঁচে থাকতে হবে দেশ স্বাধীনের জন্য। একজন আরেকজনের জন্য জীবন দিতেও এগিয়ে যেত। এ যেন মরার কম্পিটিশন। কমান্ডার ডা. আবু ইউসুফ চৌধুরী নিজেই চিকিৎসক। ফলে ওখানে আমার চিকিৎসাটা উনিই করেন।
আহত হওয়ার পর সরওয়াররা ফিরে আসেন ক্যাম্পে। এসে দেখেন খাবার রেডি, গরম গরম ভাত। যুদ্ধের সময়ও এসব নিয়ে আসল কে? ওই মাদ্রাসার হুজুরের বউ। ওনার কেউ নন তারা। তাকে ডেকে সবাই বলে, জীবন বাঁচাতে এলাকার সবাই চলে গেছে, আপনি যান নাই কেন? উনি বলেন, ‘বাবা কোথায় যামু, আমার ছেলেরা যুদ্ধে গেছে, মা হয়ে আমি কি পালায়া যাইতে পারি?’ এ ঘটনা বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন এই মুক্তিযোদ্ধা। বলেন, ‘এটাও একটা বড় যুদ্ধ। যা করেছিল নারীরা। একাত্তরে ওই নারীর অবদানও কিন্তু কম ছিল না।’
এভাবে নানা বাঁধা পেরিয়ে বাঁশখালিতে পৌঁছেন মুক্তিযোদ্ধা সরওয়াররা। গোটা দলে ছিলেন আটজন। ডা. আবু ইউসুফ চৌধুরী কমান্ডার আর ডেপুটি কমান্ডার ফেনির এ ওয়াই এম জাকারিয়া চৌধুরী। বাকীরা হলেন সরওয়ার, সৈয়দ দিদারুল আলম, আব্দুল মান্নান, আবু সোলায়মান চৌধুরী, আব্দুর রশিদ (এলএমজি), আবুল কালাম।
তিনি বলেন, ‘বাঁশখালিতে বিভিন্ন বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতাম। কলেজে ছিল আর্মি ক্যাম্প। আমরা যাওয়ার আগেই ওরা শহরের দিকে চলে যায়। কিন্তু গোটা এলাকা ছিল রাজাকারদের নিয়ন্ত্রণে। ওদের বড় ক্যাম্প ছিল গুনাগরি ওয়াপদা অফিসে। অপারেশন করে ওদের সবাইকে সারেন্ডার করাই। পরে বাঁশখালি থানাতেও অপারেশন করি। ডিসেম্বরের ১২ তারিখে বাঁশখালি মুক্ত হলে আমরা অপারেশন করি কুতুবদিয়া থানায়। স্বাধীনতা লাভের পর অস্ত্র জমা রাখি ঢাকা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে।’
বঙ্গবন্ধুর শাসনামল নিয়ে বলেন?
তিনি বলেন, ‘একটা যুদ্ধবিধস্ত দেশকে শূন্য থেকে তুলে এনেছেন তিনি। দেশের উন্নয়নের শুরুটা করেছেন বঙ্গবন্ধুই। যখনই উনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন তখনই তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। যার জন্য যুদ্ধ করলাম তাকেই স্বাধীন দেশে মেরে ফেলা হলো। নেতাদের সঙ্গে একবার গিয়েছিলাম ধানমন্ডিতে, বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে। গোটা ঘরে লোকজন। বঙ্গবন্ধু পেছনে এসে দাঁড়ালেন। ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, ‘কেমন আছিস?’ মনে হলো আমি যেন তার কত চেনা। কতটা বিশাল মনের অধিকারী হলে বঙ্গবন্ধু প্রটোকল ভেঙ্গে এমনটা করতে পারেন!’
যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের প্রসঙ্গে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘একাত্তরে পাকিস্তানি দালাল ছিল জামায়াত-শিবির, রাজাকার, আল-বদর ও আল শামসের লোকেরা। কিন্তু এদেরকে কি পাকিস্তান ভিসা দিয়েছে? বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় কি তাদের দালালদের পাকিস্তান কি বলেছে তুমি এখানে চলে আসো? কেন বলে নাই? কারণ পালা কুকুরকে ভাল ভাল খাবার দেওয়া যায়, কিন্তু বেডরুমে নেওয়া যায় না। পাকিস্তানের কাছে ওরাও তেমনই।’
যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সে দেশ কি পেয়েছেন?
‘অবশ্যই পেয়েছি। একবারেই তো যুদ্ধ করি নাই, দেশটাও স্বাধীন হয় নাই একদিনে। বঙ্গবন্ধু আস্তে আস্তে একটা জাতিকে একত্রিত করেছেন। আমাদের ভেতর দেশপ্রেম ঢুকিয়ে দিয়েছেন। স্বাধীনতার পুরো ফল পেতে হলে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। সুন্দর বিল্ডিং, সুন্দর রাস্তা পাচ্ছি। যমুনা সেতু, পদ্মা সেতু পাচ্ছি। সারা বিশ্বে আমার দেশের নাম হচ্ছে। এটাও কি কম পাওয়া? বাকী কাজটা করতে হবে প্রজন্মকে।
দেশ কেমন চলছে?
‘খুব ভাল চলছে। তবে একটা ভুল পলিসিও শুরু হয়েছে।’
কি সেটি?
‘সরকার সব জায়গায় উন্নয়ন করছে। ধরেন, সরকারি একটা বিল্ডিং তৈরি করা হলো। বলা হচ্ছে এটা সরাসরি জননেত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে হয়েছে। মানে সে যে চুরি করেছে সেটা যেন ওইদিক দিয়ে চলে যায়। তাহলে তুমি কি করছো, তোমার দায়িত্ব কি ছিল? সব শেখ হাসিনার ওপর চাপিয়ে দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে। এটা আসলে নিজের দায়দায়িত্ব এড়ানোর টেকনিক। আমরা তো প্রধানমন্ত্রী বলি না। শেখ হাসিনা আমাদের আপা হন। আপা যদি ওদের একটু সর্তক করে দেন। তাহলে দেশটা আরও এগিয়ে যাবে।’
কী করলে দেশটা আরও এগিয়ে যাবে?
এই যোদ্ধার অকপট উত্তর, ‘আরও ভাল কিছু চাইলে চুরি বন্ধ করেন, দুর্নীতি বন্ধ করেন। দুর্নীতিবাজের সন্তানদের উদ্দেশে এই বীর বলেন, দুর্নীতিবাজের সন্তান হয়ে বড় হইও না। তোমারে যদি বলে দুর্নীতিবাজের ছেলে, তাহলে তোমার লেখাপড়া করে লাভটা কী? এই প্রশ্নটা তোমার বাপকে তোমরা করো।’
নিজের জন্য, ভবিষ্যতের সুবিধা লাভের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেননি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন চৌধুরী। দেশটা ভাল থাকলেই তিনি ভালো থাকেন। প্রজন্মের হাত ধরেই এ দেশটা এগিয়ে যাবে– এমনটাই বিশ্বাস এই বীরের।
তাই তাদের উদ্দেশেই তিনি শুধু বললেন, ‘আমাদের যেটা সামর্থ্য ছিল করে দিয়েছি। স্বাধীন দেশটা তোমরাই ভোগ করবে। তুমি ছাত্র হলে বেশি বেশি লেখাপড়া করো, ওটাই এখন তোমার মুক্তিযুদ্ধ। তোমরা যেকোনো কাজ সততার সঙ্গে করো, ওটাই দেশপ্রেম। আর এই করোনাভাইরাসের সময়টাতে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং অপরকে মেনে চলতে বলাটাই সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা তোমরাই। তোমাদের হাত ধরেই আসুক করোনামুক্ত সোনার বাংলা।’
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম: যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মোহাম্মদ সরওয়ার হোসাইন চৌধুরী
ট্রেনিং: ছয় সপ্তাহের বিএলএফ ট্রেনিং নেন ভারতে দেরাদুনের তান্দুয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে।
মুক্তিযুদ্ধ করেছেন: বিএলএফ-এর অধীনে যুদ্ধ করেন ফটিকছড়ির যোগ্যাছোলা, রাঙামাটির কাউখালি, কুতুবদিয়া থানা ও বাঁশখালির বিভিন্ন এলাকায়।
যুদ্ধাহত: নভেম্বরের ১৩-১৫ তারিখ। ফটিকছড়ির যোগ্যাছোলায় এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের মর্টারের একটি স্প্লিন্টার তার বাঁ কানের পেছনের দিকে বিদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যায়। তখন গাছের সাথে লেগে তার বাঁ দিকের কলার বোনও ভেঙে যায়। এছাড়া রাঙামাটির কাউখালিতে আরেক অপারেশনে তিনি বুকের ডান পাজরেও আঘাতপ্রাপ্ত হন।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৯ জুলাই ২০২১
© 2021, https:.