বীরগাথা ১৯৭১: ‘বঙ্গবন্ধুর কথাগুলাই রক্তের লগে মিশা গেছিল’
“বাপ-চাচাদের আলাপে শুনতাম ডিভাইডেশনের কথা। বাজারে চায়ের দোকানে বৈষম্য নিয়ে আলোচনা হইত। আমগো দেশের ভালো জিনিস পশ্চিমে চইলা যায়। কাগজের দাম ছিল বেশি। বালাম চাল এখানে চাষ হইলেও আমরা খাইতে পারতাম না। দেশটা যেন কেমন হইয়া গেছিল। সবাই বঙ্গবন্ধুর কথা কয়। বাঙালিগো জন্যে তিনিই মাঠে নামছিলেন।
“আমগো এহানে আওয়ামী লীগের নেতা তহন নুরু জমারদার, সামাদ কাজী, রব খানসহ অনেকেই। রাজনীতি বুঝতাম না। মাঝেমইধ্যে বাজারের বাতি নিভিয়া দিত।”
কেন?
“বাবা কইত, যদি প্লেন থাইকা বোমা মারে! কতকিছু ভাবতাম তহন। বোমা ফালাইলে গ্রামের সব লোক তো মইরা শেষ। ওরা কেন নিরীহ মানুষ মারব? ওরা না মুসলমান! শেষে বোমা নিয়া প্লেন আইলো না। একাত্তরে বরিশালে পাকিস্তানি আর্মিরা আইলো গানবোট লইয়া।”
মুক্তিযুদ্ধের আগের নানা ঘটনা নিজ বাড়িতে বসে এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম শাখাওয়াত হোসেন।
আবুল হাশেম সরদার ও আছিয়া বেগমের বড় সন্তান শাখাওয়াত। বাবা ছিলেন চালের ব্যবসায়ী। বাড়ি বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বাবার খানা গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ক্লাস নাইনের ছাত্র।
তিনি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শোনেন রেডিওতে, একদিন পর। তিনি বলেন:
“ওইদিন ছিল হাটবার। মা আমারে পাঠায় ধামুরা বাজারে। মানুষ মরলে যেমন ভিড় লাগে, দেহি দোকানে দোকানে তেমন ভিড়। একটা দোকানে গিয়া শুনি ভাষণডা। বঙ্গবন্ধু বললেন, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ…। চেতনা তহন জাইগা ওঠে। বঙ্গবন্ধুর কথাগুলাই রক্তের লগে মিশা গেছিল।”
২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় পাকিস্তানি আর্মিরা গণহত্যা চালায়। কিন্তু বরিশালে আর্মি আসে আরও পরে। ওরা এসেই তারা গানবোট দিয়া আশপাশের এলাকার বাঙালি হত্যার মিশনে নামে। একবার ধামুরায় এসে বাজার জ্বালিয়ে দেয়। ওইদিনই হত্যা করে সরেন ডাক্তারসহ তিনজনকে। ষোলকগ্রামে ঢুকেও মেরে ফেলে কয়েকজনকে। এ সব দেখে ঠিক থাকতে পারেন না শাখাওয়াত। সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার।
তার ভাষায়: “মালেক, হাবিব, মোজাম্মেল, শফিকুল ও আমি—পাঁচজন একত্রিত হই। আমাদের মধ্যে বড় ও চৌকস ছিল মালেক। খোঁজ নিয়ে ওই-ই ট্রেনিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সঙ্গে নিতে হবে দুই কেজি চিড়া, আধা কেজি গুড়, নগদ কিছু টাকা। দোকান থাইকা আব্বা নামাজে গেলে সে সুযোগটা নিই। দোকানের চাল বেইচা পাই বাইশ টাকা। বাড়িতে কৌটায় রাখা ছিল আম্মার একটা স্বর্ণের হার। ওইটা নিয়া পরে ভারতে বেইচা দেই দেড়শ টাকায়।
“শ্রাবণ মাসের এক ভোরে আমরা নৌকায় রওনা হই। ধামুরা বাজার থেকে সোজা পশ্চিম দিকে। পরে যশোরের বাগদা বর্ডার দিয়ে চলে যাই ভারতের হাসনাবাদ ক্যাম্পে। সেখান থেকে পাঠানো হয় প্রথমে জোড়পুকুর পাড় এবং পরে পিপা ক্যাম্পে। সেখানে ছয়-সাত দিন চলে লেফট-রাইট। অতঃপর হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য আমগো ১২৫ জনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বীরভূম পাহাড়ের ক্যাম্পে।”
বীরভূমের প্রথম ব্যাচে শাখাওয়াতরা ট্রেনিং নেন ২৯ দিন। ভারতের শিখ সেনারা ট্রেনিং করায়। উচ্চতায় ছোট ছিলেন তিনি। ফলে ক্রলিংয়ের সময় পেছনে পড়ে যেতেন। কষ্ট ছিল অনেক। তবু বুকে তার দেশ স্বাধীনের বাসনা। সব কষ্ট মেনে নিয়ে শিখে নেন রাইফেল, এসএলআর, এলএমজি চালানো।
কোথায় কোথায় অপারেশন করেছেন?
“জুলুম করব না, অত্যাচার করব না, শক্রুকে ঘায়েল করব, দেশ স্বাধীন করতে মৃত্যুকেও মেনে নিব—এমন শপথ করেছিলাম বেগুনদি ক্যাম্পে। পরে অস্ত্র দিয়ে আমাদের পঞ্চাশ জনকে পাঠানো হয় ভোলায়। নৌকায় নৌকায় গিয়ে গেরিলা অপারেশ করতাম। নয় নম্বর সেক্টরের দৌলতখাঁ থানা ও চরপাতা গ্রামে যুদ্ধ করেছি। কমান্ড করতেন আলি আকবর। দশ জন করে গ্রুপও ছিল। আমার গ্রুপে কমান্ডার ছিলেন মজিবুল হক মন্টু।
“দৌলতখাঁ থানা অপারেশন ছিল মুক্তিযোদ্ধা শাখাওয়াতের প্রথম যুদ্ধ। সারারাত ফায়ারিং হচ্ছিল। পেছন থেকে ছোড়া মর্টারগুলো ঠিক জায়গায় পড়ছিল না। ফলে বিপদে পড়ে যায় সবাই। থেমে থেমে গোলাগুলি চলছে। পাঞ্জাবিরা পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে গুলি চালায়। জয় বাংলা বলে শাখাওয়াতরাও প্রত্যুত্তর দেয়।
“রশিদ নামে এক মুক্তিযোদ্ধা ছিল শাখাওয়াতদের সঙ্গে। এক বাপের এক ছেলে। রসিকতা করে ক্যাম্পের সবাইকে মাতিয়ে রাখত সে। ওই অপারেশনে তাঁর পজিশন ছিল শাখাওয়াতের ডান পাশে, মরা একটি খেজুর গাছের পাশে। হঠাৎ গুলি এসে লাগে তাঁর মাথায়। ছিটকে পড়েন তিনি। ধীরে ধীরে নিথর হয়ে যায় তাঁর দেহ। চোখের সামনে সহযোদ্ধার এমন মৃত্যুতে শাখাওয়াতরা ঠিক থাকতে পারে না। মনে জাগে প্রতিশোধের আগুন। ওই অপারেশনেই তাঁরা থানা দখল করে নেন। আত্মসমর্পন করান ২০-৩০ জন পাকিস্তানি সেনাকে। ওদের ওপর সাধারণ মানুষ এতই ক্ষুব্ধ ছিল যে, কয়েকজনকে একটি পুকুরে নামিয়ে পিটিয়ে মারে।”
এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা শাখাওয়াত। পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে তাঁর বাঁ হাতের কনুইয়ের ওপরের হাড় গুঁড়ো হয়ে যায়। ফলে হাতটি সারা জীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারায়। ব্যথা হয় এখনও। হাতটি কাটা না পরায় কেউ তাকে হাতকাটা শাখাওয়াত বলে ডাকছে না—এটাই তাঁর সান্ত্বনা। মুক্তিযুদ্ধের এতো বছর পরও সেদিনের দুঃখস্মৃতি আজও তাকে কাঁদায়। রক্তাক্ত ওই দিনটির কথা শুনি এ যোদ্ধার জবানিতে:
“আমগো ক্যাম্প তহন চরপাতা গ্রামে, সুশীল ডাক্তারের বাড়িতে। ভোলার ওবদা অফিসে ছিল পাকিস্তানি সেনাগো ক্যাম্প। সেখান থেকে ওরা আসবে চরপাতায়। ওই গ্রামের হিন্দুরাই ছিল ওগো টার্গেট। খবরটা পাই ওবদা অফিসের এক ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাছে।
“আগের দিনই ১০-১২টা বাঙ্কার করি ঘুংগিয়ার হাটের মোড়ে। ওই পথেই ঢুকতে হয় চরপাতা গ্রামটিতে। মোহাম্মদ আলী টুনি নামে এক লোক ছিল ওখানে। বাঙ্কার তৈরিতে সে আমগো সাহায্য করে। কাজ শেষে বাড়িতে নিয়া খাসি জবাই দিয়া খাওয়ায়। কিন্তু টুনি যে ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত, আমরা তা জানতাম না।
“তখন শীতকাল। রাতের বেলায় তো আর্মি গ্রামে ঢুকবে না। টুনি আমগো ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। আমরাও তা-ই করি। কিন্তু রাতের মধ্যেই সে পাকিস্তানি আর্মিগো খবর দেয়। ওরা এসে আমগো বাঙ্কারেই পজিশন নিয়া অপেক্ষায় থাকে।
“মাঝখানে ফাঁকা মাঠ। এরপরই ছিল ক্যাম্প। নানা চিন্তায় সারা রাত আমগো ঘুম আসে না। আনুমানিক চার নভেম্বরের ঘটনা। খুব ভোরে একটা গ্রুপ রওনা হলাম। সবার সামনে রেকিম্যান। মজিবুলই কমান্ডে। খুব কুয়াশা ছিল। কাছাকাছি কিছুই দেখা যায় না। বাজারের একদিকে পাকিস্তানি সেনারা টহল দিচ্ছে। অন্যদিক দিয়া ঢুকি আমরা। হঠাৎ ওরা সামনাসামনি হয়ে যায়। মুখোমুখি হতেই হাতাহাতি শুরু হয়।
“আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। আত্মা তখনই শুকায়া গেছে। পাকিস্তানি এক সেনা বন্দুক তাক করে আমার বুকে। টিগারে চাপ দেওয়ার আগেই ডানে সরে আসি। ফলে গুলি এসে লাগে আমার বাঁ হাতে, কনুইয়ের ওপরের হাড়ে। ছিটকে পরি রাস্তার পাশের নিচু জায়গায়। মনে হচ্ছিল কাঁটার গুঁতা খেয়েছি। পিলপিল করে রক্ত বেরোচ্ছে। আঙুলে স্পর্শ করতেই দেখি হাড়ের গুঁড়া বেরিয়ে আসছে। রক্ত গিয়ে ক্রমেই শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল। প্যাক-কাদার ভেতর দিয়ে ক্রলিং করে সরে যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু না, হাতের ব্যথায় তা-ও পারি না। হাড় গুঁড়ো হয়ে দুইভাগ হয়ে গেছে। চামড়ার সঙ্গে লেগে ছিল কোনোরকমে। নাড়া লাগলেই হাড্ডিতে হাড্ডি ঘষা লেগে জীবন বেরিয়ে যাচ্ছিল। রক্তাক্ত দেহ নিয়ে কাদার মধ্যেই পড়ে থাকি। মনে মনে জপি আল্লাহর নাম।
“গোলাগুলি থামতেই পাকিস্তানি সেনাগো চোখ পড়ে আমার ওপর। একজন বলল, হামারে আদমি নেহি। শালাকো গুলি কর। আরেকজন বলে, বাদ মারো। শালা মার গ্যায়া। আমি ওদের পায়ের আওয়াজ শুনছিলাম। ওরা চলে যেতেই পাশের একটা বাড়িতে গিয়া উঠি। প্রচণ্ড পানির পিপাসা। শরীরও কাঁপছে। কাসার বাটিতে করে এক হিন্দু লোক পানি এনে দিল। দুই ঢোক খাওয়ার পরই হাত থেকে বাটিটা পড়ে যায়। এরপর জ্ঞান হারাই।”
গুলি লাগার চেয়েও কষ্টের ছিল বীর এই মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসার সময়টা। সে কথা বলতে গিয়ে চোখ ভেজান তিনি। দেশের স্বাধীনতার জন্য এক যোদ্ধার কষ্টের অনুভূতি আমাদেরও স্পর্শ করে। তিনি বলেন:
“ওই কষ্টগুলার কথা ভুলতে পারমু না। হাতের দিকে তাকালেই সব জীবন্ত হয়ে ওঠে! দুই টুকরা হয়ে হাড় ঝুলে ছিল চামড়ার সাথে। হাতে লাগা প্যাঁককাদাগুলো ধোয়া হয় পানি ঢেলে। শরীরটা তখন কেঁপে কেঁপে জায়গাটাও ছ্যাচছ্যাচ করে ওঠে। কি যে কষ্ট পাইছি গো, বাবাগো… বলে কত কাঁদছি!
“একদিন ভোলা হাসাপাতাল থেকে এক ডাক্তার এসে ইনজেকশন দিয়ে যায়। হাতে তখনও ঘা। কষ্টও বেড়ে গেছে। উঠতে পারতাম না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কলার খোলে পায়খানা করতাম। সেটা ফেলে দিত মান্নান নামের এক যুবক। ও আমারে ভাইয়ের মতো সেবা করছে। একদিন আকাশে বিমান উড়ছে। সবাই বলে দেশ স্বাধীন। আমার হাতে তহন পচন ধরা। কিন্তু স্বাধীনতার কথা শুইনাই সব কষ্ট কইমা গেল।”
স্বাধীনতার পর চিকিৎসার জন্য শাখাওয়াতকে পাঠানো হয় ঢাকায়। পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে হাতের অপারেশন করেন ডাক্তার গ্যাস্ট। বাঁ হাতের কবজিতে রড ঢুকিয়ে চারটা নাট-বল্টু লাগিয়ে, হাড়ের টুকরা দুটি জয়েন্ট দেওয়া হয়। ফলে ওই হাতে কোনো রগ নেই। হাতটা তেমন নাড়াতেও পারেন না শাখাওয়াত।
১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনা ও স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার, আলবদরদের হত্যাযজ্ঞের ইতিহাসসহ মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাসও তুলে ধরতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। দেশের ইতিহাস না জানালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রজন্ম তৈরি হবে না—এমনটাই মনে করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এস এম শাখাওয়াত হোসেন।
পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন: মা, মাটি, দেশ—এই তিনটির প্রতি ভালোবাসা না থাকলে তুমি এগোতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাসই তোমায় পথ দেখাবে। তাই স্বাধীনতার ইতিহাসটি তোমরা ছড়িয়ে দিও।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ প্রকাশে, প্রকাশকাল: আগস্ট ৬, ২০২১
© 2021, https:.